বিষ কন্যা

বিষ কন্যা, সম্পূর্ণ উপন্যাস
====================
গৌড় চন্দ্রিকা
==========
প্রাচীন ভারতের স্বাধীনতা আর স্বতন্ত্রতা ধ্বংস হয়েছিল বর্বর তুর্কি আক্রমণের ফলে। শুধু স্বাধীনতা হরণই নয় সেই সাথে প্রাচীন ভারতবর্ষের যাবতীয় ঐতিহ্য, প্রাচুর্য আর গরিমাও বিনষ্ট হয়েছিল এই বিজাতীয় আগ্রাসনের ফলে। এক কথায় বলতে গেলে পতন হয়েছিল একটি স্বর্ণময় সভ্যতার। তুর্কিরা নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় সহ প্রাচীন ভারতের একাধিক পাঠশালায় হামলা চালিয়ে সেখানে রক্ষিত প্রাচীন পুস্তকগুলি পুড়িয়ে বা চাঁদ বারদাই দ্বারা রচিত পৃথ্বীরাজ রাসোর মতো পুস্তকের লেখনি বিকৃত করে তুর্কিরা নষ্ট করে দিতে চেয়েছিল পুরো একটা অধ্যায়ের ইতিহাস। প্রমান করতে চেয়েছিল যে প্রাচীন ভারতের অধিবাসীরা আসলে অশিক্ষিত আর বর্বর ছিলেন এবং তাঁরা উল্লেখযোগ্য কোনও ইতিহাস রচিত করতে পারেননি।

এই তুর্কি আগ্রাসনকারীদের মধ্যে সবচেয়ে কুখ্যাত ব্যক্তিরা হলেন গজনীর সুলতান মামুদ, ঘুরের সুলতান মহম্মদ ঘোরী, দিল্লির সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি আর তুঘলক বংশের সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলক। অবশ্যই মোগল বাদশাহদের কুকীর্তি ধরা হয়নি এই তালিকায়। ১২৬৭ সালে আফগানিস্থানের কোনও এক রুক্ষ পার্বত্য অঞ্চলে জন্ম হয়েছিল আলি গারশাপ নামের এক তুর্কি শিশুর। পরবর্তীকালে নিজের কাকা জালালউদ্দিন খিলজির আমন্ত্রণে আলি গারশাপ এবং তার তিন ভাই আলমাস বেগ ওরফে উলুগ খান (মহম্মদ বিন তুঘলকের আসল নামও উলুগ খান ছিল তবে এরা দুজন ভিন্ন ব্যক্তি), কুতলুগ টাইগিন এবং মহম্মদ গারশপ এসে উপস্থিত হলেন দিল্লির দরবারে। এরপর ১২৯৬ সালে নিজের পিতৃসম কাকা জালালউদ্দিন খিলজিকেই নির্মমভাবে হত্যা করে তার রক্তমাখা কাটা মুণ্ডু নিজের বর্শার ফলকে গেঁথে দিল্লির দরবারে উপস্থিত হয়ে নিজেকে দিল্লির সুলতান বলে ঘোষণা করলেন আলি গারশাপ। ইতিহাসের পাতায় এই আলি গারশাপ পরিচিত হলেন সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি নামে।

মহম্মদ ঘোরী দ্বারা দিল্লি সহ উত্তর ও মধ্যভারতের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল তুর্কিদের পদানত হলেও আলাউদ্দিনের পূর্বের সুলতানদের যাবতীয় গতিবিধি সীমিত ছিল বঙ্গদেশ পর্যন্ত। আলাউদ্দিন খিলজিই প্রথম সুলতান যিনি গুপ্তচর মারফৎ সমৃদ্ধশালী দাক্ষিণাত্যের প্রাচুর্যের সন্ধান পেয়ে বিন্দ পর্বতমালা আর নর্মদা নদী অতিক্রম করে দাক্ষিণাত্যের প্রাচীন হিন্দু রাজ্যগুলির বিরুদ্ধেও লুণ্ঠন অভিযান শুরু করেন। তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধের পর থেকে আর্যাবর্তের ভূমিতে যে অভিশাপ নেমে এসেছিল, আলাউদ্দিনের শাসনকাল থেকে সেই একই অভিশাপ নেমে এলো দাক্ষিণাত্যের বুকেও।

আলাউদ্দিন খিলজির সংক্ষিপ্ত পরিচয়
===========================
তৎকালীন মধ্যযুগীয় ভারতবর্ষে আলাউদ্দিনের রণপাণ্ডিত্য যেমন সমসাময়িক হিন্দু রাজাদের চেয়ে অধিক উন্নতমানের ছিল তেমনি ধর্মান্ধতা, দুরাচারী, অত্যাচারী, নৃশংস আর বর্বরতায় আলাউদ্দিনের সমকক্ষ ছিল না আর কোন নৃপতি। এই সকল গুনের সাথে কামুক আলাউদ্দিনের ছিল আরও একটি মহৎ গুণ। অনির্বাণ নারীতৃষ্ণা। বিশেষ করে ভারতবর্ষের লাবণ্যময়ী আর রূপসী হিন্দু রমণীদের প্রতি আলাউদ্দিনের বিশেষ দুর্বলতা ছিল রীতিমত চর্চার বিষয়। এই সকল গুনগুলি একত্রিত হয়ে আলাউদ্দিনের চরিত্রকে রীতিমতো পিশাচতুল্য করে তুলেছিল। ভারতের অন্ধকারময় মধ্যযুগেও আলাউদ্দিনের ন্যায় বিশ্বাসঘাতক, নৃশংস, ইন্দ্রিয়পরায়ণ সুলতান বোধহয় তুর্কি শিবিরেও অধিক ছিল না। এমনকি কুখ্যাত মোগল বাদশাহ মহম্মদ আউরঙ্গজেবও ম্লান হয়ে যান আলাউদ্দিনের নিকটে। আপনারা সবাই সম্প্রতি চলচ্চিত্রের পর্দায় আলাউদ্দিনের চিতোরগড় অবরোধ এবং চিতোরের মহারানি পদ্মিনীর আত্মাহূতির কাহিনী দেখেছেন কিন্তু আজ আমি আরও দুই বীরাঙ্গনা রাজপুত রমণীর ইতিহাস আপনাদের শোনাবো যাদের চিতোরের রানি পদ্মাবতীর মতো সৌভাগ্য হয়নি জহরব্রত পালনের, আলাউদ্দিনের হারেমে কলঙ্কিত হয়েছে তাঁদের জীবন কিন্তু শেষপর্যন্ত এমন প্রতিশোধ নিতে সক্ষম হয়েছেন তাঁরা যেটা পারলে স্বয়ং রানি পদ্মাবতীও হয়তো গর্বিত হতেন।

রাজা কর্ণদেবের দরবারের দুই বিশ্বাসঘাতক
===============================
তখন ১২৯৮ সালের প্রথমার্ধ। ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশে সীমান্তপারের মঙ্গোলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযানে ব্যস্ত আলাউদ্দিন খিলজি। ক্রূরতা আর নৃশংসতায় তুর্কিদের চেয়ে বিন্দুমাত্র কম কিছু ছিল না বীর মঙ্গোলরা। মঙ্গোলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যখন রীতিমতো নাকানিচোবানি খাচ্ছিলেন বিখ্যাত রণপণ্ডিত আলাউদ্দিন ঠিক সেই সময় পাঞ্জাবের যুদ্ধভূমি থেকে বহুদূরে সমৃদ্ধশালী গুজরাটের আনহিলওয়ারা পট্টনের রাজধানির সিংহাসনে আসীন ছিলেন বাঘেলা বংশের অন্তিম রাজপুত নৃপতি মহারাজ কর্ণদেব। রাজা কর্ণদেবের শাসনকালে আনহিলওয়ারা, খাম্বাট, সুরাট, দ্বারকা, সোমনাথ সহ গুজরাটের একাধিক জনপদ ধনসম্পদ আর প্রাচুর্যে রীতিমত সমৃদ্ধশালী ছিল। রাজা করন্ণ দেবের সুশাসন আর বীরত্বের সাথে সাথে সমগ্র গুজরাট জুড়ে তাঁর অপরূপা রূপসী স্ত্রী মহারানি কমলাবতী দেবীর রূপ সৌন্দর্যের চর্চাও ছিল এক আলোচ্য বিষয়। মহারাজ কর্ণদেবের রাজসভায় তাঁর প্রধানমন্ত্রীর নাম ছিল মাধবরায় (রাও)। মাধবরায়ের এক পুত্র আর দুই কন্যা সন্তান ছিল। প্রধানমন্ত্রী মাধবরায়কে এতটাই বিশ্বাস করতেন রাজা কর্ণদেব যে তাঁর অনুরোধে মাধব পুত্র খেমুকে নিজের রাজকোষাগারের প্রধান হিসেব রক্ষক হিসাবে নিযুক্ত করেছিলেন। নিজের পুত্র আনহিলওয়ারার রাজকোষাগারের প্রধান হিসেব রক্ষক হিসাবে নিযুক্ত হবার কিছুকাল পরেই খল চরিত্রের প্রধানমন্ত্রী মাধবরায় তাঁর পুত্রের সাথে ষড়যন্ত্র করে তহবিলের অর্থ তছরুপ করতে শুরু করলেন। মাস খানেক এইভাবে চলার পর একদা মহারাজ কর্ণের নিকট সংবাদ এলো প্রধানমন্ত্রী আর তাঁর পুত্রের তহবিল তছরুপের। সেই সংবাদ শুনে তিনি যারপরনাই ক্রুদ্ধ হয়ে মাধব আর তাঁর পুত্রকে আজীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করলেন। এরপর চতুর মাধব মহারাজ কর্ণের নিকট অশ্রুশিক্ত চোখে যুক্তকর হস্তে তাঁদের কুকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে নিজেদের কারাদণ্ডের শাস্তি মুকুব করার প্রার্থনা করলেন এবং সেই সাথে শপথ করলেন ভবিষ্যতে আর কোনদিন এহেন কুকর্মে লিপ্ত হবেন না। রাজা কর্ণ তাঁদের কারাবাস মুকুব করলেন বটে তবে মাধব এবং তাঁর পুত্রকে রাজ্য থেকে নির্বাসিত করলেন। তবে নিজের স্ত্রী মহারানি কমলাবতী দেবীর অনুরোধে রাজা কর্ণ মাধবের স্ত্রী রূপসুন্দরী আর তাঁর পুত্রবধূ গুণসুন্দরীকে নিজের রাজপ্রাসাদেই পূর্বের মতো বসবাস করতে দিলেন।

গুজরাট ত্যাগ করবার পূর্বে মাধবের পুত্র খেমু ক্রোধের বশবর্তী হয়ে প্রতিশোধ নেবার বাসনায় কিছু বিদ্রোহী সেনাদের নিয়ে রাজা কর্ণদেবের উপর প্রাণঘাতী হামলা চালালেন। কিন্তু মাধবপুত্রের সেই চক্রান্ত ব্যর্থ হলো। এরপর ক্রুদ্ধ রাজা কর্ণদেবের নির্দেশে খেমুকে এই ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের জন্য মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হলো। রাজাকে হত্যা করবার জন্য নিজের পুত্রের দ্বারা রচিত এই চক্রান্ত সম্বন্ধে অবগত ছিলেন না মাধব। গুজরাটের উত্তরে রাজস্থানের এক নিরালা গ্রামে অজ্ঞাতবাসের সময়ে রাজা কর্ণদেবের জল্লাদ বাহিনী দ্বারা পুত্র খেমুর মৃত্যু সংবাদ পেয়ে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন মাধব। তিনি শপথ গ্রহণ করলেন গুজরাটের রাজা কর্ণদেবকে সিংহাসনচ্যুত করে পুরো গুজরাটকে ধ্বংস করে নিজের পুত্রের হত্যার প্রতিশোধ নেবেন। কিন্তু সহায় সম্বলহীন একাকি এক ব্যক্তির পক্ষে কিভাবে গুজরাটের শক্তিশালী নরেশের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহণ সম্ভব ? ভাবনা চিন্তায় রাতের ঘুম ফুড়ুৎ করে উড়ে গেল মাধবের। ঠিক এহেন সময়ে আচমকা একদিন তিনি সংবাদ পেলেন তাঁর গ্রামের অদূরে এক নগরে হামলা চালিয়েছে দিল্লির তুর্কি বাহিনী। তুর্কিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পরাজিত হয়েছে নগর ত্যাগ করে পলায়ন করেছে রাজা কর্ণদেবের সেনা বাহিনী। সেই সংবাদ শুনে মাধব হাসতে হাসতেই নিজের মনেই বলে উঠলেন, "আরে তাইতো, এতক্ষণ দিল্লির বিধর্মী আর ভিনদেশি যবনদের কথাই মাথায় আসেনি আমার। দিল্লির যবন সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি প্রবল সনাতন ধর্ম বিরোধী এবং রূপবতী হিন্দু রমণীদের প্রতি তাঁর প্রবল আসক্তির কথাও শুনেছি পূর্বে। অতএব এই মুহূর্তে দিল্লির সুলতানই হতে পারেন আম্র প্রতিশোধ পূরণের একমাত্র মার্গ।" এরপর রাজস্থানের মাউন্ট আবু, মেবার আর জয়পুর হয়ে এক বিস্তীর্ণ পথ অতিক্রম করে অবশেষে মাধব এসে উপস্থিত হলেন তুর্কিদের রাজধানি দিল্লিতে। সুলতানের কেল্লার সম্মুখে এসে তুর্কি প্রহরীদের নিজের পরিচয় দিয়ে তিনি দেখা করতে চাইলেন আলাউদ্দিন খিলজির সাথে।

আলাউদ্দিনের দরবারে বিশ্বাসঘাতক মাধব
==============================
তখন ১২৯৮ সালের মধ্যভাগ। সবেমাত্র কিছুদিন হলো মঙ্গোলদের বিরুদ্ধে এক ভয়ানক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে সাময়িক বিজয়লাভ করেছে দিল্লির তুর্কি বাহিনী। তবে সেই যুদ্ধে প্রবল ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে দিল্লির বাহিনী। নিজের বাহিনীর ভরণপোষণের জন্য ধন দৌলতের জরুরী প্রয়োজন আলাউদ্দিনের। বাঘেলা রাজপুত দ্বারা শাসিত তৎকালীন গুজরাটের প্রাচুর্যের সংবাদ কানাঘুষোয় শুনেছেন তিনি। ঠিক এইরূপ সময়েই স্বয়ং গুজরাট নৃপতির প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর আগমনের বার্তা পেয়ে যারপরনাই উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন তুর্কি সুলতান। তিনি অবিলম্বে নিজের কেল্লায় ডেকে পাঠালেন মাধবকে।

আলাউদ্দিনের দরবারে প্রবেশ করলেন এক বিশ্বাসঘাতক গুজরাটি, যার মনের অভ্যন্তরে তখন নিজের মাতৃভূমির সম্মান আর মর্যাদা রক্ষার চেয়েও অধিকমাত্রায় বিরাজমান প্রতিশোধের আগ্নেয়গিরির লাভা। মাধবের মুখে আলাউদ্দিন শুনলেন রাজা কর্ণদেবের অগাধ সম্পদ আর অতুলনীয় ঐশ্বর্যের কাহিনী। মাধব সত্য বলছে কিনা এটা যাচাই করবার জন্য সব শুনেও আলাউদ্দিন কিছুটা বিরস কণ্ঠে বলে উঠলেন, “মাশাল্লা সুভানাল্লা। তুমি যা বলছ তা যদি সত্যি হয় তাহলে সত্যিই অতুলনীয় ধন সম্পদের অধিকারী তোমার কাফের রাজা। কিন্তু এই কিছুদিন আগেই মঙ্গোলদের বিরুদ্ধে এক ভয়ানক আর দীর্ঘস্থায়ী জঙ্গ শেষ হয়েছে। এমনিতেই ওই যুদ্ধে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে দিল্লির সেনাবাহিনী, তাঁর উপর দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের শেষে সেনারাও এখন ক্লান্ত আর পরিশ্রান্ত। আনহিলওয়ারা আক্রমণ করলে রাজা কর্ণদেবের বাহিনী বিনাযুদ্ধে আত্মসমর্পণ করবে না। দুবছর পূর্বে মালওয়ার পারমার রাজ এবং দেবগিরির রামচন্দ্রদেবকে পরাজিত করবার আগে দীর্ঘ সময় ধরে তাঁদের কেল্লা অবরোধ করতে হয়েছিল। এই মুহূর্তে আরেকটা দীর্ঘকালীন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার কোন কারন এখনই দেখতে পাচ্ছি না আমি।”

সুলতান আলাউদ্দিনের এই মুহূর্তে গুজরাট আক্রমণের প্রতি অনীহা দেখে মনে মনে প্রমাদ গুনলেন মাধব। তিনি ভাবলেন তাহলে কি বিফলে যাবে আমার প্রতিশোধের আশায় এতো দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে তুর্কি রাজধানি দিল্লিতে আসা ? না না এ আমি কিছুতেই হতে দেবো না। এরপর কিছুক্ষণ চিন্তা করে তুরুপের আসল তাসটা খেললেন তিনি। মাধব সুলতানের সম্মুখে মাথানত করে বিনম্র কণ্ঠে বললেন, “হে সপ্ত সাম্রাজ্যের অধিকারী, হে দুনিয়ার মালিক মহান দিল্লির সুলতান, আপনি বোধহয় জানেন না সোনা, রূপো, হিরে, জহরত ছাড়াও রাজা কর্ণদেবের রাজপ্রাসাদে আরেক অমূল্য রত্ন রয়েছে, যার সম্বন্ধে জানলে আপনি এই মুহূর্তেই গুজরাট আক্রমণের নির্দেশ দেবেন।”

মাধবের কথা শুনে কিছুটা উত্তেজিত হয়ে আলাউদ্দিন উৎকণ্ঠিত স্বরে বলে উঠলেন, “তাই নাকি মাধব ? তা শুনি কি সেই অমূল্য রত্ন আছে তোমার কাফের রাজার কাছে ? হেয়ালি ছেড়ে জলদি সব খুলে বলো, নাহলে গর্দান যাবে তোমার।”

ওষুধে কাজ হচ্ছে বুঝতে পেরে মাধব মনে মনে হেসে উঠলেন। তারপর পুনরায় বিনম্র কণ্ঠে বলে উঠলেন, “মহামান্য সুলতান, আপনি মহারাজ কর্ণদেবের পত্নী মহারানি কমলাবতী দেবীর কথা শোনেনি মনে হয়। গুজরাটবাসী প্রজাদের নিকট রূপ এবং সৌন্দর্যে তিনি একমাত্র স্বর্গের তিলোত্তমা আর রম্ভার ন্যায় অপ্সরাদের সাথেই তুলনীয়।”

মাধবের মুখে আনহিলওয়ারা পট্টনের রূপসী মহারানির কাহিনী শুনে কিছুক্ষণের জন্য থমকে গেলেন আলাউদ্দিন। এক যৌন লালসায় লুব্ধ হয়ে উঠল স্নেচ্ছ সুলতানের মুখমণ্ডল। কিন্তু কিছুক্ষণ পর নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন সুলতান, “কিন্তু মাধব তোমার পরিবেশিত তথ্যে বিশ্বাস করবো কেন আমি ? তুমি যে মিথ্যে বলছ না তার কি প্রমান আছে ?”

উত্তরে মাধব কিছুটা ক্ষুণ্ণ কণ্ঠে বললেন, “আমার দেওয়া সংবাদ যদি মিথ্যে প্রমাণিত হয় তাহলে আপনি আমার গর্দান নেবেন সুলতান। আর গুজরাট আক্রমণ করবেন কিনা সেটা সম্পূর্ণ আপনার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত।”

আলাউদ্দিনের গুজরাট আক্রমণের সিদ্ধান্ত

===============================

এই পর্যন্ত বলে মাধব আলাউদ্দিনকে কুর্নিশ করে ফিরে যাবার জন্য অগ্রসর হতেই পেছন থেকে শুনতে পেলেন সুলতানের বজ্রগম্ভীর কণ্ঠ, “রুক যাও মাধব। গুজরাট আক্রমণ করবো আমি। তবে তোমার দেওয়া সংবাদ মিথ্যে হলে কিন্তু তোমার গর্দান যাবে।”

ওষুধে কাজ হয়েছে উপলব্ধি করতে পেরে উল্লসিত মাধব পুনরায় সুলতানের দিকে তাকিয়ে মাথা ঝুকিয়ে বিনম্র কণ্ঠে বললেন, “যে আজ্ঞে হুজুর”

-“কিন্তু গুজরাট আক্রমণ করলে রাজা কর্ণদেবের সেনারা মরিয়া হয়ে দিল্লির বাহিনীকে বাধা দেবে। অতএব আমাকে আনহিলওয়ারার কেল্লা অবরোধ করতে হবে। তার ফলে যুদ্ধের মেয়াদ হবে দীর্ঘস্থায়ী। সম্প্রতি মঙ্গোলদের বিরুদ্ধে এক দীর্ঘস্থায়ী জঙ্গ শেষ হয়েছে। এই মুহূর্তে আমি আর একটা দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে যেতে অনিচ্ছুক। যুদ্ধ জলদি খতম করবার জন্য তুমি আমাকে কিভাবে সাহায্য করবে বলো ?” বজ্র কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন আলাউদ্দিন।

জবাবে মাধব স্মিত হাসিমুখে বলে উঠলেন, “সে আপনি কোন চিন্তা করবেন না হুজুর। আমরা বংশানুক্রমিক ভাবে আনহিলওয়ারার রাজপরিবারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে এসেছি। রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তরে প্রবেশ করবার প্রতিটা গুপ্ত মার্গ আমার নখদর্পণে। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি দ্রুত সাঙ্গ হবে আপনার গুজরাট বিজয় পর্ব, এবং আপনার হারেমের শোভা বর্ধন করবেন শয়তান কর্ণদেবের স্ত্রী মহারানি কমলাবতী দেবী”

এই সাক্ষাৎকার পর্বের পর গুজরাট আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেন আলাউদ্দিন খিলজি। আলাউদ্দিনের পরিকল্পনা অনুযায়ী ঠিক হলো তিনি নিজে এক বিশাল সেনা সমেত আনহিলওয়ারা কেল্লার বাইরে একটি অপেক্ষাকৃত নিরাপদ স্থানে অবস্থান করবেন এবং আলাউদ্দিনের বিশ্বস্ত সেনাপতি আর তাঁর ভাই উলুগ খান গভীর রাতে আরেকটি ক্ষুদ্র বাহিনী নিয়ে মাধবের সাথে গুপ্তপথে আনহিলওয়ারার কেল্লা প্রাসাদে অনুপ্রবেশ করে আচমকা আক্রমণ করে ঘুমন্ত রাজা কর্ণদেবকে হত্যা করে রানি মহলে প্রবেশ করে তাঁর স্ত্রীকে অপহরণ করবেন।

রাজা কর্ণদেবের কন্যা সন্তান লাভ
========================

এদিকে ততদিনে দিল্লি থেকে বহুদূরে গুজরাটের আনহিলওয়ারার রাজপ্রাসাদেও ঘটেছে একটি পরিবর্তন। মহারাজ কর্ণদেব এবং রানি কমলাবতী দেবী লাভ করেছেন একটি ফুটফুটে সুন্দর কন্যা সন্তান। রাজকুমারীর জন্মের পর দেখতে দেখতে প্রায় এক বছর অতিবাহিত হয়েছে। আর সপ্তাহ খানেক পরেই শিশু রাজকুমারীর অন্নপ্রাশন এবং নামকরণ উৎসব। সেই উৎসব উপলক্ষে বিগত কয়েকদিন ধরেই রাজপ্রাসাদ জুড়ে চলছে উৎসবের প্রস্তুতি। সমগ্র আনহিলওয়ারা নগর জুড়ে উৎসবের আবহ। গোপন সূত্রে সেই সংবাদ পেয়ে চতুর মাধব, যবন সুলতান আলাউদ্দিনের সাথে শলা পরামর্শ করে সেই উৎসবের রাতেই রাজা কর্ণদেবের রাজপ্রাসাদ আক্রমণ করার পরিকল্পনা করলেন।

দেখতে দেখতে এসে গেলো সেই দিন। গুজরাটের মহারাজ কর্ণের শিশুকন্যার নামকরণ আর অন্নপ্রাশনের উৎসবে মেতে উঠল পুরো রাজপরিবার। রাজপ্রাসাদ জুড়ে সেদিন ঢালাও নিমন্ত্রণ ছিল পুরো আনহিলওয়ারার প্রজাদের। যজ্ঞের পর রানি কমলাবতী দেবী তাঁর শিশুকন্যার নামকরণ করলেন দেবালা। রাজপুরোহিত অর্ধ প্রস্ফুটিত গোলাপ ফুলের মতো ফুটফুটে সেই শিশুকন্যার দিকে কিছুক্ষণ স্নেহভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে হটাতই মন্দ্র কণ্ঠে রাজা আর রানির উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন, “আপনাদের কন্যা, বীরাঙ্গনা রাজকুমারী দেবালা কোন রকম অস্ত্র ধারণ না করেই অদূর ভবিষ্যতে সৃষ্টি করতে চলেছেন এমন এক রোমাঞ্চকর ইতিহাস, যার জন্য গর্ব অনুভব করবে সমগ্র রাজপুতানা।”

কর্ণদেবের রাজপ্রাসাদে তুর্কিদের হামলা
============================
দেখতে দেখতে সন্ধ্যে নামলো। পশ্চিম দিগন্তের দিকচক্রবালে সূর্যাস্ত হলো। উৎসব মুখর আনহিলওয়ারার রাজপুরীর চতুর্দিকে প্রজ্বলিত হলো অসংখ্য মৃৎ প্রদীপ আর মশাল। রাতের আধার আরেকটু ঘন হতেই রাজপ্রাসাদের পশ্চাৎপ্রান্তে রানি মহলের পিছন দিকের প্রাকারের সম্মুখে একটি জঙ্গলাকীর্ণ অঞ্চলে হটাতই দেখা গেলো মাধবের স্ত্রী রূপসুন্দরীকে একাকিনী একটি মশাল হাতে উপস্থিত হতে। প্রাকারের সম্মুখে এসে তিনি কিছুক্ষণ এদিক-অদিক চেয়ে দেখলেন। যখন রূপসুন্দরী নিশ্চিত হলেন যে রাজঅন্তঃপুরের কেউ তাঁকে অনুসরণ করছে না এবং সবাই রাজকুমারী দেবালা দেবীর অন্নপ্রাশনের অনুষ্ঠানে ব্যস্ত তখন তিনি প্রাকারের উপর উঠে জ্বলন্ত মশালটি নিজের মাথার উপর তুলে দুই প্রান্তে আটবার ঘোরালেন। এদিকে প্রাকারের বাইরে তুর্কি সেনাপতি উলুগ খানের সাথে অপেক্ষারত মাধব নিজের স্ত্রীর সংকেত পেয়েই উলুগ খানের দিকে তাকিয়ে নিচু কণ্ঠে বলে উঠলেন, “প্রস্তুত হয়ে নিন হুজুর, সময় হয়ে গেছে আনহিলওয়ারার রাজপুরীতে প্রবেশ করে শয়তান কর্ণদেবকে তাঁর পাপের উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করার।”

এরপর মাধবের দেখানো গুপ্ত সুরঙ্গপথে নিঃশব্দে অনুপ্রবেশ করল উলুগ খান আর তাঁর অধীনস্ত তুর্কি ঘাতক বাহিনী। কিছুক্ষণ পরেই বিনা বাধায় রাজা কর্ণদেবের রাজপুরীর অভ্যন্তরে প্রবেশ করলো তুর্কি সেনা। রাজপ্রাসাদের মধ্যেই ভৈরব কণ্ঠে উঠলো গর্জন, “আল্লাহ-আকবর”। ফের শুরু হলো সেই চির পুরাতন বেদনা বিধুর কাহিনী। তুর্কি ঘাতকদের তীক্ষ্ণ তরবারি আর ভল্লের আঘাতে শত শত নিরীহ আর নিরস্ত্র হিন্দু প্রজাগণের রক্তে শিক্ত হলো আনহিলওয়ারার কেল্লা-প্রাসাদ। এই আচমকা আক্রমণে সম্পূর্ণ দিশাহারা হয়ে পড়লো রাজপুরীর অপ্রস্তুত রক্ষীরা। দিশাহারা হয়ে পড়লেন স্বয়ং রাজা কর্ণদেব। রক্ষীদের পরামর্শ মেনে তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন অবিলম্বে রানি কমলাবতী এবং ছোট্ট রাজকুমারী দেবালাকে নিয়ে আনহিলওয়ারার প্রাসাদ পরিত্যাগ করে আপাতত কোন নিকটবর্তী নিরাপদ স্থানে পলায়ন করবেন তারপর অন্য কোন মিত্র রাজ্যের আশ্রয় গ্রহণ করে পুনরায় সেনাবাহিনী সংগঠিত করে বর্বর তুর্কিদের পাপের উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করবেন। কিন্তু বিধি বাম। রাজা কর্ণদেব তাঁর শিশুকন্যার সন্ধান পেলেও নিজের রানিকে খুঁজে পেলেন না। ওই চরম বিশৃঙ্খল পরিবেশে কোথায় মহারানির সন্ধান করবেন সেটাও বুঝতে পারছিলেন না অসহায় রাজা কর্ণদেব।
#Subhojit_Roy
আনহিলওয়ারাপট্টনের কেল্লা প্রাসাদে মৃত্যুর উৎসব
===================================
নিজের শিশু রাজকন্যার অন্নপ্রাশনের অনুষ্ঠানে যখন ব্যস্ত ছিলেন মহারাজ কর্ণদেব আর রানি কমলাবতী ঠিক সেই সময় কেল্লার পশ্চাৎদেশে একটি ভগ্নপ্রাপ্ত নির্জন স্থানে মশাল হাতে একাকি দাঁড়িয়েছিলেন এক ব্যক্তি। ভাল করে লক্ষ্য করলে বোঝা যায় যে এই ব্যক্তি কোন পুরুষ নন। একজন মধ্য তিরিশ বয়সের রমণী। ইনিই কুচক্রী প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মাধবরায়ের অর্ধাঙ্গিনী রূপসুন্দরীদেবী। তাঁর দুচোখেও তখন প্রতি হিংসার জ্বলন্ত অঙ্গার। অবশেষে ধিরে ধিরে সন্ধ্যা নামলো। রূপসুন্দরী তাঁর জ্বলন্ত মশালের আলোকমালা ঘুরিয়ে কেল্লার বাইরে অপেক্ষারত মাধবরায় আর তুর্কি লুণ্ঠক বাহিনীকে ইশারা করলেন কেল্লায় অনুপ্রবেশ করবার। এর কিছুক্ষণ পরেই আনহিলওয়ারার কেল্লা প্রাসাদের অভ্যন্তরে শুরু হলো যবন তুর্কিদের কাফের নিধন যোগ্য। রাজকুমারী দেবালার অন্নপ্রাশনের আনন্দ অনুষ্ঠান পরিণত হলো এক নিষ্ঠুর মৃত্যু উৎসবে। এদিকে সারাদিন নিজের একমাত্র কন্যার অন্নপ্রাশনের অনুষ্ঠানে ব্যস্ত ছিলেন আনহিলওয়ারার মহারানি কমলাবতী। সন্ধ্যে নামবার পর রাজপুরীর মূল অনুষ্ঠান ছেড়ে তিনি ধির পদক্ষেপে রওনা দিলেন অন্দরমহলের রানি নিবাসে দৈনিক সান্ধ্যপূজার কার্য সম্পন্ন করতে। আলাউদ্দিন খিলজির সভাকবি আমির খুস্রু, জিয়াউদ্দিন বার্নি, প্রবন্ধ চিন্তামণির লেখক মেরুতুঙ্গা, কন্নড়াদেব প্রবন্ধ কাব্যগ্রন্থের লেখক পদ্মনাভ সহ একাধিক সমসাময়িক লেখকদের মতে অপরূপা রূপসী ছিলেন রানি কমলাবতী। তৎকালীন সমাজের নিয়মানুসারে খুব কম বয়সেই রাজা কর্ণের সাথে বিবাহ সম্পন্ন হয়েছিল তাঁর। এই ঘটনা যখন ঘটছে তখন তিনি খুব বড়জোর সপ্তদশ কি অষ্টাদশ বর্ষীয়া এক যুবতী। রানি কমলাবতী দেবীর রূপ আর লাবণ্যের ছটায় ছিল অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। আমির খুস্রুর মতে তাঁর রূপের তুলনা চলতে পারে একমাত্র পূর্ণিমার রাতে উদীয়মান চন্দ্রমার সাথে। যদিও বিখ্যাত বাঙালি লেখক শ্রী শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর কল্পনা মিশ্রিত ঐতিহাসিক গল্প “শঙ্খ কঙ্কণ” এ রানি কমলাবতীদেবীকে এক নষ্টা চরিত্রের নারী হিসাবেই বর্ণনা করেছেন। হয়তো সমকালীন কংগ্রেসী আর বামপন্থী মনভাবাপন্ন ঐতিহাসিকদের ইতিহাস বিকৃতি আর সঠিক তথ্যের অভাবেই তিনি একজন আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন স্বাভীমানী রাজপুত রমণীর চরিত্র সম্বন্ধে না জেনেই এহেন বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন। ব্রিটিশ আমলের গুজরাটি ঐতিহাসিক শ্রী নন্দশঙ্কর মেহেতা গুজরাটি ভাষায় লেখা তাঁর ঐতিহাসিক গ্রন্থগুলোতেও সঠিকভাবে বর্ণনা করেছেন তুর্কি হারেমে বন্দিনী মহারানি কমলাবতী আর রাজকুমারী দেবালার দুঃখ কষ্টে জর্জরিত বেদনা বিধুর জীবন কাহিনীর আসল ঐতিহাসিক বর্ণনা।
বিশ্বাসঘাতকদের কবলে আক্রান্ত বাঘেলা মহারানি
==================================
আনহিলওয়ারার অন্দরমহলের অবস্থিত রাজ সরোবরে অবগাহন পর্ব সম্পন্ন করে শ্বেত শুভ্র বস্ত্র পরিহিত হয়ে প্রাসাদ সংলগ্ন মন্দিরে প্রবেশ করে দৈনিক পূজো সম্পন্ন করলেন। ঈশ্বরের নিকট নিজের স্বামী এবং রাজকুমারীর মঙ্গল কামনা করে সখী পরিবৃতা হয়ে সবে মন্দিরের বাইরে পদস্পর্শ করেছেন এমন সময় অদূরেই শুনতে পেলেন তীব্র কণ্ঠের “আল্লাহ-আকবর” গর্জন ধ্বনি আর সেই সাথে অসংখ্য পুরুষ আর নারী কণ্ঠের হাহাকার, কাতর আর্তনাদ আর ক্রন্দন ধ্বনি। রাজপ্রাসাদের বহির্বিভাগ থেকে আর্তনাদ আর হাহাকার ধ্বনি শুনে আতঙ্কে এবং শঙ্কায় শিউড়ে উঠলেন রানি কমলাবতী। কি ঘটছে তা জানবার জন্য তিনি যখন তাঁর বিশ্বস্ত দুই সখীকে নির্দেশ দিতে যাবেন ঠিক সেই সময় দ্রুতবেগে মন্দিরের সম্মুখে এসে উপস্থিত হলেন মাধব পুত্র প্রয়াত খেমুর স্ত্রী গুণসুন্দরী দেবী। তিনি এসেই সন্ত্রস্ত ও কম্পিত কণ্ঠে বলে উঠলেন, “সর্বনাশ হয়েছে মহারানি। দিল্লির স্মেচ্ছ লুণ্ঠক সেনারা গুপ্তপথে প্রাসাদ কেল্লায় অনুপ্রবেশ করে আচমকা আক্রমণ করেছে।”
গুণসুন্দরীর মুখে এই ভয়াবহ সংবাদ শুনে কিছুক্ষণের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন বাঘেলা রানি কমলাবতী। তারপর তিনি প্রাথমিক বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা করলেন, “আমাদের রাজপ্রাসাদ ঘৃণ্য তুর্কি স্মেচ্ছদের দ্বারা আক্রান্ত। বর্বর তুর্কিদের হাত থেকে নিজেদের সম্মান আর সম্ভ্রম রক্ষার জন্য অবিলম্বে জহরব্রতের ব্যবস্থা করুন। আমরা রাজপুত রমণীরা অগ্নি দেবের কোলে নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দেবো কিন্তু স্মেচ্ছ তুর্কিদের হাতে বন্দি হয়ে ধর্ম আর সম্মান হারিয়ে তাদের হারেমে রক্ষিতার জীবন-যাপন করবো না। রাজকুমারী কোথায় ? ওকেও নিয়ে আসুন এখানে।”
মহারানি কমলার মুখে জহরব্রত আয়োজনের নির্দেশ শুনে ভগ্ন কণ্ঠে গুণসুন্দরী দেবী বললেন, “এখন তা আর সম্ভব নয় মহারানি। ধূর্ত তুর্কিরা রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই রাজঅন্তঃপুরেও প্রবেশ করবে শয়তান তুর্কিরা। এখন আর জহর পালনের সময় নেই। এর চেয়ে আপনার পক্ষে অধিকতর উচিত কার্য হবে তুর্কিদের নজর এড়িয়ে প্রাসাদের পূর্ব প্রান্তের গুপ্ত সুড়ঙ্গ পথ দিয়ে পলায়ন করে আপাতত দেবগিরি বা অন্য কোন নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেওয়া। ইতিমধ্যেই মহারাজ নিজেও রাজকুমারীকে নিয়ে প্রাসাদ ত্যাগ করে গুপ্তপথে পলায়ন করেছেন। যাবার পূর্বে তিনি আমাকে নির্দেশ গিয়ে গিয়েছেন আমি যেন আপনাকে নিয়ে দেবগিরি রাজ্যে পলায়ন করি। সেখানেই তিনি আমাদের জন্য অপেক্ষা করবেন।”
এদিকে তুর্কি আক্রমণকারীদের তর্জন গর্জন দাবানলের ন্যায় ক্রমশ এগিয়ে আসছিল রাজঅন্তঃপুরের দিকে। গুণসুন্দরীর কথামতো হতবুদ্ধি রানি কমলা তাঁর কয়েকজন প্রিয় সখীকে নিয়ে প্রাসাদের পূর্ব প্রান্তে যাত্রা করলেন। পূর্ব প্রান্তের সুড়ঙ্গ পথের প্রবেশদ্বারের সম্মুখে এসে উপস্থিত হতেই রানি কমলা আচমকা দেখতে পেলেন নিকষ আধারের বুক চিরে জ্বলন্ত মশাল হাতে এগিয়ে আসছে এক ছায়ামূর্তি। ছায়ামূর্তিটি নিকটে আসতেই বাঘেলা মহারানি চিনতে পারলেন তাঁকে। ইনি প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মাধবের পত্নী রূপসুন্দরী দেবী। এই ঘোর বিপদের মুখে নিজের পতি আর কন্যার সাথে বিচ্ছিনা রানি কমলা দ্রুতগতিতে এসে আবেগপূর্ণ ভাবে জড়িয়ে ধরলেন নিজের মাতৃসম গুণসুন্দরী দেবীকে। বাষ্পরুদ্ধ ক্ষীণ কণ্ঠে কোনমতে জিগ্যেস করলেন, “মহারাজ আর রাজকুমারী কোথায় ? ওরা ঠিক আছেন তো ?”
রূপসুন্দরী মৃদু কণ্ঠে বললেন, “ওরা নিরাপদেই আছেন মহারানি। কিন্তু আর আপনি কখনও তাঁদের দেখা পাবেন না। মহারাজ আর রাজকুমারীর সাথে আপনার অন্তিম সাক্ষাৎ সম্ভবত আজ সকালের অনুষ্ঠানেই সম্পন্ন হয়েছে।”
-“কেন আর তাঁদের দেখা পাবো না কেন কখনও ?” বিস্ময়ভরা কণ্ঠে জিগ্যেস করলেন রানি কমলা।
-“তাঁর কারন মহারাজ তাঁর রাজকুমারীকে নিয়ে দেবগিরির উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছেন আর আপনাকে এখন যাত্রা করতে হবে স্মেচ্ছ তুর্কিদের রাজধানি দিল্লির উদ্দেশ্যে।” শান্ত হিমশীতল কণ্ঠে বললেন রূপসুন্দরী।
এরপরেই মহারানি কমলাবতী আচমকা দেখতে পেলেন অন্ধকার ফুঁড়ে তাঁর দিকে এগিয়ে আসছে একাধিক মশালের আলো। ক্রমে তিনি দেখলেন তাঁকে আর তাঁর সখীদের চতুর্দিক দিয়ে বেষ্টন করেছে একাধিক সসস্ত্র তুর্কি সেনা। এরপর তুর্কি সেনাদের বেষ্টনির মধ্যে থেকে আত্মপ্রকাশ করলেন স্বরযন্ত্রী মন্ত্রী মাধবরায়। আলো আধারিতে তাঁর দুচোখ তখন নেকড়ের মতো জ্বলছে আর তাঁর মুখে ধূর্ত শৃগালের ন্যায় ক্রূর হাসি।
-“একি এসব কি ? আপনি এখানে উপস্থিত হলেন কি করে আর স্মেচ্ছরাই বা কোন উপায়ে আমাদের পলায়ন পথের সন্ধান পেলো ?” অসহায়ভাবে বিস্মিত কণ্ঠে জিগ্যেস করলেন মহারানি কমলা।
-“আপনাকে বন্দি করে তুর্কি সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির হারেমে পেশ করবার জন্য ওদের আমিই আমন্ত্রণ করে এনেছি মহারানি। আর আমাকে এই কাজে যোগ্য সহায়তা করেছে আমার অর্ধাঙ্গিনী আর প্রয়াত পুত্রবধু” সর্পের ন্যায় হিমশীতল কণ্ঠে বললেন মাধবরায়।
-“শয়তান, নিচ, কেন নিজেরই মাতৃভূমির সাথে এরকম বিশ্বাসঘাতকতা করলেন আপনি ? বহুদিন পূর্বে আপনার ষড়যন্ত্রে ক্রুদ্ধ মহারাজ যখন আপনাকে সপুত্রক আজীবন কারাবাসে দণ্ডিত করেছিলেন তখন আমিই মহারাজকে অনুরোধ করে আপনাদের শাস্তি লাঘব করি। এরপর মহারাজ আপনাকে বহিষ্কৃত করলেও আপনার স্ত্রী আর পুত্রবধূর অসহায়তার কথা চিন্তা করে রাজপুরীর অন্দরমহলে আগের মতোই স্বাধীনভাবে থাকতে দেই তাঁদের। এতকিছুর পরেও আপনাদের বিশ্বাস করেছিলাম আমি। আর আজ তার প্রতিদান দিলেন এইভাবে। এই পাপ কাজের জন্য ঈশ্বর কোনদিন ক্ষমা করবেন না আপনাদের।” অশ্রুশিক্ত চোখে বাস্পরুদ্ধ কণ্ঠে কোনমতে কথাগুলি বলে আত্মহত্যা করবার অন্তিম প্রয়াস হিসাবে নিজের বস্ত্রের ভেতরে লুকনো বিষের পাত্র বের করলেন মহারানি কমলাবতী, এবং মুহূর্তের মধ্যেই পান করলেন সেই পাত্রের মধ্যেকার তরল পানীয়টি।
এই দৃশ্য দেখেই হাহাকার করে উঠলেন মাধবরায়। শেষপর্যন্ত এইভাবে তিরে এসেও তরি ডুবলো। কিন্তু মাধবকে বিস্ময়ে হতবাক করে দিয়ে একসাথে খিল খিল করে হেসে উঠলেন তার স্ত্রী রূপসুন্দরী আর পুত্রবধূ গুণসুন্দরী। মাধব তিক্ত কণ্ঠে বলে উঠলেন, “মহারানি বিষপান করলেন আর তোমরা হাসছ ? অপদার্থ কোথাকার। আমি এখন কি জবাব দেবো সুলতানকে ?”
-“মহারানির পাত্রে বিষ নেই। আগেই পাত্রের বিষ বদলে ওতে বিশুদ্ধ পানীয় জল ভরে রেখেছি আমি। আমার পুত্র খেমুকে চিরতরে হারিয়েছি আমি শুধুমাত্র মহারাজ কর্ণসিংহের কারণে। আমার হৃদয়য়ের প্রতিশোধের জ্বালা তোমার চেয়ে কোন অংশে কম নয়” হাসি থামিয়ে শান্ত কণ্ঠে বললেন রূপসুন্দরী।
আলাউদ্দিনের শিবিরে রানি কমলাবতী আর মালিক কাফুর
=========================================
এরপর যা হবার তাই হলো। রানি কমলাবতী অসহায়ভাবে দেখতে পেলেন এক কুৎসিত দর্শন ছাগ দাড়িওয়ালা বিশালদেহী পাঠান যুবা এগিয়ে এলেন তাঁর নিকটে। তিনি অন্তিমবারের জন্য মাধব পত্নীর দিকে শিক্ত চোখে তাকিয়ে ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন, “একজন সতি সাধ্বী রাজপুত রমণী হিসাবে আপনাকে অভিশাপ দিলাম আমি, অতি শীঘ্রই আপনার এই কুকর্মের উপযুক্ত শাস্তি পাবেন আপনি এবং আপনার অবশিষ্ট পরিবার”। এদিকে সেই বিশালদেহী তুর্কি যুবা বাঘেলা রানির সম্মুখে এসে তাঁর দিকে তাকিয়ে ক্রূর হাসিমুখে বললেন, “বাঘেলা রানি সাহেবাকে তুর্কি সেনাপতি উলুগ খানের সেলাম।” এরপর উলুগ খান মহারানি কমলাবতীর হাত ধরে তাঁকে বলপূর্বক রাজপ্রাসাদ থেকে বের করে নিয়ে এলেন বাইরে অপেক্ষারত তুর্কি শিবিরে। পেশ করলেন ক্ষুধার্ত বাঘের ন্যায় অধৈর্য আগ্রহে শিবিরে অপেক্ষারত আলাউদ্দিনের সম্মুখে। বন্দি বাঘেলা মহারানির অপরূপ সৌন্দর্য দর্শন করে লালসার অগ্নি স্ফুলিঙ্গ দেখা গেল আলাউদ্দিন খিলজির দুচোখে। কিন্তু এখনও তিনি শত্রুদেশে যুদ্ধভূমিতে। অতএব বহু কষ্টে নিজের বিকৃত যৌন বাসনাকে নিয়ন্ত্রণ করলেন তিনি। এদিকে পরেরদিন প্রত্যূষে গুজরাটের দক্ষিণপ্রান্তে অবাধ লুণ্ঠন আর কাফেরদের গণহত্যা পর্ব সাঙ্গ করে ফিরে এলেন আরেক তুর্কি সেনাপতি নুসরাত খান। সুলতানের পদতলে সমর্পণ করলেন অগাধ লুণ্ঠিত ধন সম্পদ আর সেই সাথে পেশ করলেন আরেকটি বিস্ময়কর উপহার। নুসরত খানের নির্দেশে দুজন তুর্কি রুক্ষি খিলজির সম্মুখে পেশ করলো লৌহ শৃঙ্খলে আবদ্ধ এক অতি সুন্দরকান্তি যুবককে। বিস্মিত আলাউদ্দিন সেই অজ্ঞাত কুলশীল যুবকের পরিচয় জানতে চাইলে নুসরত খান মৃদু হাস্যমুখে বললেন, “মাননীয় সুলতান হজরত, আপনার চিত্ত বিনোদনের জন্য গুজরাটের খাম্বাট শহরের এক ধনী খোঁজার নিকট থেকে এক হাজার স্বর্ণদিনার দিয়ে এই যুবাকে ক্রয় করেছি আমি। এর নাম মালিক কাফুর। সেই খোঁজার মতে চিত্ত বিনোদনের হরেক রতি ক্রিয়ার সাথে সাথে যুদ্ধ পরিচালনা আর বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র চালনাতেও যথেষ্ট পারদর্শী এই ক্রীতদাস।”
খুশি হয়ে আলাউদ্দিন উল্লসিত কণ্ঠে বলে উঠলেন, “বহৎ খুব। এবারে দিল্লি ফেরার ব্যবস্থা করো।”
তুর্কিদের সোমনাথ লুণ্ঠন আর দিল্লি প্রত্যাবর্তন
=================================
এরপর গুজরাটের বন্দি মহারানি কমলাবতী দেবীকে একটি বিশাল হস্তি পৃষ্ঠে চাপিয়ে বিজয় গর্বে সসৈন্যে দিল্লির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলো তুর্কি বাহিনী। পথে পড়লো প্রভাস পট্টনের সুপ্রাচীন সোমনাথ দেবালয়। সেই মন্দিরও অবাধে লুণ্ঠন করে মন্দিরে রক্ষিত যাবতীয় ধনরত্ন সহ সোমনাথ জ্যোতিঃরলিঙ্গ অপহরণ করলেন। এরপর রণথম্বরের নৃপতি মহারাজ হামীরদেব চৌহান আর জালোরের নৃপতি কন্নড়দেব চৌহানের মিলিত বাহিনীর সাম্ভাব্য আক্রমণের আশঙ্কা করে নিজের বাহিনীকে দুই ভাগে বিভক্ত করে উলুগ খানকে সোমনাথ মন্দিরের জ্যোতিঃরলিঙ্গ বহনের দায়িত্ব অর্পিত করে কাপুরুষ আলাউদ্দিন নিজে রানি কমলাবতীকে সহ তুর্কি বাহিনীর দ্বিতীয় দলটি নিয়ে ঘুরপথে যাত্রা করলেন দিল্লির উদ্দেশ্যে (এই যুদ্ধের বিস্তারিত বিবরণ রণথম্বরের বাঘ হামীরদেব চৌহান পর্বে দেওয়া হয়েছিল)। ওদিকে সর্বশ্রান্ত হয়ে নিজের শিশু রাজকুমারী দেবালা দেবীকে নিয়ে বহুকষ্টে তুর্কি ঘাতকদের নজর এড়িয়ে এক সর্বহারা ভিক্ষুকের ন্যায় নিজের পুরাতন মিত্র রাজা রামচন্দ্র যাদবের রাজধানি দেবগিরিতে আশ্রয় গ্রহণ করলেন ভাগ্যবিড়ম্বিত গুজরাট নৃপতি কর্ণদেব বাঘেলা।
বিশ্বাসঘাতকদের পরিণতি
==================
দেবগিরিতে আশ্রয় লাভ করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন রাজা কর্ণদেব। দেবগিরি নরেশ রামচন্দ্র তাঁকে আশ্বস্ত দান করে সবরকম সাহায্যের প্রতুস্রুতি দিলেন। কিন্তু সহায় সম্বলহীন রাজা কর্ণদেব জানতেন না যে এখানেও তাঁর পরম মিত্রের অন্তরালে লুকিয়ে রয়েছে আরেক চরম বিশ্বাসঘাতক। এদিকে ফল ফলল রানি কমলাবতীর অভিশাপের। বিভিন্ন পুস্তকে কথিত আছে সেদিনের ঘটনার মাত্র কিছুকাল পরেই বজ্রপাতে মৃত্যু হয়েছিলো বিশ্বাসঘাতক মন্ত্রী মাধবরায়ের। তাঁর পুত্রবধূকেও বন্দি করে চালান করা হয়েছিল তুর্কি হারেমে এবং এই মানসিক আঘাত সহ্য করতে না পেরে আত্মঘাতী হয়েছিলেন মাধবের স্ত্রী।
#Subhojit_Roy
স্মেচ্ছদের রাজধানিতে গুজরাটের মহারানি
==============================
দীর্ঘ যাত্রার পর অবশেষে নিরাপদে স্বসৈন্যে দিল্লি প্রত্যাবর্তন করলেন তুর্কি সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি। দিল্লি পৌঁছে তিনি সেনাপতি উলুগ খানের নিকট সংবাদ পেলেন যে মাঝপথে রণথম্বরের মহারাজ হামীরদেব চৌহান আর জালরের মহারাজ কন্নড়দেব চৌহানের মিলিত রাজপুত বাহিনীর আচমকা হামলায় শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছে উলুগ খানের নেতৃত্বাধিন তুর্কি সেনা। রাজপুত বাহিনী সোমনাথ মন্দির থেকে লুণ্ঠিত অধিকাংশ রত্নসামগ্রী ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছে আর সেই সাথে নিয়ে গেছে সোমনাথ মন্দিরের পবিত্র জ্যোতির্লিঙ্গটিও। এই দুঃসংবাদ শুনে খিলজি প্রথমে নিদারুণ ক্রুদ্ধ হলেও পরে আনহিলওয়ারাপট্টনের অপরূপা সুন্দরী হিন্দু মহারানিকে হরণ আর মালিক কাফুরকে লাভের কথা চিন্তা করে নিজেকে আশ্বস্ত করলেন।
এদিকে দিল্লি পৌঁছনোর পর প্রাথমিকভাবে বন্দি বাঘেলা রানি কমলাবতীকে নিয়ে আসা হলো দিল্লির শতাব্দী প্রাচীন লালকোট কেল্লা প্রাসাদে। তরাইনের ঐতিহাসিক দ্বিতীয় যুদ্ধের পূর্বে এই লালকোট কেল্লাতেই বসবাস করতেন সম্রাট পৃথ্বীরাজ চৌহান। পৃথ্বীরাজের পরাজয়ের পর এই কেল্লা প্রাসাদ তুর্কিদের অধিকারে আসে এবং তারপর থেকে তুর্কি সুলতানরা লালকোট কেল্লাতেই বসবাস শুরু করেন। যদিও আলাউদ্দিন পরবর্তীকালে সিরির কেল্লা প্রাসাদ নির্মাণ করেন এবং দিল্লিতে তাঁর বহু চর্চিত সুবিশাল হারেমের অবস্থান ওই সিরির কেল্লা প্রাসাদেই ছিল।
দীর্ঘ পথযাত্রার পর অবশেষে দিল্লির লালকোট কেল্লা প্রাসাদের মূল প্রবেশ দ্বারের সম্মুখে এসে উপস্থিত হলেন বন্দিনী রানি কমলাবতী। কেল্লার প্রবেশদ্বার থেকে পুরুষ তুর্কি রক্ষিদের পরিবর্তে রানি কমলার নজরদারির দায়িত্ব নিল মহিলা হাবসি রক্ষিণীরা। তৎকালীন রাজপুত শাসিত রাজ্যগুলিতেও রাজপ্রাসাদের অন্দরমহলের রানি নিবাসের সুরক্ষার দায়িত্ব থাকতো মূলত নারী রক্ষীবাহিনীর উপরই। কিন্তু রানি কমলা লক্ষ্য করলেন হাবসি রমণীদের শারীরিক গঠন সম্পূর্ণ ভিন্নধরনের। রূপ-সৌন্দর্য এবং কোমলতায় তুর্কি রমণীরা রাজপুত নারীদের ধারেকাছেই আসবে না। এদের চোখে-মুখে বিরাজ করছে এক অদ্ভুত ধরনের রুক্ষতা আর কাঠিন্য। এছাড়াও রাজপুত রমণীদের চেয়ে অধিকতর দীর্ঘাঙ্গী এরা। স্মেচ্ছ রমণীদের পরনের পোশাক এবং আচার-আচরণও সম্পূর্ণ অন্যরকম। তৎকালীন যুগের রাজপুত এবং হিন্দু রমণীগণ মূলত মহার্ঘ্য বস্ত্রখণ্ড দ্বারা নির্মিত শাড়ি এবং কাঁচুলি জাতীয় অন্তর্বাসের সাথে দোপাট্টা জাতীয় উত্তরীয় পরিধান করতেন। সেইসাথে স্বর্ণ নির্মিত কোমরবন্ধ, মুক্ত খচিত কণ্ঠহার মুক্তবতী, বাহুবন্ধনী কায়ুরা, কুণ্ডলা, কিঙ্কিণী, মেখলা এবং নুপুর জাতীয় দামি গহনায় নিজেদের সজ্জিত রাখতেন। কিন্তু স্মেচ্ছ তুর্কি রমণীদের পরনের বেশভূষা সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রাসাদের বেগম মহলের তুর্কি রমণীদের পরিধানে মূলত পেশওয়াজ, চুড়িদার, সালওয়ার-কামিজ। এমনকি এদের পরিধানের অলঙ্কারও ভিন্ন রকমের। কোন কাজে বেগম মহলের বাইরে যেতে হলে স্মেচ্ছ রমণীগণ নিজেদের আপাদমস্তক কৃষ্ণকায় বোরখা দ্বারা আচ্ছাদিত রাখে।
হাবসি রক্ষিণী দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে একসময় গুজরাটের হতভাগ্য মহারানি কমলাবতী এসে উপস্থিত হলেন বেগমমহলের শেষপ্রান্তে এক সুবিশাল সুসজ্জিত কক্ষে। কক্ষের ভেতরে তাঁকে অপেক্ষা করবার নির্দেশ দিয়ে কুর্নিশ করে বেরিয়ে গেলেন রক্ষিণীরা। যাবার সময় কক্ষের দ্বার বাইরে থেকে বন্ধ করে দিয়ে গেলেন। বেগমমহলের জনশূন্য কক্ষে একাকি রানি কমলা একটি পালঙ্কের উপর বসে একাকি অসহায়ভাবে অপেক্ষা করতে লাগলেন নিজের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের উদ্দেশ্যে। অপেক্ষা করতে করতেই একসময় তিনি হারিয়ে গেলেন নিজের ফেলে আসা অতীতের সোনালি দিনগুলিতে। মনশ্চক্ষে তিনি নিজেকে দেখতে পেলেন আনহিলওয়ারাপট্টনের রাজপুরীর অন্দরমহলে সখী পরিবৃত হয়ে ছোট্ট শিশু রাজকুমারীকে কোলে নিয়ে মহারাজ কর্ণ সিংহের সাথে একান্ত প্রেমালাপে। অতীতের কথা চিন্তা করতে করতেই একসময় তাঁর দুচোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলো, চোখের পাতা শিক্ত হয়ে উঠলো, মুক্তোর মতো কয়েকফোঁটা অশ্রুবিন্দু গড়িয়ে পড়লো রানির গণ্ডদেশ বেয়ে। ঠিক সেই সময়ই আচমকা কক্ষের দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে তিনি মুহূর্তের মধ্যে ফিরে এলেন তাঁর কঠোর বাস্তবে।
শত্রু মহলে নতুন সখীর আবির্ভাব
=========================
কক্ষের দরজা খুলে জনা কয়েক সাধারণ হাবসি রক্ষিণী সহ প্রবেশ করলেন মধ্য কুড়ি বয়সের এক যুবতী। অনান্য তুর্কি রমণীদের চেয়ে এই যুবতীকে গঠন সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। ভারতীয় ললনাদের মতোই কমল আর লাবণ্যময়ী এর মুখশ্রী। গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ এবং চোখে-মুখে আভিজাত্যের ছাপ স্পষ্ট। মধ্য কুড়ির বয়স হলেও যুবতীর রূপের ছটা এখনও যথেষ্ট ঈর্ষনীয়। যদিও যুবতীর পরনে স্মেচ্ছদের পোশাক কিন্তু তাঁকে দর্শন করে কোন রাজপুত রাজকুমারী বলেই মনে হয়। তুর্কি রক্ষিণীদের হাতে কয়েকটি রুপোর পাত্র ছিল। পাত্রগুলি সবুজ মসলিনের বস্ত্রখণ্ড দ্বারা আচ্ছাদিত। যুবতীটি বিজাতীয় ভাষায় রক্ষিণীদের কিছু একটা নির্দেশ দিলেন। সেই নির্দেশ পেয়ে রক্ষিণীরা পাত্রগুলি সম্মুখের একটি শ্বেত প্রস্তরের টেবিলের উপর সযত্নে রেখে দিয়ে তুর্কি প্রথায় কুর্নিশ জানিয়ে বিদায় নিলো। এরপর সেই যুবতীটি দ্রুত কক্ষের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে রানি কমলাবতীকে কিছুটা বিস্মিত করে সনাতনী রাজপুত প্রথায় মাথনত করে যুক্তকর হস্তে প্রনাম করে পরিচিত ভাষায় বললেন, “তুর্কি রাজধানি দিল্লির শাহী কেল্লা-প্রাসাদে আপনাকে আন্তরিক স্বাগত জানাচ্ছি গুজ্জর মহারানি। আপনার সেবাযত্নের জন্য সুলতান হজরত আমাকে বিশেষ দায়িত্ব অর্পণ করেছেন।”
যুবতীর মুখে “মহারানি” অভিবাদন শুনে এতো কষ্টের মধ্যেও কিছুটা কৌতুক বোধ করলেন রানি কমলাবতী। তিনি বেদনা মিশ্রিত ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন, “মহারানি বলে সম্বোধন করে কেন অযথা পরিহাস করছেন আপনি ? এখন আর কোন রাজ্যের রানি নই আমি। আপনাদের কামুক স্মেচ্ছ সুলতানের হারেমে বন্দি এক সামান্য রক্ষিতা আমি।”
-“আমাকে ক্ষমা করে দেবেন। আপনার মনে আঘাত দেবার বিন্দুমাত্র বাসনা ছিল না আমার। গুজরাটের রানি হিসাবে সম্মান প্রদর্শন করবার জন্যই আপনাকে ওইভাবে সম্বোধিত করেছিলাম আমি।” কিছুটা কুণ্ঠিত স্বরে বললেন অপরিচিত যুবতীটি।
এরপর রানি কমলা যুবতীর দিকে তাকিয়ে মৃদু কণ্ঠে জিগ্যেস করলেন, “আপনি না জেনে ভুল করেছেন, সে জন্য আপনার বিরুদ্ধে আর কোন বিদ্বেষ নেই আমার। এবারে আমি কি আপনার পরিচয় জানতে পারি ?”
যুবতীটি মৃদু হেসে বললেন, “আপনার এই খিদমৎগারের নাম নাদিরা বেগম। বর্তমানে আপনি যে পোশাক পরে আছেন সেটা কাফেরদের পোশাক। দিল্লিতে এই ধরনের পোশাক নিষিদ্ধ। সামনে টেবিলের উপর রাখা পাত্রগুলিতে দিল্লির জেনানামহলের বিশেষ পোশাক গুচ্ছ রয়েছে। এর মধ্যে আপনার যেটা পছন্দ সেটাই পরিধান করুন। সুলতান হজরতের নয়া সিরি কেল্লার বেগমমহলে আপনার বাসস্থানের জন্য একটি আলিশান মহলের বন্দোবস্ত করা হচ্ছে। আর দুই-তিন রোজের মধ্যে আপনাকে সেখানে স্থানান্তরিত করা হবে।”
-“এই মুহূর্তে আপনাদের সুলতান কোথায় ?” ঘৃণাভরা কণ্ঠে জিগ্যেস করলেন রানি কমলাবতী
জবাবে নাদিরা বললেন, “এই মুহূর্তে সুলতান কারা প্রদেশের দিকে কুচ করেছেন। রণথম্বরের রাজা রাও হামীরকে তাঁর কুকর্মের জন্য উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করবার জন্য তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধের পরিকল্পনা করতে। আগামি ২-৩ রোজের (দিন) আগে ফিরবেন না তিনি। আপনি ততদিন এই মহলেই বিশ্রাম নিন আর চাইলে আমার সাথে দিল্লি নগর ভ্রমণেও যেতে পারেন আপনি।”
আলাউদ্দিন খিলজির কারা প্রদেশ যাত্রার সংবাদ শুনে কিছুটা যেন নিশ্চিত হলেন রানি কমলাবতী। আপাতত ২-৩ দিনের জন্য হলেও কিছুটা নিরাপদ তিনি।
রানি কমলাবতীর দিল্লি ভ্রমণ
====================
পরেরদিন প্রত্যূষে তুর্কি রক্ষী পরিবৃত হয়ে নাদিরা বেগমের সাথে দিল্লি নগর ভ্রমণে বেরলেন তিনি। বর্তমানে তুর্কি মুসলমানদের রাজধানি দিল্লি। দিল্লি নগরের চতুর্দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অবস্থান করছে একাধিক মসজিদ, দরগা, মাঝার এবং খানকুয়া। বিভিন্ন মসজিদে প্রার্থনা জানাতে আসা ইসলাম ধর্মাবলম্বী তীর্থযাত্রীদের গোসলের (স্নান) জন্য রয়েছে শীতল জলে পরিপূর্ণ সুবিশাল হৌজখাস জলাধার। পুরনো লালকোট কেল্লা প্রাসাদের নিকটেই কুতুব মিনার অভ্রলিঙ্গ যেন স্বদর্পে তুর্কিদের বিজয় ঘোষণা করছে। দিল্লির রাস্তাঘাট অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ এবং যথেষ্ট নোংরা। পথের উপরেই জায়গায় জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরে রয়েছে অশ্ব এবং উটের বিষ্ঠা। নগরের অধিকাংশ অধিবাসিই ভিনদেশি উজবুক আর পাঠানজাত তুর্কি জাতির। তাদের শারীরিক গঠন স্থানীয় ভারতীয়দের তুলনায় বেশ কিছুটা রুক্ষ। তাদের পরনে মূলত কুর্তা জাতীয় চুড়িদার আর পাজামা। অনেকে চুড়িদারের উপর চোগা পরিধান করেছে। তাদের মুখমণ্ডল জুড়ে গুম্ফহীন লম্বা ছাগদাড়ি এবং মাথা পাগড়ী দ্বারা আচ্ছাদিত। নিজেকে স্মেচ্ছদের পোশাকে আবৃত করে স্মেচ্ছদের নগর দর্শন করতে করতে ক্রমশ যেন শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসছিল রানি কমলাবতীর। নগর দর্শন শেষ করে দ্বিপ্রহরে কেল্লায় প্রত্যাবর্তন করছিলেন তাঁরা। রানি কমলার মনে পড়ল আনহিলওয়ারাপট্টনের প্রাসাদে এই সময় তিনি পারিবারিক কুণ্ডে স্নান সেরে শুদ্ধ বসনা হয়ে রাজপ্রাসাদের মন্দিরে দ্বিপ্রহরের পূজো সম্পন্ন করতেন। তিনি কিছুটা অধৈর্য হয়ে নাদিরা বেগমকে ক্ষীণ কণ্ঠে জিগ্যেস করলেন, “দিল্লিতে কোন হিন্দু দেবালয় নেই নাদিরা ?”
প্রশ্নটা শুনে নাদিরা বেগম রানি কমলার কানের নিকটে নিজের ওষ্ঠ এনে অত্যন্ত নিচু কণ্ঠে বললেন, “ধিরে বলুন মহারানি। তুর্কি জল্লাদরা আপনার প্রশ্ন শুনতে পেলে যারপরনাই ক্রুদ্ধ হবে।” এরপর নাদিরা একটা হতাশাভরা গভীর দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে কিছুটা বিষাদঘন কণ্ঠে পুনরায় বললেন, “মূল দিল্লি নগরের দক্ষিণপ্রান্তে ফরিদাবাদের নিকটে সূর্যকুণ্ড নামে একটা প্রাচীন সরোবর আছে। যতদূর জানি চৌহানদের শাসনকালে হিন্দুদের নিকট অত্যন্ত পবিত্র সরোবর ছিল সেটা। ওই সরোবরের পাশে একটি পরিত্যাক্ত প্রাচীন মন্দির আছে। অন্তিম চৌহান রাজা পৃথ্বীরাজ চৌহানের শাসনকালের সময় নির্মিত হয়েছিল মন্দিরটি। এক সময়ের হিন্দু নৃপতিদের সমৃদ্ধশালী রাজধানি দিল্লি সুপ্রসিদ্ধ ছিল মন্দির নগরী হিসাবেও। কিন্তু তুর্কিদের শাসনকালে আজ আর সেসবের অস্তিত্ব নেই। দিল্লির যাবতীয় প্রাচীন মন্দির এবং সৌধগুলি ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে সেগুলির মালমসলা দিয়ে নতুন মসজিদ এবং মহল নির্মাণ করেছে তুর্কি শাসকরা। প্রাচীন দিল্লি নগরের একমাত্র চিহ্ন হিসাবে টিকে রয়েছে কেবলমাত্র সূর্যকুণ্ডের পার্শ্ববর্তী ওই পরিত্যাক্ত মন্দিরটি। আপনি চাইলে আপনাকে সেখানে নিয়ে যেতে পারি। তবে আজ আর নয়। আজ অনেক বেলা হয়েছে, আমাদের মহলে ফিরতে হবে।”
নাদিরা বেগমের আসল পরিচয় লাভ
==========================
এইভাবেই অতিবাহিত হলো আরও একটি দিন। পরেরদিন বিকেলে লালকোটের কেল্লা প্রাসাদে নিজের কক্ষে বসে বিষণ্ণভাবে নিজের অজানা ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করছিলেন গুর্জর রানি কমলাবতী। এমন সময় কক্ষে প্রবেশ করলেন নাদিরা বেগম। কিছুক্ষণ আলাপচারিতার পর রানি কমলা তাঁকে আচমকা বললেন, “আমি জানি নাদিরা বেগম বর্তমানে আপনি স্মেচ্ছ রমণীদের বেশে থাকলেও আসলে আপনিও আমার মতোই একজন রাজপুত রমণী।”
এই কথা শুনে কিছুটা বিস্ময়ভরা কণ্ঠে নাদিরা পাল্টা জিগ্যেস করলেন, “সেটা আপনি কি করে অনুধাবন করলেন মহারানি ?”
রানি কমলা দৃঢ় স্বরে বললেন, “আপনার ভাষা অবিকল আমার ভাষার মতোই, যতবার আপনার সাথে আমার সাক্ষাৎ হচ্ছে ততবারই আপনি তুর্কি প্রথায় কুর্নিশ না করে আমাদেরই প্রথায় যুক্তকর হস্তে প্রনাম করছেন, এছাড়াও গতকাল সূর্যকুণ্ড এবং প্রাচীন দিল্লি নগরের ইতিহাস শোনানানর সময় এক অব্যাক্ত বেদনায় আপনার চক্ষুযুগল অশ্রুশিক্ত হয়ে উঠেছিল এবং আপনার কণ্ঠস্বর আবেগপূর্ণ হয়ে উঠেছিল।”
এরপর নাদিরা বেগম স্মিত হাস্যমুখে বেদনামিশ্রিত কণ্ঠে বললেন, “আপনার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা সত্যিই অসাধারণ মহারানি। আপনি সঠিক অনুমান করেছেন। একসময় আমিও আপনারই মতো একজন সনাতন ধর্মাবলম্বী রাজপুত নারীই ছিলাম। মধ্যভারতের একটি ক্ষুদ্র রাজ্য চন্দ্রকেতুগড়ের রাজকুমারী ছিলাম আমি। তখন আমি পরিচিত ছিলাম রাজকুমারী কনকবতী নামে। আর আমার পিতা মহারাজ অর্জুনবর্মণ ভালবেসে আমাকে সৈরিন্ধ্রী নামেই ডাকতেন। আজ থেকে ছয় বছর পূর্বে যখন আমার বয়স সতেরো তখন নিকটবর্তী দেবীপট্টন রাজ্যের যুবরাজের সাথে আমার বিবাহ স্থির হয়েছিল। বিবাহের রাতেই চন্দ্রকেতুগড়ের প্রাসাদে আচমকা হামলা চালায় আলাউদ্দিন খিলজির নেতৃত্বাধিন বর্বর তুর্কি বাহিনী। বিবাহ মণ্ডপ থেকেই আমাকে অপহরণ করে তুর্কি লুণ্ঠকরা। তখনও সুলতান হননি আলাউদ্দিন। সেই সময় তিনি কারা প্রদেশের শাসক ছিলেন। আমাকেও তিনি আপনারই মতো বন্দিনী করে নিয়ে এলেন কারা প্রদেশের শাহী রাজমহলের পুরাতন হারেমে। সেখানেই আমাকে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হয়। রাজকুমারী কনকবতী থেকে নাদিরা বেগম হিসাবে পরিচিত হই আমি। কারার হারেমে টানা দুবছর আমাকে ভোগ করেছে কামুক আলাউদ্দিন। এরপর নিজের কাকা জালালউদ্দিনকে হত্যা করে সুলতান হবার পর কারা মহলের হারেমে বন্দি অনান্য রক্ষিতাদের সাথে খিলজি আমাকেও নিয়ে আসে দিল্লিতে। বর্তমানে লালকোট কেল্লার বেগমমহলের দেখভালের দায়িত্ব অর্পিত করা হয়েছে আমাকে।”
এই পর্যন্ত বলে থামলেন নাদিরা। রানি কমলা লক্ষ্য করলেন নিজের অতীত কাহিনী বলতে বলতে অশ্রুশিক্ত হয়ে উঠেছে নাদিরার চক্ষু যুগল। এরপর নাদিরা নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে পুনরায় বলে উঠলেন, “এবারে আপনিও প্রস্তুত হন গুজ্জর মহারানি। আগামীকাল আপনাকে সিরি কেল্লার হারেমে স্থানান্তরিত করা হবে আর আগামীকাল বিকেলে সুলতানও দিল্লিতে প্রত্যাবর্তন করছেন কারা প্রদেশ থেকে। রাতে বিছানায় সুলতানকে খুশি করতে পারলে আপনার ভাগ্যে অপেক্ষা করছে দুর্মূল্য উপহার আর সুলতান রুষ্ট হলে আপনার ভাগ্যে অপেক্ষা করছে আরও ভয়ানক পরিণতি।”
নাদিরার শেষের কথাগুলি শুনে এক অজানা আতঙ্ক আর তীব্র ঘৃণায় শিউড়ে উঠলেন রানি কমলা। তিনি অস্ফুট কণ্ঠে বললেন, “এখান থেকে পালানো যায় না রাজকুমারী সৈরিন্ধ্রী ? দয়া করে আপনি আমাকে সাহায্য করুন এই নরক থেকে পালাতে”
বহুদিন বাদে রানি কমলার মুখে “সৈরিন্ধ্রী” নামটি শুনে খুশি হলেন নাদিরা। তিনি হাসিমুখে ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন, “এতদিন বাদে আপনার মুখে আমার জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া পুরাতন নামটি শুনে অত্যন্ত খুশি হলাম আমি। প্রতিজ্ঞা করছি মহারানি, আপনাকে আমার পক্ষে যতটা সম্ভব আপনাকে ততটাই সাহায্য করবো আমি। তবে আমি আপনাকে অত্যন্ত দুঃখের সাথে জানাতে বাধ্য হচ্ছি মহারানি যে আলাউদ্দিনের এই চক্রব্যূহ থেকে পলায়ন অসম্ভব। মানুষ তো দুরস্ত একটা মাছিও গলতে পারবে না তুর্কি রক্ষীদের শ্যেন দৃষ্টি এড়িয়ে। আগামীকাল থেকে আপনার জীবনে যা ঘটতে চলেছে এটাই রুঢ় বাস্তব। আপনি নিজেকে শক্ত করুন মহারানি।” এই পর্যন্ত বলে কক্ষ থেকে বিদায় নিলেন নাদিরা। শূন্য কক্ষে অসহায়ভাবে প্রবল কান্নায় ভেঙে পড়লেন বন্দি গুজ্জর রানি।
আলাউদ্দিনের হারেমে বন্দি গুজ্জর রানি
=============================
পরেরদিন সকালেই রানি কমলাবতীকে স্থানান্তরিত করা হলো সিরির শাহী কেল্লার নতুন রাজমহলের হারেমে। হারেমে প্রবেশ করতেই রানি কমলা দেখতে পেলেন ঝলমলে পোশাক পরিহিতা একের পর এক রমণীদের। এদের প্রত্যেকেরই বয়স ষোল থেকে পঁচিশ-ছাব্বিশের মধ্যে। তুর্কি সুলতানের হারেম জুড়ে বিরাজ করছে রূপের হাট। আমির খুস্রুর লেখনি অনুযায়ী আলাউদ্দিন খিলজির হারেমে নিত্য নবযৌবনা সুন্দরী রমণীর আবির্ভাব হতো। কোন নারীর বয়স একটু অধিক হলেই বা কোন নারী একটু পুরাতন হলেই খিলজির হারেম থেকে সে সহসা ভোজবাজির মতো অদৃশ্য হয়ে যেতো। হারেমে কোন ক্ষুণ্ণযৌবনার স্থান ছিল না। গুজরাটের রানির থাকবার ব্যবস্থা হলো হারেমের দক্ষিণপ্রান্তে সবচেয়ে বড় আর সবচেয়ে আলিশান কক্ষটিতে। অপরূপা রূপসী রানি কমলাবতীর সুখ সাচ্ছন্দের যাতে কোন ঘাটতি না হয় সেজন্য কক্ষটি সজ্জিত করা হয়েছিল নানান দামি আসবাবপত্র দিয়ে। এমনকি রানি কমলাবতীর অনুরোধে তুর্কি রক্ষীরা তাঁর সদ্য পরিচিত সখী নাদিরা বেগম ওরফে রাজকুমারী সৈরিন্ধ্রীকে রানির দেখভালের জন্য তাঁর নতুন বাসস্থানে প্রেরণ করলো।
রাতের দিকে কারা প্রদেশের মহলে রণথম্বরের মহারাজ হামীরদেব চৌহানের বিরুদ্ধে আসন্ন যুদ্ধযাত্রার পরিকল্পনা সেরে সিরির কেল্লায় প্রত্যাবর্তন করলেন আলাউদ্দিন খিলজি। এদিকে রাতে খিলজির সামনে পেশ করবার জন্য নাদিরা বেগম তাঁর সখীদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন রানি কমলাবতীকে সুসজ্জিত করতে।
#Subhojit_Roy
আলাউদ্দিন খিলজির বর্বরতা
=====================
সন্ধ্যে নামলো তুর্কি রাজধানিতে। সিরি কেল্লার নয়া হারেমের সুসজ্জিত শয়নকক্ষে নবাগতা রানি কমলাবতীকে ভোগ্যপণ্য হিসাবে সুসজ্জিত করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো হারেমের অনান্য পুরাতন রমণীগণ। তাঁদের তদারকি করতে লাগলেন খোদ নাদিরা বেগম। সাজসজ্জা সম্পূর্ণ হলে রানি কমলাবতী সন্ত্রস্তভাবে নাদিরার সাথে একান্তে কথা বলতে চাইলেন। নাদিরার ইশারায় বাকি রমণীরা কক্ষ ত্যাগ করবার পর গুজ্জর রানি অসহায়ভাবে ব্যকুল কণ্ঠে বললেন, "স্মেচ্ছদের এই চক্রব্যূহ থেকে পলায়ন যখন অসম্ভব তখন আপনি দয়া করে আমাকে একটি ছুরি বা বিষ দিন।"
গুজ্জর রানির প্রার্থনা শুনে কিছুটা স্তম্ভিত কণ্ঠে নাদিরা বললেন, "ছুরিকাঘাতে বা বিষ প্রয়োগ করে আপনি হত্যা করবার পরিকল্পনা করছেন সুলতানকে ? সে যে অসম্ভব।" এরপর কয়েক মুহূর্ত নীরব থেকে অবশেষে একটি হতাশা মিশ্রিত গভীর দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে নাদিরা ওরফে রাজকুমারী সৈরিন্ধ্রী বিষণ্ণ কণ্ঠে বললেন, " "সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির বর্বরতা এখনও চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করেননি আপনি। তুর্কি অধিপতিকে হত্যা করা যদি অতোই সহজ কার্য হতো তাহলে সে কাজ কবেই সম্পন্ন করতাম আমি নিজেই। শুনেছি বার দুয়েক সুলতানকে হত্যার প্রচেষ্টা করেছিলেন তার পুরাতন হারেমের দুই হতভাগ্য রমণী। কিন্তু তারপর আর তাঁদের সন্ধান পাওয়া যায়নি। কেউ বলে সুলতানের নির্দেশে তাঁদের যৌনদাসী হিসাবে বিক্রয় করা হয়েছে হিন্দুকুশের ওপারে মধ্য এশিয়াতে, আবার কেউ বলে সেই অভাগীদের জীবন্ত গোর দেওয়া হয়েছে।"
নাদিরার বক্তব্য শেষ হতেই রানি কমলাবতী উতলা হয়ে বলে উঠলেন, "শয়তান স্মেচ্ছ সুলতানকে হত্যা করাটা না হয় অসম্ভব, কিন্তু স্মেচ্ছদের হাতে কলঙ্কিত হবার পূর্বেই নিজেকে শেষ করে দেওয়া তো সম্ভব। আপনি আমাকে যা হোক একটা অস্ত্র দিন, প্রয়োজনে আত্মহত্যা করে নিজের সম্ভ্রম রক্ষা করবো আমি।"
রানি কমলাবতীর কাতর আর্তির প্রতি কোনরূপ জবাব দান না করেই নাদিরা বিষণ্ণ হাসিমুখে একবার সামনের টেবিলে সজ্জিত নানা ধরনের সুস্বাদু ফলে সজ্জিত পাত্রটির প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করে মৃদু কণ্ঠে রানি কমলাবতীকে বললেন, "রাতে আহারের পরে ইচ্ছে হলে ফলগুলি খেয়ে দেখতে পারেন মহারানি। অত্যন্ত সুস্বাদু ফল। শুধুমাত্র আপনার জন্যই বিশেষ নির্দেশ দিয়ে আনানো হয়েছে।" এই পর্যন্ত বলে নত মস্তকে কক্ষ ত্যাগ করলেন নাদিরা। ক্রমে সন্ধ্যে পেরিয়ে রাত নামলো।
অসহায়ভাবে শয্যায় বসে নিজের আসন্ন ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করছিলেন তিনি। এমন সময় হটাতই তাঁর দৃষ্টি পড়লো সামনের টেবিলে রাখা ফলের পাত্রটির দিকে। ঘৃণাভরে সেদিক থেকে চোখ ফেরাতে গিয়ে আচমকা তিনি দেখতে পেলেন পাত্রটিতে হরেক রকমের ফলের সাথে রাখা রয়েছে একটি তীক্ষ্ণধার ছুরিকা। সম্ভবত ফল কাটবার জন্যই দেওয়া হয়েছে ছুরিটা, অথবা আত্মহত্যা করে নিজের সম্ভ্রম রক্ষা করবার সুযোগ দিতেই জন্যই ছুরিটা পাত্রে উদ্দেশ্যপ্রানদিত ভাবেই রেখে গেছেন নাদিরা বেগম। রানি কমলা বিন্দুমাত্র বিলম্ব না করে শয্যা ছেড়ে নেমে এসে দাঁড়ালেন টেবিলের সামনে। নিজের দক্ষিণ হস্ত প্রসারিত করে তুলে নিলেন ছুরিটা। এরপর ছুরিটা দুহাতে মুষ্টিবদ্ধ করে সামনে বাড়িয়ে নিজের দুচোখ বুজে অন্তিমবারের জন্য স্মরণ করলেন নিজের জীবন থেকে চিরতরে হারিয়ে যাওয়া গুজরাট নরেশ রাজা কর্ণ সিংহ আর তাঁর শিশু রাজকুমারী দেবালা দেবীকে। ঈশ্বরের নিকটে নিজের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে যখন ছুরিটা দিয়ে নিজের শরীরে আঘাত করতে যাবেন ঠিক সেই সময়ই ঘড় ঘড় শব্দে খুলে গেল শয়নকক্ষের সদর দ্বার। কক্ষে টলায়মান পদক্ষেপে প্রবেশ করলেন আকণ্ঠ মদিরা রসে মগ্ন এক দীর্ঘদেহী পাঠান জাত তুর্কি যুবা। শূকরের ন্যায় ভোঁতা মুখাবয়ব, দুই চক্ষু যুগলের চারিপাশ সুর্মার লেপ দ্বারা আবৃত্ত, ওষ্ঠের ওপর পুরুষ্ঠ গুম্ফ, গাল ভর্তি ছাগলের ন্যায় লম্বা দাঁড়ি, দুকানের পাশে বিশাল গালপাট্টা, মুখের উপর একটি গভীর ক্ষত চিহ্ন, গর্দানের উপর হীরক খচিত মহার্ঘ্য মসলিনের পাগড়ী, পরনে জানুর নিচ পর্যন্ত বিস্তৃত মসলিনের চুড়িদারের উপর দামি চোঘা এবং কোমরের বাম পার্শে স্বর্ণখচিত কোষবদ্ধ বক্র অসি। কক্ষে ব্যক্তিটির আচমকা প্রবেশের ফলে আর আত্মহত্যা করা সম্ভব হলো না রানি কমলাবতীর পক্ষে। তিনি পরবর্তী সুযোগের অপেক্ষায় দ্রুত ছুরিটি লুকিয়ে ফেললেন নিজের বস্ত্রখণ্ডের মধ্যে।
তুর্কি ব্যক্তিটি কক্ষে প্রবেশ করে বেশ কয়েক মুহূর্ত নিস্পলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন বন্দিনী গুজ্জর রানির পানে। তুর্কি সর্দারের দৃষ্টিতে লালসার ধুম কলুষিত অগ্নি প্রত্যক্ষ করলেন রানি কমলাবতী। তুর্কি ব্য্যক্তিটি নিজের নীরবতা ভঙ্গ করে মদিরাশক্ত জড়ানো কণ্ঠে বললেন আধা ফার্সি, আধা রাজপুত ভাষা মিশ্রিত কণ্ঠে বললেন, "দিল্লির সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির তুরফ থেকে কৌলারানি (রানি কমলাবতীর তুর্কি অপভ্রংশ উচ্চারণ) সাহেবাকে দিল্লিতে স্বাগত।" এরপর আলাউদ্দিন রানি কমলার আরও সামনে এগিয়ে আসতেই গুজ্জর রানি নিরুপায় হয়ে দ্রুত নিজের বস্ত্রখণ্ডের মধ্যে থেকে লুকনো ছুরিকাটি বের করে সেটি নিজের দক্ষিণ হস্তে শক্ত করে চেপে ধরে উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠলেন, "সাবধান বর্বর স্মেচ্ছ সুলতান আর এক পাও অগ্রসর হবেন না আর আমার শরীর স্পর্শ করবার বিন্দুমাত্র প্রয়াস করবেন না, তাহলে কিন্তু অনর্থ ঘটে যাবে।"
রানি কমলার হুমকি শুনে অট্টহাস্যে ফেটে পড়লেন খিলজি। তিনি হাসতে হাসতেই প্রবল তাচ্ছিল্যভরা বিদ্রূপাত্মক কণ্ঠে বলে উঠলেন, "আমি দিল্লির অপরাজেয় সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি। হিন্দুস্থানের তামাম কাফের রাজারা আমার বফাদারি কবুল করে হাররোজ সেলাম ঠোকে আমাকে। আজ পর্যন্ত কেউ আমাকে শিখস্ত (পরাজিত) দিতে পারেনি। আর আজ কিনা আমাকে মৌতের ডর দেখাচ্ছে এক কাফের হিন্দুস্থানি জেনানা ?"
আলাউদ্দিনের দিকে ঘৃণাভরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রানি কমলাবতী দৃপ্ত বলে উঠলেন, "আমি আপনাকে হত্যা করবার ভয় দেখাচ্ছি না স্মেচ্ছ সুলতান। আমি জানি আপনাকে হত্যা করবার ক্ষমতা আমার নেই। কিন্তু আপনি আর অগ্রসর হলেই আমি নিজেই এই ছুরির এক আঘাতে নিজেকে শেষ করবো।"
কিন্তু রানি কমলা যা ভাবেছিলেন তা বাস্তবে সম্ভব হলো না। বহু যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী তুর্কি সুলতান প্রয়োজনে অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সাথে চলাফেরা করতে পারতেন। মদ্যপ অবস্থা সত্ত্বেও সেদিনও বাজপাখির ন্যায় বিদ্যুৎ গতিতে খিলজি রানি কমলার সামনে এগিয়ে এসে তাঁর ছুরিসুদ্ধ দক্ষিণ হস্তের কবজির নিকটাংশটা সজোরে চেপে ধরে মুচড়ে দিলেন। অসহনীয় যন্ত্রণায় নীলবর্ণ হয়ে উঠলো রানি কমলার মুখ মণ্ডল। তিনি অসহায়ভাবে অস্ফুট কণ্ঠে কাতর আর্তনাদ করে উঠলেন। তাঁর হাত থেকে সশব্দে ছুরিটি গড়িয়ে পড়লো হারেমের শয়নকক্ষের শান বাঁধানো মেঝেতে। এরপর আলাউদ্দিন রানি কমলার মুখের দিকে লালসাপূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কর্কশ কণ্ঠে বললেন, "তোমার মতো খুবসুরত জেনানার হাতে অস্ত্র মানায় না মোটেই। রানি সাহেবা আলাউদ্দিনের গ্রাস থেকে এবারে কে রক্ষা করবে তোমাকে ?" তারপর ক্ষুদার্থ শার্দূলের ন্যায় আলাউদ্দিন ঝাঁপিয়ে পড়লেন রানি কমলার শরীরের উপর। শয়নকক্ষের অভ্যন্তর থেকে প্রতিধ্বনিত হলো রানি কমলার অসহায় আর্তনাদ।
আলাউদ্দিনের রণথম্বর যাত্রা আর নাদিরার সাথে পুনর্মিলন রানি কমলার
===================================================
এইভাবেই অতিক্রান্ত হলো আরও প্রায় একমাস। প্রতি রাতেই আলাউদ্দিন তাঁর নতুন হারেমে বন্দিনী নয়া শিকার গুজ্জর রানির শয়নকক্ষে যেতেন। হিংস্র পশুর ন্যায় ছিঁড়েখুঁড়ে খেতেন অসহায় রানি কমলার নরম পেলব শরীরটা। এরই মধ্যে দিল্লি দরবারের প্রধান কাজী সৈয়দ রুসুল আলির ফতোয়া অনুসারে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হলো রানি কমলাবতীকে। তাঁর নয়া নামকরণ হলো কৌসর বাঈ। এইসব ঘটনায় মানসিক দিক থেকে একেবারেই ভেঙে পড়লেন রানি কমলাবতী। শোকে-দুঃখে যেন প্রস্তর মূর্তির ন্যায় স্থবির হয়ে গেলেন তিনি। ঠিক এহেন সময়ে রণথম্বরের ক্ষত্রিয় বীর মহারাজ হামীদেব চৌহানকে উচিত শিক্ষা প্রদানের জন্য নুসরাত খানের নেতৃত্বে এক বিশাল বাহিনী প্রেরণ করলেন আলাউদ্দিন খিলজি। রণথম্বরের ঐতিহাসিক যুদ্ধ শুরু হবার কিছুদিনের মধ্যেই এক তুর্কি গুপ্তচর এসে শোনাল এক নিদারুণ সংবাদ। মহারাজ হামীরদেব চৌহানের বাহিনীর হাতে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছে তুর্কি বাহিনী। যুদ্ধে শাহাদত (শহীদ) প্রাপ্ত হয়েছে আলাউদ্দিন খিলজির প্রিয় সেনাপতি নুসরাত খান। এক সামান্য ক্ষত্রিয় কাফের রাজার স্পর্ধায় ক্রোধে ফুঁসে উঠলেন আলাউদ্দিন। এবারে নিজেই প্রায় লক্ষাধিক সেনা সমেত যাত্রা করলেন রণথম্বরের উদ্দেশ্যে। অবশেষে কিছুদিনের জন্য মুক্ত হলেন কৌসর বাঈ (রানি কমলাবতী)।
সিরি কেল্লার হারেমে নিজের শয়নকক্ষের শয্যায় বসে বিধর্মী স্মেচ্ছদের স্পর্শে কলুষিত নিজের জীবনের কথা চিন্তা করতে করতেই একসময় নিজের অজান্তেই অঝোরধারা ক্রন্দনধ্বনিতে ভেঙে পড়লেন তিনি। সেই কালরাতের পর আলাউদ্দিনের কড়া নির্দেশে আর কোন অস্ত্র তো দূর এমনকি দিনের আহারাদিও শুধুমাত্র আহারের কিছুক্ষণ পূর্বে এসে তাঁর কক্ষে রেখে যায় তুর্কি রক্ষিণীরা। যতক্ষণ না রানি কমলা তাঁর আহার শেষ করছেন ততক্ষণ তাঁর সম্মুখে দণ্ডায়মান হয়ে তাঁর গতিবিধির দিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখে রক্ষিণীরা। এমনকি এই কদিন তাঁর প্রিয় সখী নাদিরা বেগমও একবারের জন্যও আসেননি অসহায় রানির সাথে দেখা করতে। এমন সময়রানি কমলা তাঁর কাঁধে কোন পরিচিত শুভাকাঙ্ক্ষীর স্নেহপূর্ণ মমতাময়ী স্পর্শ অনুভব করলেন। ঘাড় ঘুড়িয়ে পেছন ফিরে তিনি দেখতে পেলেন তাঁর প্রিয় নাদিরা বেগমকে। এতো দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে নাদিরাকে দেখেই তাঁকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে এক শিশু কন্যার ন্যায় কান্নায় ভেঙে পড়লেন রানি কমলা।
নাদিরা বেগম পরম বাৎসল্যে রানি কমলার মাথায় এবং কেশে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে কোমল কণ্ঠে বললেন, "শান্ত হোন দয়া করে নিজেকে সংযত করুন মহারানি। গত একমাস যাবত আপনার উপর যেরকম পাশবিক অত্যাচার করেছে স্মেচ্ছ সুলতান, আজ থেকে ছয় বছর পূর্বে আমাকেও ঠিক সেরকমই ভয়ানক অত্যাচারের সম্মুখীন হতে হয়েছিল।"
-“মহারানি বলে কাকে সম্বোধন করছেন আপনি ? সম্মান, সম্ভ্রম আর স্বধর্ম খুইয়ে আমি তো এখন বর্বর স্মেচ্ছ সুলতানের হারেমে বন্দি সামান্য এক যৌনদাসী মাত্র।” বাষ্পরুদ্ধ ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন রানি কমলাবতী।
-“আজ্ঞে না মহারানি, আপনি পূর্বেও আমার নিকট গুজরাটের মহারানি ছিলেন বর্তমান এবং ভবিষ্যতেও থাকবেন” আবেগঘন কণ্ঠে নিজের বক্তব্য পেশ করলেন নাদিরা।
এরপর নাদিরা বেগমের ইশারায় কক্ষ ত্যাগ করলো প্রহরারত তুর্কি রক্ষিণীরা।
শূন্য কক্ষে রানি কমলাবতী বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন, "শুনলাম এই মুহূর্তে স্মেচ্ছ সুলতান দিল্লিতে নেই। রণথম্বরে গেছেন ক্ষত্রিয় চূড়ামণি রাজা হামীরের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রায়। ঈশ্বর অভিশাপে মহাবীর হামীরের তরবারির আঘাতে যেন মৃত্যু হয় স্মেচ্ছ শয়তানের। কিন্তু আমি আর এই কলঙ্কিত জীবন কিছুতেই সইতে পারছি না। রাজকুমারী সৈরিন্ধ্রী আপনি আমাকে অবিলম্বে বিষ এনে দিন। বিষপান করে আত্মহনন করবো আমি।"
-"সেদিনও তো আপনার অনুরোধে ফলের টুকরীতে ছুরি রেখে গিয়েছিলাম আমি। কিন্তু নিজের অভীষ্ট সাধনে সফল হতে পারলেন কি আপনি ?" বিষণ্ণ কণ্ঠে বললেন নাদিরা।
রানি কমলা বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বললেন, "সেরাতে ফলের টুকরীতে তাহলে আপনিই অস্ত্র রেখে গিয়েছিলেন ? আপনার এই মহৎ প্রয়াস প্রমান করলো যে সমগ্র দিল্লি নগরে এই মুহূর্তে আমার একমাত্র বিশ্বস্ত সখী হলেন কেবলমাত্র আপনিই। তবে সেদিন অসফল হলেও আজ স্মেচ্ছ শয়তান অনুপস্থিত। আজ আমি সহজেই নিজের কাঙ্ক্ষিত অভীষ্ট পূরণে সফল হবো। এনে দিন আমাকে বিষ।"
নাদিরার চক্রান্তের পরিকল্পনা
=====================
-আত্মহনন করে আপনি হয়তো নিজের কলঙ্কিত বন্দি জীবন থেকে মুক্তি লাভ করবেন কিন্তু ইতিহাস গুজরাটের ক্ষত্রিয়জাত রাজপুত মহারানিকে কিভাবে স্মরণে রাখবে ? তুর্কি সুলতানের হারেমে বন্দিনী অসংখ্য চরিত্রহীনা রক্ষিতাদের একজন হিসাবে। আপনি কি চান না বর্বর সুলতানের দ্বারা আপনার উপর সংগঠিত ভয়াবহ অত্যাচারের প্রতিশোধ গ্রহণ করতে ? স্বীকার করছি আপনার হৃত সম্মান আর সম্ভ্রম আর কখনও ফিরে পাবেন না আপনি, কিন্তু বর্বর সুলতানকে তিলে তিলে হত্যা করে তুর্কি লম্পটকে তার পাপ কর্মের উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করে ইতিহাসের পাতায় একজন বীরাঙ্গনা ক্ষত্রিয় নারী হিসাবে আপনার নাম স্মরণীয় করে রাখতে পারেন।"
-"তুর্কি সুলতানকে হত্যা ? এ যে অত্যন্ত দুরহ কার্য। এ কি করে সম্ভব ?" তীব্র বিস্ময়ে প্রশ্ন করলেন রানি কমলা।
-"দুরহ কার্য বটে, কিন্তু অসাধ্য নয়। দীর্ঘদিন ধরে সুলতানের হারেমে বন্দিনী যৌনদাসীর জীবন-যাপন করবার পর এক পরিকল্পনার উদ্ভব হয়েছে আমার মস্তিষ্কে। কিন্তু এই পরিকল্পনাকে এই মুহূর্তে বাস্তবায়িত করতে পারেন কেবলমাত্র একজন নারীই, সে হচ্ছে আপনি ? কিন্তু এর জন্য বহু ত্যাগ স্বীকার করতে আপনাকে ?"
-"বর্বর স্মেচ্ছকে হত্যা করবার জন্য যেকোনো রূপ ত্যাগ স্বীকার করতে আমি প্রস্তুত।" দৃঢ় কণ্ঠে বললেন রানি কমলা।
-"তাহলে নিজেকে প্রস্তুত করুণ মহারানি। আপনার ভুবন মোহিনী রূপ, সৌন্দর্যের প্রয়োগে জয় করতে হবে সুলতানের কামনা দৃপ্ত মন। ছদ্ম প্রেমের মায়াজালে সম্পূর্ণ রূপে বশ করতে হবে সুলতানকে। দখল নিতে হবে সুলতানের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরগুলির। তারপর ধিরে ধিরে যথাসময়ে আপনাকে পরিণত হতে হবে বিষধর সর্পের ন্যায় এক বিষ কন্যায়। সেই বিষ কন্যা বহু শতাব্দী পূর্বে একদা যাদের প্রয়োগ করে এক নির্ভীক দেশপ্রেমিক ব্রাহ্মণ পণ্ডিত আচার্য চাণক্য তৎকালীন মগধের লম্পট আর দুরাচারী সম্রাট ধনানন্দকে হত্যা করে মগধের রাজসিংহাসনে অভিষিক্ত করেছিলেন ভারতবর্ষের প্রথম সম্রাট মহান চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যকে, ভারতের পবিত্র ভূমি থেকে বিতাড়িত করেছিলেন তৎকালীন স্মেচ্ছজাত গ্রীকদের।" নিজের ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনার বর্ণনা শেষ করে যখন নীরব হলেন নাদিরা তখন হারেমের সুবিশাল বাতায়ন পথ দিয়ে শেষ বিকেলের পড়ন্ত রৌদ্রমালার স্বর্ণাভ ছটা এসে পড়ছিল গুজ্জর রানি কমলাবতীর মুখাবয়বে। সেই আলোক ছটায় রানি কমলাবতীকে সেই মুহূর্তে স্বয়ং দেবী দুর্গার ন্যায় প্রতীত হচ্ছিল। তিনি দৃপ্ত কণ্ঠে নাদিরাকে বললেন, "আমি আপনার পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করতে রাজি রাজকুমারী সৈরিন্ধ্রী।"
#Subhojit_Roy
বিষকন্যা পঞ্চম পর্ব
===============
[আগে যা হয়েছিলঃ সিরির হারেমের শয়নকক্ষে তুর্কি সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির ভয়াবহ বর্বরতার সম্মুখীন হলেন গুজ্জর রানি কমলাবতী দেবী। তুর্কি হারেমে খিলজির হাতে ক্রমাগত কলঙ্কিত আর ধর্মান্তরিত হয়ে মানসিক ভাবে ভেঙে পড়ে আত্মহত্যায় সাহায্যের জন্য কাতর প্রার্থনা জানালেন একমাত্র প্রিয় সখী নাদিরা বেগমের কাছে। কিন্তু নাদিরা বেগম ওরফে রাজকুমারী সৈরিন্ধ্রী রানি কমলাবতীকে উদ্বুদ্ধ করলেন আলাউদ্দিন খিলজির বিরুদ্ধে ভয়াবহ প্রতিশোধ গ্রহণের। এরপর]
নাদিরা বেগমের ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা
===========================
রাজকুমারী সৈরিন্ধ্রীর (নাদিরা বেগম) মুখে নিজেকে বিষ কন্যায় রূপান্তরিত করে স্মেচ্ছ সুলতান আলাউদ্দিন খিলজিকে তার পাপের উপযুক্ত শাস্তি প্রদানের পরিকল্পনা শুনে দৃঢ় কণ্ঠস্বরে বাঘেলা রানি কমলাবতী বললেন, “আমি আপনার সাথে সহমত রাজকুমারী। কিন্তু আপনার পরিকল্পনাটা ঠিক কি ? দয়া করে আমাকে বিস্তারিতভাবে বলুন।”
কয়েক মুহূর্ত নীরব থেকে রাজকুমারী সৈরিন্ধ্রী নিজের আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে কক্ষের চতুর্দিকে সতর্ক দৃষ্টি বোলালেন। তারপর রানি কমলার নিকটে এসে মৃদু কণ্ঠে বললেন, “আমি জানি মহারানি এই মুহূর্তে তুর্কি সুলতানের বর্বরতায় সুলতানের প্রতি তীব্র ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়েছে আপনার মনের গহনে। কিন্তু এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে হলে আপনার রূপ আর সৌন্দর্য ব্যবহার করে রতি ক্রিয়ার মাধ্যামে সুলতানের মন জয় করতে হবে আপনাকে। সুলতানের সামনে লাস্যময়ী রূপ ধারন করে নিখুঁত অভিনয়ের সাহায্যে তাকে আপনার ছদ্ম ভালবাসার মায়াজালে আবদ্ধ করে আসতে আসতে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিতে হবে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রকগুলি, বিশেষ করে রসুই খানার। এরপর সুলতানের খাদ্যে বিশেষ বিষ প্রয়োগ করে তাকে ধিরে ধিরে উন্মাদ করে ঠেলে দিতে হবে চরম যন্ত্রণাময় মৃত্যুর দিকে।”
-“কিন্তু একি সম্ভব ? আমি কি করে সম্পন্ন করবো এতো দুঃসাধ্য কার্য ? আমি কি পারবো আদৌ সফল হতে, নাকি সুলতানের নিকট আমাদের যাবতীয় ষড়যন্ত্র উদ্ঘাটিত হয়ে উল্টে আমরাই বিপন্ন হয়ে পড়বো ?” কিছুটা বিপন্ন কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন রানি কমলাদেবী।
রানি কমলাদেবির প্রশ্ন শুনে স্মিত হাস্যমুখে রাজকুমারী সৈরিন্ধ্রী দৃপ্ত কণ্ঠে বললেন, “আপনি অবশ্যই পারবেন মহারানি। পারতে আপনাকে হবেই। নরপিশাচ স্মেচ্ছ সুলতানের যৌন লালসার হাত থেকে ভারতবর্ষের অনান্য প্রান্তের অগণিত হিন্দু নারীদের সম্ভ্রম আর সম্মান রক্ষার জন্য আপনাকে এই ষড়যন্ত্রে সফল হতেই হবে। আমি আপনাকে সবরকম ভাবে সাহায্য করবো”
-“তুর্কি সুলতানের যৌন লালসা থেকে ভারতীয় রমণীদের সম্ভ্রম আর সম্মান রক্ষার জন্য আমি আপনার প্রস্তাবে রাজি। এবারে বলুন কি করতে হবে আমাকে ?” উৎসুক কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন রানি কমলাবতী।
-“অস্ত্র চালনা, সঙ্গীত বিদ্যা বা নৃত্যকলা এই তিন বিদ্যার মধ্যে কোন বিদ্যায় আপনার পারদর্শিতা রয়েছে কি মহারানি ?” ভাবগম্ভীর স্বরে প্রশ্ন করলেন রাজকুমারী সৈরিন্ধ্রী। লাস্যময়ী নারী দেহের পরই এই তিনটে বিষয়েই বিশেষ দুর্বলতা রয়েছে সুলতানের।
রানি কমলাবতীর প্রস্তুতি শুরু
=====================
গুজরাটি ঐতিহাসিক নন্দশঙ্কর মেহেতার মতে নৃত্যকলায় অসাধারণ পারদর্শিতা ছিল মহারানি কমলাদেবির। তৎকালীন গুজরাটের রাজধানি আনহিলওয়ারাপট্টন অন্ধ্রপ্রদেশ আর দাক্ষিণাত্যের নিকটস্থ হওয়ায় সেই সময় গুজরাটের হিন্দু নারীদের মধ্যে ভারতনাট্যম আর কুচিপুরি নৃত্যের জনপ্রিয়তা ছিল যথেষ্ট। আনহিলওয়ারার রাজপুরীর অন্দরমহলে নিজের অবসর সময়ে পেশাদার নর্তকী শিক্ষিকার তত্ত্বাবধানে এই দুই নৃত্যকলাতেই যথেষ্ট পারদর্শিতা লাভ করেছিলেন রানি কমলাবতী। তিনি এবারে মৃদু কণ্ঠে রাজকুমারী সৈরিন্ধ্রীকে জানালেন সেই কথা। তা শুনে রাজকুমারী সৈরিন্ধ্রী উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললেন, “এতেই হবে মহারানি। এর সাথে আমি আপনাকে সুলতানের পছন্দের কত্থক নৃত্যেও কিছুটা তালিম দিয়ে নেবো। নৃত্যকলার প্রদর্শনের সাহায্যে আপনাকে বশ করতে হবে সুলতানকে। তবে এসব কিছুরই প্রয়োজন হবে না হয়তো যদি রণথম্বরের যুদ্ধে মহারাজ হামীরের অসি স্মেচ্ছ সুলতানের শিরচ্ছেদ করতে সফল হয়।”
ষড়যন্ত্রের প্রথম ধাপ হিসাবে এরপর শুরু হলো নৃত্যকলার তালিম। সেইসাথে রাজকুমারী সৈরিন্ধ্রীর তত্ত্বাবধানে রানি কমলা নিজেকে তুর্কি আদব কায়দায় রপ্ত করা শুরু করলেন। এদিকে রণথম্বরের যুদ্ধ তখন মধ্যগগনে। মহারাজ হামীরদেবকে পরাজিত করতে অসফল হয়ে রণথম্বর কেল্লা অবরোধ করলেন আলাউদ্দিন খিলজি। শুরু হলো দীর্ঘ অবরোধ পর্ব।
গর্ভবতী রানি কমলাবতী
==================
এরই মধ্যে দিল্লির সিরি কেল্লায় হারেমে নিজের কক্ষে একদিন মাথা ঘুরিয়ে ভূপাতিত হয়ে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়লেন রানি কমলা। জ্ঞান ফিরবার পর তিনি বিছানায় নিজের মাথার সামনে চিন্তামগ্ন মুখাবয়বে বসে থাকতে দেখতে পেলেন সৈরিন্ধ্রীকে। এরপর তিনি ক্ষীণ দুর্বল কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, “কি ব্যপার রাজকুমারী আপনাকে এতো চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন ? কি হয়েছে ?”
জবাবে মৃদু হেসে সৈরিন্ধ্রী বললেন, “কিছু না মহারানি। এখন আপনি কেমন বোধ করছেন ? সিরি কেল্লার প্রধান হাকিম সাহেব এসেছিলেন আপনার চিকিৎসা করতে। তিনি বলে গিয়েছেন আতঙ্কের কোন কারন নেই। তবে এর সাথে তিনি দিয়ে গিয়েছেন আরেক সংবাদ।” এই পর্যন্ত বলে থামলেন সৈরিন্ধ্রী।
-“কি সেই সংবাদ ? আমাকে বলুন এখনই” উৎকণ্ঠাপূর্ণ কণ্ঠে জিগ্যেস করলেন রানি কমলা।
-“আজ্ঞে মহারানি আপনি হয়তো গর্ভবতী। সম্ভবত সেই কারনেই আপনি হটাতই মাথা ঘুরিয়ে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছিলেন।” নতমস্তকে মৃদু স্বরে বললেন সৈরিন্ধ্রী।
-“না না অসম্ভব। আমার গর্ভে কিনা লালিত হচ্ছে স্মেচ্ছ সুলতানের ঔরসজাত সন্তান। এই দুঃসংবাদ শোনার চেয়ে মৃত্যুও অধিক কাম্য আমার নিকটে। আপনি কি নিশ্চিত হাকিম সাহেব সঠিক কথা বলেছেন।” কাতর কণ্ঠে বললেন রানি কমলা।
আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা শাস্ত্রে নাদিরা বেগমের পারদর্শিতার পরিচয়লাভ
=================================================
-“আমি নিশ্চিত নই মহারানি। তবে এই ব্যপারে নিশ্চিত হবার জন্য একটি প্রাচীন আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা পদ্ধতি সম্বন্ধে অবগত আমি। এর জন্য কয়েকটি বিশেষ উপাদান সহকারে চিত্রকরি তৈলম নামে একটি বিশেষ তরল পদার্থ নির্মিত করতে হবে আমাকে। তারপর সুদ্ধ পানীয় জলের মধ্যে সেই তরল মিশ্রিত করে সেই মিশ্রিত পানীয়ে আপনার ধমনী থেকে সংগৃহীত কয়েক বিন্দু রক্ত মেশাতে হবে। যদি সেই রক্ত লোহিত বর্ণ থেকে পীতবর্ণ আকার ধারণ করে তবে হাকিমের কথামতো আপনাকে গর্ভবতী হিসাবে ধরে নেওয়া হবে। নতুবা নয়।” মন্দ্র কণ্ঠে বললেন সৈরিন্ধ্রী।
-“আপনি আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা শাস্ত্র জানেন ?” বিস্ময়ভরা কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন রানি কমলা।
-পিতার রাজপ্রাসাদে বসবাসকালীন আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা শাস্ত্রে জ্ঞান লাভ করাই ছিল আমার প্রধান শখ” হতাশাভরা কণ্ঠে বললেন সৈরিন্ধ্রী।
-“কিন্তু আয়ুর্বেদিক পরীক্ষায় যদি সত্যিই প্রমানিত হয় যে আমি গর্ভবতী, আমার গর্ভে লালিত হচ্ছে স্মেচ্ছ দুর্বৃত্ত তুর্কি সুলতানের জারজ সন্তান তাহলে তাহলে কোনদিনই ক্ষমা করতে পারবো না নিজেকে আমি। এই অবস্থায় কি করে আমি নিজেকে বিষ কন্যা রূপে প্রস্তুত করবো রাজকুমারী?” অসহায়ভাবে বললেন রানি কমলা।
-“সেজন্য আপনি চিন্তিত হবেন না মহারানি। গর্ভজাত সন্তানকে অঙ্কুরেই বিনাশ করবার আয়ুর্বেদিক ঔষধি চিত্রকরি বটিচূর্ণ নির্মাণ পদ্ধতিও জানা আছে আমার। আমাকে দিন দুয়েক সময় দিন ঔষধি প্রস্তুত করবার। ততদিন আপনি পূর্ণাঙ্গ বিশ্রাম গ্রহণ করুন।”
সেদিনের ঘটনার দিন দুয়েক পরে সন্ধ্যার প্রাক্কালে রানি কমলার শয়নকক্ষে নিঃশব্দে উপস্থিত হলেন রাজকুমারী সৈরিন্ধ্রী। তাঁর দক্ষিণ হস্তে বস্ত্রখণ্ডে আচ্ছাদিত একটি পাত্র। তিনি কক্ষে প্রবেশ করে টেবিলে রাখা একটি পাত্রে কিছুটা পানীয় জল ঢাললেন। তারপর বস্ত্রখণ্ডে আচ্ছাদিত সেই পাত্রটি থেকে ধূলিকণার ন্যায় একমুঠি চূর্ণ জলে মেশালেন তারপর রানি কমলাকে অনুরোধ করলেন নিজের ধমনীর কয়েক বিন্দু রক্ত সেই পানীয় জলে মিশ্রিত করতে। রানি কমলা সন্ত্রস্তভাবে এক ছুরিকার সহায়তায় নিজের দক্ষিণ হস্তের কবজির নিকট কিছুটা অংশ কেটে সেই স্থান থেকে নির্গত রক্ত বিন্দু মেশালেন পানীয়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পানীয় জল পীতবর্ণ আকার ধারণ করলো। তিনি গর্ভবতী এটা প্রমানিত হবার পর লজ্জায়, ঘৃণায় কয়েক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলেন রানি কমলা। এরপর রাজকুমারী সৈরিন্ধ্রীকে দুই বাহুতে জড়িয়ে ধরে অঝোরধারা কান্নায় ভেঙে পড়লেন তিনি। রাজকুমারী সৈরিন্ধ্রী পরম স্নেহ ও মমতায় তাঁর মাথার কেশে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে আবেগপূর্ণ কণ্ঠে বললেন, “দয়া করে আপনি ভেঙে পড়বেন না মহারানি।আপনিযদিসত্যিইআপনারগর্ভেলালিত সন্তানকে ভূমিষ্ঠ হবার পূর্বেই বিনষ্ট করতে চান তবে আমার তৈরি আরেকটি ঔষধি চিত্রকরী বটিচূর্ণ সেবন করতে পারেন আপনি।“ এই পর্যন্ত বলে কয়েক মুহূর্ত থমকে থেকে পুনরায় ইতস্তত কণ্ঠে বললেন সৈরিন্ধ্রী,“তবে এই ঔষধ সেবন করলে দিন কয়েক দুর্বল লাগবে আপনার শরীরআর সন্তান প্রসবের ক্ষমতা চিরতরে হারাবেন আপনি, এসব জেনেও চিত্রকরী বটিচূর্ণ সেবন করতে রাজি আছেন তো আপনি ?’”
রাজকুমারী সৈরিন্ধ্রীর প্রশ্নের উত্তরে রানি কমলা বিষণ্ণ কণ্ঠে বললেন, “অবশ্যই রাজি আমি। আমি চাই না আমার গর্ভে লালিত তুর্কি সুলতানের অবৈধ সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়ে ভবিষ্যতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে নিজের স্মেচ্ছ পিতার মতোই এক অত্যাচারী আর ব্যভিচারী বর্বর লুণ্ঠকে পরিণত হোক।”
এরপর চিত্রকরী বটিচূর্ণ সেবন করলেন রানি কমলা। দিন সাতেক পর পুনরায় দ্বিতীয়বারের পরীক্ষায় যখন পানীয় জল পীতবর্ণ আকার ধারণ করলো না, লোহিত বর্ণই রয়ে গেলো তখন গর্ভপাত করে কলঙ্কের হাত থেকে মুক্ত হয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন রানি কমলা। সেইসাথে তিনি পরিচয় পেলেন আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা শাস্ত্রে রাজকুমারী সৈরিন্ধ্রীর অসাধারণ পারদর্শিতার।
এবারে অবশেষে রাজকুমারী সৈরিন্ধ্রী জানালেন তাঁর ষড়যন্ত্রের অন্তিম পর্বের পরিকল্পনা। এক সন্ধ্যেয় তুর্কি হারেমে রানি কমলার শয়নকক্ষে তাঁর সাথে একান্ত আলাপচারিতায় তিনি বললেন, “মহারানি আমি এমন আয়ুর্বেদিক ঔষধির নির্মাণ পদ্ধতি জানি যা প্রতি নিয়ত কোন ব্যক্তির খাদ্যে মেশালে বিষক্রিয়ার প্রভাবে প্রাথমিকভাবে সেই ব্যক্তি ধীরে ধীরে নিজের স্মৃতি শক্তি হারাতে থাকবে, পরবর্তীকালে তিনি ধিরে ধিরে মানসিক ভারসাম্যও হারাবেন এবং সবশেষে ক্ষুধা-তৃষ্ণার চাহিদা ভুলবেন। এইভাবে আনুমানিক বছর দশেকের ব্যবধানে সেই ব্যক্তি সঠিক পুষ্টির অভাবে আর রক্তাল্পতায় মৃত্যু মুখে পতিত হবেন। ওই ঔষধির নাম অষ্টবীজ চূর্ণ। প্রাচীন এই বিষধর ঔষধির উল্লেখ আচার্য চাণক্যের অর্থশাস্ত্র গ্রন্থে রয়েছে। আমাদের রাজপরিবারের রাজবৈদ্যের নিকট এই বিশেষ ঔষধ নির্মাণ শিখেছিলাম আমি। আমি চাই স্মেচ্ছ সুলতানের খাদ্যে আপনি প্রতিনিয়ত ওই ঔষধ মিশ্রিত করুন। তবে তা সম্ভব হবে তখনই যখন সুলতানকে সম্পূর্ণ রূপে বশ করতে সফল হবেন আপনি। তবে অধিক চিন্তার কোন প্রয়োজন নেই। দিল্লির পুরাতন কেল্লার অধিবাসিনী এক প্রভাবশালী স্মেচ্ছ নারীও বর্তমানে সুলতানের উপর যারপরনাই ক্রুদ্ধ। সেই রমণীকে উস্কানি দিয়ে তাঁকে আমাদের ষড়যন্ত্রে সাহায্য করবার জন্য রাজি করাবো আমি।”
-“কে সেই প্রভাবশালী স্মেচ্ছ রমণী ? কেন তাঁর সাহায্যের প্রয়োজন আমাদের আর নিজে স্মেচ্ছ হয়েও কেনই বাঃ তিনি আমাদের সাহায্য করবেন নিজের সুলতানের বিরুদ্ধে ?” পুনরায় বিস্ময়মিশ্রিত কণ্ঠে জিগ্যেস করলেন রানি কমলা।
জবাবে রহস্যময়ী হাসিমুখে রাজকুমারী সৈরিন্ধ্রী বললেন, “যথাসময়ে তাঁর পরিচয় লাভ করবেন আপনি। তিনি আমাদের সাহায্য করবেন নিজেরই প্রয়োজনে আর অষ্টবীজ চূর্ণ তৈরি করতে হলে প্রয়োজন বিশেষ আটটি জড়িবুটি যার অধিকাংশ এই মুহূর্তে কেবলমাত্র পুরাতন কেল্লার শাহী বাগেই মিলবে।” আগামিকাল আমি আপনাকে নিয়ে যাবো সেই তুর্কি রমণীর নিকটে।” সেরাতের মতো কথকপথন শেষ হলো দুই অভিন্ন হৃদয় সখীর।
মালিকা-এ-জাহানের সাক্ষাৎপ্রার্থী
========================
পরেরদিন সন্ধ্যার প্রাক্কালে সিরি কেল্লার হারেমে রানি কমলার শয়নকক্ষে প্রবেশ করলেন রাজকুমারী সৈরিন্ধ্রী।তাঁর আপাদমস্তক কৃষ্ণকায় বোরখা দ্বারা আচ্ছাদিত।কিছুক্ষণ পশ্চাতেই দুই সখীকেই আপাদমস্তক বোরখা দ্বারা আচ্ছাদিত হয়ে জ্বলন্ত মশাল হস্তে কক্ষত্যাগ করে সিরিকেল্লা ছেড়ে পুরাতন কেল্লার দিকে যেতে দেখা গেল। হারেমের বহু পুরাতন রক্ষিতা নাদিরা বেগম ওরফে রাজকুমারী সৈরিন্ধ্রীকে দেখে তাঁদের পথরোধ করলো না কেল্লার দ্বারে প্রহরারত তুর্কি রক্ষীরা।পুরাতন লালকোট কেল্লায় প্রবেশ করে ক্রমে তাঁরা এগিয়ে গেলেন রাজপুরীর শাহী জেনানা মহলের দিকে।কিছুক্ষণ পর তাঁরা এসে উপস্থিত হলো জেনানা মহলের এক বিশাল কক্ষের সম্মুখে। কক্ষটি দেখেই বোঝা যাচ্ছিল সেটি কোন বিশেষ রমণীর বাসস্থান।কক্ষের দ্বারে অস্ত্র হাতে প্রহরারত তুর্কি রক্ষিণীগণ ওদের পথরোধ করে পরিচয় জানতে চাইতেই রাজকুমারী সৈরিন্ধ্রী আর রানি কমলাবতী বোরখা তুলে নিজেদের মুখমণ্ডল প্রদর্শন করলেন। নাদিরা বেগমকে দেখেই রক্ষিণীরা সসম্ভ্রমে কুর্নিশ করে পথ ছেড়ে সরে দাঁড়ালো। এরপর সৈরিন্ধ্রী কক্ষের সদর দ্বারে করাঘাত করতেই সশব্দে দরজা উন্মুক্ত হলো। কক্ষের ভেতরে চারিপাশ এলাহি ও মহার্ঘ্য আসবাবপত্র দ্বারা সজ্জিত। ভেতরে দাসী পরিবৃতা হয়ে সুসজ্জিত শয্যায় মহার্ঘ্য বস্ত্র আর রকমারি অলঙ্কারে সজ্জিত হয়ে বসে ছিলেন এক বছর তিরিশ ছুঁই ছুঁই তুর্কি রমণী। সেই রমণীর মুখ দর্শন করে তাঁকে চিনতে পেরেই তীব্র বিস্ময়ে শিহরিত হলেন রানি কমলাদেবী। রাজকুমারী সৈরিন্ধ্রী সেই স্মেচ্ছ রমণীর সম্মুখে এসে তুর্কি প্রথায় মাথানত করে তাঁকে কুর্নিশ করে বললেন, “মাননীয়া মালিকা-এ-জাহানকে এই তুচ্ছ দাসির সেলাম।”
হ্যাঁ ইনিই সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির প্রথমা স্ত্রী মালিকা-এ-জাহান ওরফে মেহেরুন্নিসা। আলাউদ্দিনের খুল্লতাত (কাকা) নিহত জালালউদ্দিন খিলজির একমাত্র কন্যা। বয়স প্রায় তিরিশ ছুঁই ছুঁই হলেও এখনও রূপের জৌলুসে বিন্দুমাত্র ঘাটতি হয় নি তাঁর, আর সেই সাথে ঘাটতি হয়নি নিজের পিতার হত্যাকারী আলাউদ্দিন খিলজির উপর তাঁর অন্তরের চরম ঘৃণা আর অফুরন্ত বিদ্বেষ। উল্টে সময়ের সাথে সাথে বৃদ্ধি পেয়েছে তা। বর্তমানে তিনি এক সন্তানের মাতা। তাঁর সেই সন্তানের নাম খিজির খান খিলজি। বর্তমানে তিনি দ্বাদশ কি ত্রয়োদশ বর্ষীয় এক কিশোর হলেও পরবর্তীকালে ইতিহাসের পাতায় ফের ফিরে আসবে এই তুর্কি কিশোরের নাম।
রাজকুমারী সৈরিন্ধ্রী নিজে মালিকা-এ-জাহানকে সেলাম ঠুকবার পর চোখের ইশারায় রানি কমলাদেবীকেও ইশারা করলেন তাঁকে সেলাম করবার জন্য। নিজের সখীর পরামর্শ মেনে রানি কমলাও তাঁর সামনে এগিয়ে এসে কিছুটা ইতস্তত করে শেষে তুর্কি প্রথা অনুসারে মাথানত করে তাঁকে সেলাম জানালেন। ওদের দুই সখীর দিকে কয়েক মুহূর্ত নীরব দৃষ্টি হেনে মালিকা-এ-জাহান দুহাতে করতালি করে গমগমে কণ্ঠে তাঁর কক্ষের দাসীদের নির্দেশ দিয়ে বললেন, “একান্ত”। মালিকা-এ-জাহানের নির্দেশ মেনে দাসীরা কুর্নিশ করে কক্ষ ত্যাগ করলো। এরপর তিনি রাজকুমারী সৈরন্ধ্রীর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রাশভারি কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, “কি ব্যপার নাদিরা বেগম, তুমি হটাৎ এই অসময়ে এতদিন বাদে আমার নিকটে ? আর তোমার সাথে ও কে ? সুলতানের নয়া শিকার বুঝি ?”
ষড়যন্ত্রে সামিল মালিক-এ-জাহান
========================
সৈরিন্ধ্রী কিছুটা ইতস্তত করে মৃদু কণ্ঠে বললেন, “আজ্ঞে সঠিক অনুমান করেছেন আপনি মাননিয়া মালিকায়ে জাহান। উনি গুজরাটের আনহিলওয়ারাপট্টনের প্রাক্তন মহারানি এবং সিরির হারেমের নয়া বাদী কমলাবতী দেবী ওরফে কৌসর বাঈ। বর্তমানে উনি আমার অন্যতম প্রিয় দোস্ত। অনেকদিন আপনার কুশল বার্তা নেওয়া হয় না। তাই আজ আমি কৌসর বাঈকে সাথে নিয়ে এসেছি আপনার কুশল বার্তা নেবার জন্য”
সৈরিন্ধ্রীর কথা শুনে তাচ্ছিল্যভরা হাসি মুখে মালিকায়ে জাহান বললেন, “তুমি তো জানো নাদিরা আমি সবসময় কাজের কথাই পছন্দ করি। অতএব ভণিতা ত্যাগ করে সরাসরি তোমার এখানে আগমনের হেতু জানাও।”
এরপর সৈরিন্ধ্রী ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন, “আজ্ঞে আপনি তো সবই জানেন মাননীয়া মালিকায়ে জাহান। এই বিশাল হারেমে আপনিই আমার একমাত্র শুভ চিন্তক। আপনি না থাকলে সেদিন সুলতানের নির্দেশ তাঁর সেনারা হয়তো আমাকে সদুর মধ্য প্রাচ্য বা আরবের দাস বাজারে বেঁচে দিতো। আপনিই আমার রক্ষা কর্ত্রী। আপনার দুঃখ-কষ্ট, পীড়া আর বেদনা আমারও দুঃখ-কষ্ট, পীড়া আর বেদনা। এতদিন ধরে সুলতানের নানান অত্যাচার মুখ বুজে সয়েছেন আপনি, তবু কোনও প্রতিবাদ করেননি। কিন্তু এভাবে আর কতদিন ?”
সৈরিন্ধ্রীর মর্মভেদী বক্তব্য যেন শেল হয়ে বিঁধল মালিকা-এ-জাহানের হৃদয়ে। কয়েক মুহূর্তের জন্য তাঁর দুই চক্ষুতে ঝিলিক দিলো ক্রোধের বহ্নিশিখা। তিনি দাঁতে দাঁত চেপে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললেন, “ঠিকই বলেছ তুমি নাদিরা। আমি আজও ভুলতে পারি না সেই দিনটার কথা যেদিন তুমি তোমাদের আয়ুর্বেদিক দাবাইয়ের সাহায্যে প্রাণ রক্ষা করেছিলে আমার আউলাদের। নাহলে সুলতানের জল্লাদদের নিক্ষিপ্ত তিরের আঘাতেই মৌত হতো খিজিরের আর ভুলতে পারি না সেই ভয়ানক দিনটার কথা, যেদিন এই প্রাসাদেই আমি নিজের চোখের দেখলাম সেই ভয়ানক দৃশ্যটি। কারা প্রদেশের কেল্লা প্রাসাদে বর্বর আলাউদ্দিন দ্বারা আমার প্রাণাধিক প্রিয় আব্বুজানকে নির্মমভাবে হত্যার সংবাদ আমি আগেই দূত মুখে পেয়েছিলাম। সেদিন কাড়া-নাকাড়ার শব্দ আর আলাউদ্দিনের নামে প্রবল জয়ধ্বনি শুনে রাজপ্রাসাদের সম্মুখের অলিন্দে এসে দেখলাম মূল ফটকের সামনে রক্ষী পরিবৃত হয়ে প্রবেশ করছেন তিনি। তার দুই চোখে যেন খেলা করছে এক নগ্ন হিংস্রতা, তার মুখে খেলা করছে ধূর্ত হায়েনার ন্যায় ক্রূর হাসি। আলাউদ্দিনের চারপাশে দাঁড়ানো তার প্রধান সেনাপতিদের হস্তের ভল্লগুলির সুতীক্ষ্ণ ফলার শীর্ষে গাঁথা আমার পিতার বিশ্বস্ত সর্দার আর সভাসদদের রক্তমাখা ধরহীন গর্দান এবং স্বয়ং আলাউদ্দিনের দক্ষিণ হস্তের ভল্লের শীর্ষদেশে গাঁথা রয়েছে আমার আব্বুজানের রক্ত মিশ্রিত ধরহীন গর্দান। প্রাসাদের সভাকক্ষে প্রবেশ করেই পৈশাচিক উল্লাসে মেতে উঠলেন আলাউদ্দিন এবং তার অনুগামীরা। সেদিনই সেই নরপিশাচ নিজেকে দিল্লির নতুন সুলতান হিসাবে ঘোষণা করলো এবং আমাকে বাধ্য করলো এতো ঘৃণ্য কর্মের পরও তাকে নীরবে সেলাম ঠুকতে। আমি তোমার প্রস্তাবে রাজি নাদিরা। আমি তোমাকে সাহায্য করবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, কিন্তু আমার দুটো শর্ত আছে।”
-“আমাকে বলুন আপনার শর্ত মালিকায়ে জাহান। প্রয়োজনে নিজের প্রাণ দিয়ে হলেও আপনার শর্ত পূরণ করার প্রয়াস করবো।” আবেগপূর্ণ কণ্ঠে বললেন সৈরিন্ধ্রী।
মালিকা-এ-জাহান নিজের ওষ্ঠের কোণে এক চিলতে হাসি ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি ফুটিয়ে বললেন, “আমার প্রথম শর্ত হলো তুমি যদি তোমার ষড়যন্ত্রে ব্যর্থ হও তাহলে যেন ঘুণাক্ষরেও আমার নাম প্রকাশে আনবার কৌশিস করো না। করলে আমার চেয়ে খারাপ আর কেউ হবে না। আর দ্বিতীয় শর্ত, তুমি যদি সফল হও তাহলে আলাউদ্দিনের মৃত্যুর পর আমার আউলাদ খিজির খান হবে দিল্লির পরবর্তী সুলতান। এই ব্যপারটা নিশ্চিত করতে হবে তোমাকে।”
এখানেই যবনিকাপাত হলো আলাউদ্দিন বধ ষড়যন্ত্রের প্রথম ধাপের।
#Subhojit_Roy
রণথম্বরের যুদ্ধ এবং হামীর পত্নীর জহর পালন
=================================
ইতিমধ্যেই সমগ্র দিল্লি জুড়ে সংবাদ রটে গেলো রণথম্ববরের মহাযুদ্ধে অবশেষে বিজয়ী হয়েছেন সুলতান আলাউদ্দিন। তুর্কি বাহিনীর সিংহ বিক্রমের সম্মুখে খড়কুটোর মতো ধূলিসাৎ হয়েছে চৌহানদের যাবতীয় প্রতিরোধ। যুদ্ধভূমিতে অপরাজেয় তুর্কি অসির আঘাতে শিরচ্ছেদ হয়েছে মহারানা হামীরদেব চৌহানের। কিন্তু আফসোস এই বিজয়ের পরেও তুর্কি সুলতানের নিকট অধরাই রয়ে গেছেন শহীদ রানা হামীরদেবের রূপবতী অর্ধাঙ্গিনী মহারানি রঙ্গাদেবী। যাকে বন্দিনী করে নিজের হারেমের শূন্যস্থান পূর্ণ করবার জন্য দীর্ঘদিন ধরে এতো যুদ্ধ করলেন তুর্কি সুলতান, দিনের পর দিন ধরে রণথম্বর কেল্লা অবরোধ করলেন সেই তিনি মহারানি রঙ্গাদেবী যুদ্ধের অন্তিম দিনে নিজের পতি মহারাজের পরাজয় সুনিশ্চিত উপলব্ধি করতে পেরে শয়তান হামীরদেব চৌহানের কুপরামর্শে নিজের সখীদের নিয়ে জহরব্রত পালন করলেন আর তার ফলে তুর্কি সুলতানকে কিনা ফিরতে হচ্ছে সম্পূর্ণ শূন্য হাতে।
রণথম্বরের যুদ্ধে আলাউদ্দিন খিলজির জয়লাভ এবং রানা হামীরদেবের স্ত্রী রানি রঙ্গাদেবীর জহরব্রত পালনের সংবাদ পেলেন সিরির হারেমে বন্দিনী বাঘেলা রানি কমলাবতী। বীরবর হামীরদেবের মৃত্যুতে ব্যাথিত হলেও রানি রঙ্গদেবীর জহরব্রত পালনের সংবাদে গর্বিত ও অনুপ্রাণিত হলেন তিনি। দ্বিপ্রহরের শেষে সূর্য যখন পশ্চিম দিগন্তে ধিরে ধিরে ঢলে পড়ছে এবং সিরি কেল্লার শাহী মসজিদ থেকে চড়া সুরে বৈকালিক নামাজ পাঠের আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হতে শুরু করেছে ঠিক সে সময়েই সিরি কেল্লার বহিঃরপ্রান্তে আচমকা শোনা গেল সহস্র কাড়া-নাকাড়ার তীব্র আওয়াজ আর সুলতান খিলজির নামে জয়ধ্বনি। সৈরিন্ধ্রীর সাথে হারেমের বেগম মহলে নিজের কক্ষ থেকে বেরিয়ে প্রাসাদের অলিন্দে এলেন রানি কমলাবতী। অলিন্দে দণ্ডায়মান হয়ে তিনি আলাউদ্দিনের যে বীভৎস রূপ প্রত্যক্ষ করলেন এর কিছুটা বর্ণনা ইতিপূর্বে তিনি মালিকায়ে জাহানের মুখে শুনলেও নিজের চোখে সেদিনই প্রথম দেখলেন।
আলাউদ্দিনের দিল্লি প্রত্যাবর্তন আর বর্বর রূপের প্রদর্শন
=========================================
রানি কমলাদেবী সন্ত্রস্তভাবে দেখলেন হাবসি মামেলুক রক্ষী পরিবৃত হয়ে এক বিশাল ঘোটকীর পৃষ্ঠে সওয়ার হয়ে কেল্লার প্রধান ফটক অতিক্রম করছেন তুর্কি সুলতান আলাউদ্দিন। লৌহ জালিকায় আবৃত সুলতানের পোশাকের বাম প্রান্তে কোষবদ্ধ বক্র অসি এবং সুলতানের দক্ষিণ হস্তে মুষ্টিবদ্ধ এক বিশালকায় ভল্ল আর সেই ভল্লের ফলায় বিদ্ধ হয়ে রয়েছে কোন এক অভাগা যোদ্ধার রুধির মিশ্রিত নরমুণ্ড। ঘৃণ্য কাফেরদের বিরুদ্ধে আরেকটি যুদ্ধ জয়ের উন্মাদনায় এক পৈশাচিক উল্লাস যেন ঝিলিক দিচ্ছে বিশাল ছাগ দাঁড়ির ফাঁক দিয়ে নির্গত সুলতানের দন্তপাটিতে। সুলতানের পশ্চাৎদেশে দণ্ডায়মান অশ্ব শকটগুলি পরিপূর্ণ কাফের রাজা হামীরের রাজধানি থেকে লুণ্ঠিত রাশি রাশি অমূল্য রত্নরাজিতে। সেই ভয়াবহ দৃশ্য সহ্য করা যে কোন সভ্য ব্যক্তির পক্ষে অসম্ভব আর রানি কমলাবতীর মতো তুর্কি রাজধানিতে সদ্য আগত এক কোমল হৃদয়া ভারতীয় নারীর পক্ষে তো আরই অসম্ভব। সেদিইন সেই দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেই সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছিলেন রানি কমলাবতী। পরে হারেমের শয়নকক্ষে তাঁর জ্ঞান ফিরলে সৈরিন্ধ্রীর নিকট জানতে পেরেছিলেন যে আলাউদ্দিনের বর্শায় বিদ্ধ খণ্ডিত নরমুণ্ডুটি রানা হামীরের ভ্রাতা ও সেনাপতি বিরামদেব চৌহানের।
ধিরে ধিরে রাত নামলো। যুদ্ধ জয়ের উল্লাসে উৎসবে মাতোয়ারা হলো সম্পূর্ণ দিল্লি নগর। আলোয় আলোয় উদ্ভাসিত হলো সিরি কেল্লা। রাজকুমারী সৈরিন্ধ্রীর মুখে রানি কমলা সংবাদ পেলেন আর কিছুক্ষণের মধ্যেই হারেমের নাচঘরে সভাসদ আর সেনাপতিদের নিয়ে হাজির হবেন তুর্কি সুলতান। আজ প্রায় সারারাত ধরে চলবে জশন আর শরাব পান। রানা হামীরের অর্ধাঙ্গিনী রানি রঙ্গদেবীকে হরণ করতে ব্যর্থ বিমর্ষ সুলতানকে খুশি করবার জন্য নৃত্য পরিচালনার জন্য বাছাই করা হয়েছে হারেমের শ্রেষ্ঠতম দশজন সুন্দরী নর্তকী রক্ষিতাকে। এই সংবাদ দিয়ে রাজকুমারী সৈরিন্ধ্রী ইঙ্গিতপূর্ণ কণ্ঠে বলে উঠলেন, “অবশেষে সময় হয়েছে দিল্লির বর্বর যবন সুলতানের বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিশোধ গ্রহণের ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনার প্রথম ধাপ রুপায়নের। আপনি নিজেকে প্রস্তুত করুন মহারানি। আমি নিজে আপনাকে এমনভাবে সুসজ্জিত করবো যে নাচঘরে আজ রাতে কামুক স্মেচ্ছ সুলতান আপনার দিক থেকে কিছুতেই নিজের দৃষ্টি সরাতে পারবেন না।”।
কথা বলতে বলতেই হটাতই সৈরিন্ধ্রী লক্ষ্য করলেন যে রানি কমলাবতী নীরবে নত মস্তকে বসে রয়েছেন এবং তাঁর দুই চক্ষু অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠেছে। এই দৃশ্য দেখে তিনি রানি কমলার সামনে এসে তাঁর কাঁধে হাত রেখে স্নেহপূর্ণ কোমল কণ্ঠে বললেন, “এই মুহূর্তে আমি আপনার মানসিক অবস্থাটা উপলব্ধি করতে পারছি মহারানি। গুজরাটের মতো একটি সমৃদ্ধশালী রাজ্যের প্রাক্তন রানির পক্ষে এহেন এক অতিশয় দুর্বৃত্ত তুর্কি সুলতানের মনোরঞ্জন চূড়ান্ত মানহানিকর। কিন্তু আমরা নিরুপায়। দুর্বৃত্ত সুলতানকে তার পাপের উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করবার এটিই একমাত্র উপায় এবং এই মুহূর্তে এই ষড়যন্ত্রে সফলভাবে রূপায়িত করতে পারেন কেবলমাত্র আপনিই। ভারতবর্ষের অগণিত অসহায় হিন্দু রমণীদের সুরক্ষিত ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে কেবলমাত্র আপনার উপর। পারবেন না আপনি সফল হতে এই ষড়যন্ত্রে ? পারবেন না আপনি নৃশংস তুর্কি আততায়ীকে তার পাপের উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করতে ?”
রানি কমলাবতী বাষ্পরুদ্ধ ক্ষীণ কণ্ঠে কোনমতে বলে উঠলেন, “হ্যাঁ আমি পারবো রাজকুমারী। আপনার জন্য, আমার নিজের জন্য, তুর্কিদের হারেমে বন্দিনী এবং ইতিমধ্যেই আরব ও মধ্য প্রাচ্যে যৌনদাসী হয়ে পাচার হওয়া অগণিত হিন্দু রমণীদের ন্যায় বিচারের জন্য আমাকে সফল হতেই হবে।” এই পর্যন্ত বলেই রানি কমলা সৈরিন্ধ্রীকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে অঝোরধারা কান্নায় ভেঙে পড়লেন।
সিরির নাচঘরে আলাউদ্দিনের মুখোমুখি রানি কমলাবতী
========================================
তখন প্রায় মধ্যরাত। নাচঘরের মেহফিল জমে উঠেছে রীতিমত। আলাউদ্দিন খিলজির সভাকবি ও সঙ্গীতকার আমির খুস্রুর খায়াল, তারানার সঙ্গীত মূর্ছনায় আর বাদ্যকারদের সেতার, তবলা, শানাই আর পাখোয়াজের ধ্বনির সাথে সাথে হারেমের বাছাই করা জনা দশেক স্বল্প বাসিনী নর্তকীদের নুপুরের নিক্কন ধ্বনিতে পরিপূর্ণ নাছঘর। নাচঘরের দক্ষিণ প্রান্তে একটি রাজকীয় তক্তপোশে অর্ধ শায়িত অবস্থায় আসীন সুলতান আলাউদ্দিন। সুলতানের দক্ষিণ হস্তে শোভা পাচ্ছে স্বর্ণ নির্মিত পান পাত্র। সেই পান পাত্র সুরায় পরিপূর্ণ। একটি সুরার পাত্র শেষ হলেই নর্তকীরা আরেকটি সুরার পাত্র ধরিয়ে দিচ্ছেন আলাউদ্দিনের হাতে। নেশার আমেজে খিলজির দুই চক্ষু অর্ধ মুদ্রিত। মাঝেমধ্যে নর্তকীদের নাচ দেখে উৎফুল্ল হয়ে তিনি “শাবাশ”, “বহৎখুব” বলে তারিফ করলেও যেন তেমন যোশ অনুভব করছেন না। কারণ সেই সময় সুলতানের মন জুড়ে বিরাজ করছে কেবলমাত্র রণথম্বরের সুন্দরী মহারানি রঙ্গাদেবীকে হারানোর বেদনা।
ঠিক এহেন সময়েই নুপুরের ঝুমঝুম ধ্বনিতে চতুর্দিক মুখরিত করে নাচঘরে প্রবেশ করলেন গুজ্জর রানি কমলাবতী দেবী। অঙ্গে সূক্ষ্ম মলমলের বস্ত্র, সর্বাঙ্গে স্বর্ণালঙ্কার আর পদযুগলে স্বর্ণ নির্মিত নুপুর জোড়া, সীমান্তদেশে মহার্ঘ্য হিরে-মুক্ত খচিত কণ্ঠহার আর রানির ওষ্ঠ রাঙা জবা পুষ্পের ন্যায় রক্তবর্ণ রঙের অধররঞ্জনীতে। রানি কমলাবতীকে এহেন রূপে নাচঘরে প্রবেশ করতে দেখেই তুর্কি সুলতান যেন নির্বাক হয়ে পড়লেন। বিস্ফারিত দৃষ্টিতে নিস্পলক নেত্রে চেয়ে রইলেন গুজ্জর রানির পানে। নাচঘরের সঙ্গীত, বাদ্য এবং অনান্য নর্তকীদের নৃত্য পরিচালনাও গেল থমকে। কক্ষে প্রবেশ করে রানি কমলা মন্দ্র গতিতে এগিয়ে এলেন তক্তপোষে আসীন আলাউদ্দিনের দিকে। তারপর সুলতানের সামনে রক্ষিত সুরার পাত্রটি তুলে ধিরে ধিরে সেটা থেকে মদিরা ঢাললেন সুলতানের পান পাত্রে। এরপর নিজের রক্তবর্ণ নরম ওষ্ঠের কোনে এক চিলতে ভুবন মোহিনী হাসি ফুটিয়ে পান পাত্রটি সুলতানের সম্মুখে এগিয়ে ধরে মৃদু নরম কণ্ঠে বললেন, “সপ্ত দুনিয়ার মালিক তথা হিন্দুস্থান বিজেতা মহামান্য সুলতানকে কৌসর বাঈের সেলাম। আপনার নিকট আমার একটি আর্জি আছে সুলতান।”
আলাউদ্দিন মোহময় দৃষ্টিতে রানি কমলার দিকে তাকিয়ে বললেন, “হুকুম করো কৌসর বাঈ। তোমার জন্য জান লুটিয়ে দিতে প্রস্তুত আমি।”
-আজ রাতে কেবলমাত্র আমি একাই আপনার নিকট আমার নৃত্যকলার প্রদর্শন করতে চাই সুলতান।” ছলনা পূর্ণ স্মিত হাস্যমুখে বললেন রানি কমলা।
-“জরুর পূরণ করা হবে তোমার শর্ত।” উচ্ছ্বসিত আবেশপূর্ণ কণ্ঠে বললেন আলাউদ্দিন।
এরপর আলাউদ্দিনের নির্দেশে নাচঘর ত্যাগ করলেন বাকি নর্তকীরা। পুনরায় শুরু হুলো বাদ্যকর এবং সঙ্গীতকারদের বাজনা আর সঙ্গীতের মূর্ছনা । আর সেই সাথে শুরু হলো রানি কমলার সম্মোহিনী নৃত্য প্রদর্শন। শেষ রাতের দিকে আকণ্ঠ সুরায় নেশাগ্রস্ত আলাউদ্দিন নিজের যৌন লালসার আবেগকে আর বশে রাখতে না পেরে তক্তপোশ ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের দুহাতে রানি কমলাকে তুলে ধরে নিজের অঙ্ক শায়িনী করে নিয়ে গেলেন হারেমের শয়নকক্ষে।
এইভাবে মাত্র দুই বছরের প্রচেষ্টায় আলাউদ্দিন খিলজিকে নিজের রূপ-সৌন্দর্য আর রতি ক্রিয়ায় সম্পূর্ণরূপে বশ করে খিলজির দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ উপপত্নীতে নিজেকে পরিণত করতে সফল হলেন রানি কমলাবতী। এরই মধ্যে নিজের সখী রাজকুমারী সৈরিন্ধ্রীর কাছ থেকে বিষধর আয়ুর্বেদিক ঔষধ “অষ্টবীজ চূর্ণ” তৈরির প্রক্রিয়া সহ আরও নানান গুরুত্বপূর্ণ আয়ুর্বেদিক ঔষধ তৈরির প্রক্রিয়া শিখে নিলেন। কিন্তু এতকিছু করেও ষড়যন্ত্রের আসল ধাপ পরিপূর্ণ হলো না। কারণ তখনও রাজমহলের রসুই খানার দায়িত্ব অর্পিত ছিল আলাউদ্দিন খিলজির দ্বিতীয় স্ত্রী (উপপত্নী নন) মাহারু বেগমের তদারকিতে। ইতিমধ্যেই একদিন এমন একটি ঘটনা ঘটলো যার ফলে আলাউদ্দিন খিলজির বর্বরতা আরেকবার নগ্নভাবে প্রস্ফুটিত হয়ে পড়ল।
চিতোরের যুদ্ধ এবং পদ্মাবতী উপাখ্যান
============================
একদিন সিরির সভাকক্ষে আসীন আলাউদ্দিন খিলজি তার দরবারিদের সাথে নানান বিষয়ে আলোচনা করছিলেন। কথা প্রসঙ্গে খিলজির হারেমে বসবাসকারী বিভিন্ন রমণীদের রূপ-সৌন্দর্যের বিষয় নিয়ে চর্চা শুরু হয়েছিল। আলাউদ্দিন গর্বভরে ঘোষণা করলেন যে তার হারেমের মতো অপরূপা রূপসী তনয়াদের হাট দুনিয়ার আর কোন সুলতানের হারেমে নেই। বিশ্বের আর কোন স্থানে রানি কমলাবতীর চেয়েও অধিকতর রূপবতী রমণীও আর কোথাও নেই। এমন সময় তার এক সভাসদ মনসুর উঠে দাঁড়িয়ে রহস্যপূর্ণ ভঙ্গিতে প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছিলেন যে দিল্লি থেকে মাত্র ৫৮৪ কিলোমিটার দূরে খাস রাজপুতানার বুকে অবস্থিত মেবার রাজ্যের রাজধানি চিতোরগড় কেল্লায় রয়েছেন এমন এক অসামান্যা রূপসী রমণী যার রূপ সৌন্দর্য রানি কমলাবতীর চেয়েও অধিকতর শ্রেষ্ঠ। এরপর আলাউদ্দিন মনসুরকে তার বক্তব্যের স্বপক্ষে প্রমাণ দিতে বললে মনসুর সিরির সভাকক্ষে হাজির করলেন এক রাজপুত চিত্রকরকে (ঐতিহাসিক মতে তিনি চিত্রকরই ছিলেন, চলচ্চিত্রে দেখানো কোন সাধু সন্ত বা পুরোহিত নন)। তিনি এসে নিজেকে চিতোরের সদ্য অপসারিত প্রধান চিত্রকর চেতন রাঘব বলে পরিচয় দিলেন এবং আলাউদ্দিনকে প্রদর্শিত করলেন তার অঙ্কিত একটি তৈল চিত্র। সেই তৈল চিত্রে এমন এক রূপবতী রমণীর চিত্র ছিল যা দেখেই কামনার অগ্নি স্ফুলিঙ্গে কেঁপে উঠলেন আলাউদ্দিন। চেতনের নিকট জানতে পারলেন ইনি মেবারের মহারাওয়াল রতন সিংহের দ্বিতীয় স্ত্রী রানি পদ্মাবতী। রানি পদ্মাবতীকে হরণ করবার বাসনায় তৎক্ষণাৎ সেনা সজ্জিত করে চিতোরের উদ্দেশ্যে ধাবিত হলেন তিনি। বহুদিন ধরে চলল সেই যুদ্ধ। প্রথমে পরাজিত হয়েও পরে ছলনার আশ্রয় গ্রহণ করে যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে রাওয়াল রতন সিংহকে হত্যা করে চিতোর কেল্লার অভ্যন্তরে প্রবেশ করে রণথম্বরের মতোই চূড়ান্ত হতাশ হলেন আলাউদ্দিন। যাকে হরণ করবার জন্য এতো দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ, এতো রক্তক্ষয়, এতো পরিশ্রম সেই চিতোরের রানি পদ্মাবতী তাঁর ৬০০ জন সখীকে নিয়ে ইতিমধ্যেই জহরব্রত পালন করে দিল্লির কামুক তুর্কি সুলতানকে ফাঁকি দিয়ে চিরতরে পলায়ন করেছেন ভানুলোকে।
মোতি মহলের শাহী হামামঘরে রানি কমলার নয়া ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা
==================================================
রাজপুতানার বীরাঙ্গনা রমণীদের নিজের অঙ্কশায়িনী করবার ঘৃণ্য প্রয়াসে দ্বিতীয়বারের জন্য চূড়ান্ত ব্যর্থ হয়ে প্রবল ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে সম্পূর্ণ চিতোরগড় কেল্লা ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে পুনরায় দিল্লি প্রত্যাবর্তন করলেন আলাউদ্দিন খিলজি। এদিকে সিরি কেল্লায় দীর্ঘদিন ধরে ষড়যন্ত্রের খেলায় যুক্ত থেকে ততদিনে রীতিমত পাকা খেলোয়াড় হয়ে উঠেছেন রানি কমলাবতী দেবী। চিতোরের দীর্ঘ যুদ্ধের অবসানের পরে দিল্লি ফিরে তিনি যেন আরও বেশি করে জড়িয়ে পড়লেন রানি কমলাবতীর ভুবনমোহিনী সম্মোহিনী জালে। রানি কমলার সেবায় সন্তুষ্ট হয়ে আলাউদ্দিন তাঁর বসবাসের জন্য স্থির করলেন কেল্লার হারেমের সবচেয়ে বিলাসবহুল মোতি মহল। নিজের সবচেয়ে পছন্দের উপপত্নীকে শুধু মোতি মহল দান করেই সন্তুষ্ট হলেন না সুলতান। তিনি তার ভবিষ্যৎ অভিযান আর লুণ্ঠন পর্ব সহ দিল্লির রাজমহলের নানান আভ্যন্তরীণ বিষয়েও রানি কমলার পরামর্শ নিতে শুরু করলেন। চতুর রানি কমলা বুঝতে পারলেন তাঁর ষড়যন্ত্রের দ্বিতীয় ধাপ প্রায় সম্পূর্ণ হবার পথে।
তখন গ্রীষ্মকাল। দিল্লির প্রবল দাবদাহ থেকে নিস্তার পেতে এবং তার প্রিয় উপপত্নীর সঙ্গ লাভের আশায় এক নির্জন দ্বিপ্রহরে আলাউদ্দিন এলেন মোতি মহলে। মোতি মহলের পশ্চাতে ছিল শাহী হামামঘর (স্নানঘর)। পরিচারিকা মারফৎ সুলতানের আগমনের সংবাদ আগাম লাভ করে ছলনাময়ী রানি কমলা স্বল্প বাসিনী হয়ে সেই স্নানঘরের শান বাঁধানো মর্মরপ্রস্তর দিয়ে বাঁধানো শীতল কুণ্ডে নেমে অবগাহন স্নান পর্ব শুরু করলেন। সুলতান হামামঘরে প্রবেশ করতেই রানি কমলা সুলতানের পানে তাঁর মায়াবী দৃষ্টির জাল নিক্ষেপ করে দক্ষিণ হস্তের ইশারায় সুলতানকে অনুরোধ করলেন কুণ্ডে নামতে। সম্মোহিত ব্যক্তির ন্যায় আলাউদ্দিন নিজের শাহী বস্ত্র ত্যাগ করে নিজেকে স্নানের বস্ত্রে আচ্ছাদিত করে নামলেন কুণ্ডে। ইতিমধ্যেই রানি কমলার পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী তাঁর এক পরিচারিকা একটি স্বর্ণ পট্টিকায় সুরার পাত্র নিয়ে স্নানঘরে প্রবেশ করে নীরবে নতমস্তকে এসে দাঁড়ালেন কুণ্ডের সম্মুখে। রানি কমলা সেই পট্টিকা থেকে সুরার পান পাত্রটি তুলে নিয়ে এগিয়ে ধরলেন আলাউদ্দিনের দিকে। নরম মায়াবী কণ্ঠে বললেন, “শরাব পান করুন সুলতান। আপনার মনোরঞ্জনের জন্য এই বিশেষ সুগন্ধিযুক্ত শরাব আমি নিজে তৈরি করেছি।”
বিনা বাক্যব্যয়ে হাসিমুখে সুরার পাত্রটি তুলে নিলেন খিলজি। রানি কমলার তৈরি বিশেষ আয়ুর্বেদিক সুরার পাত্রে একটি চুমুক দিয়েই তার ঝাঁঝালো নেশা, অমৃতের ন্যায় স্বাদ আর অপূর্ব সুগন্ধের মোহে মুহূর্তের মধ্যে বুঁদ হলেন আলাউদ্দিন। তিনি রানি কমলার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তার আগেই রানি কমলা নিজের দক্ষিণ হস্তের তর্জনী আলাউদ্দিনের রুক্ষ ওষ্ঠের উপর রেখে মায়াবী কণ্ঠে বললেন, “আপনার প্রতি আমার একটি বিশেষ আর্জি আছে মাননীয় সুলতান-এ-হজরত। আপনি ইজাজত দিলে আপনার সামনে তা পেশ করবো।” আলাউদ্দিন তার ছাগ দাঁড়ির ফাঁক দিয়ে নিজের ৩২ পাটি দন্ত বিকশিত করে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললেন, “ইজাজত দিলাম কৌসর বিবি। বল তুমি কি উপহার চাও আমার কাছে ?”
-“সুলতান আমি লক্ষ্য করছি সারা বছর ধরে অবিরত জঙ্গ লড়বার ফলে এবং নিয়মিত পর্যাপ্ত বিশ্রাম আর উপযুক্ত পুষ্টিকর আহারের অভাবে দিন কে দিন আপনার তবিয়ৎ ভীষণভাবে বিগড়ে যাচ্ছে। আপনি যদি ইজাজত দেন তাহলে আমি নিজে রসুই খানার দায়িত্ব গ্রহণ করে হার রোজ আপনার জন্য পুষ্টিকর আর সুস্বাদু খানা বানাতে পারি।” কোমল কণ্ঠে বললেন রানি কমলাবতী।
-“বহৎ খুব কৌসর বিবি। কিন্তু রসুই খানার দায়িত্ব তো আমার দ্বিতীয় বিবি মাহারু বেগমের সামলাচ্ছেন।” কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত স্বরে বললেন আলাউদ্দিন।
-“সুলতান, কেন জানি না আমার মনে সন্দেহ জেগেছে যে আপনার দ্বিতীয় বিবি মাহারু বেগম আপনাকে অপসারিত করে নিজের আউলাদ কুতুবউদ্দিন মুবারককে দিল্লির পরবর্তী সুলতান হিসাবে মসনদে আসীন করতে চাইছেন। এবং সম্ভবত সেই কারণেই মাহারু বেগম আপনার খাবার এবং সেবা সুশ্রস্রার ব্যপারে একদমই নজর দিচ্ছেন না।” রহস্যময় কণ্ঠে বললেন রানি কমলা।
একথা শুনেই বিদ্যুৎ পৃষ্ঠ ব্যক্তির ন্যায় চমকে উঠলেন আলাউদ্দিন। কেল্লার বাইরে যুদ্ধভূমিতে নানান ছল চাতুরীতে যতটা অভিজ্ঞ আর ক্ষুরধার ছিলেন আলাউদ্দিন খিলজি, কেল্লার অভ্যন্তরে জেনানা মহলের পারিবারিক কূটনীতি আর ছল-চাতুরীতে ঠিক ততটাই অনভিজ্ঞ ছিলেন তিনি। তিনি রানি কমলার চাল উপলব্ধি করতে না পেরে তীব্র বিস্ময়ে বলে উঠলেন, “তৌবা তৌবা কৌসর বিবি এসব কি বলছ তুমি ? এতদিন তো জানতাম খুল্লতাত জালালউদ্দিনকে হত্যা করার কারণে মালিকা-এ-জাহান আমাকে পছন্দ করেন না। কিন্তু তা বলে মাহারু বেগম ?”
এবারে কিছুটা অভিমানী আর ক্ষুণ্ণ স্বরে রানি কমলা বলে উঠলেন, “ঠিক আছে সুলতান। আমার কথা বিশ্বাস করতে হবে না আপনাকে। কেনই বা করবেন বিশ্বাস ? আমি তো আর আপনার বিবি নই। শুধুমাত্র একজন উপপত্নী। আমার কাজ হলো কেবলমাত্র আপনার মনোরঞ্জন আর সেবা করা”।
এবারে আলাউদ্দিন কিছুটা থতমত খেয়ে বলে উঠলেন, “ঠিক আছে, ঠিক আছে কৌসর বিবি। আমার উপর গুসসা করো না। তুমি যা চাইছো তাই হবে। আগামীকাল থেকে রসুইখানার দায়িত্ব সম্পূর্ণ তোমার। কিন্তু তুমি তো আগে কাফের ছিলে। তাই তুর্কি পাকশালা সম্বন্ধে যতদিন পর্যন্ত না সম্পূর্ণ উয়াকিবহাল হচ্ছ ততদিন রসুই খানায় মাহারু বেগম সাহায্য করবে তোমাকে। আর আগামী মাসে আমার নির্দেশে দাক্ষিণাত্য অভিযানে যাচ্ছে তোমারই রাজ্যের পূর্বতন অধিবাসী মালিক কাফুর।”
এভাবে নিজের ছলনায় দিল্লির রসুই ঘরের দায়িত্ব অবশেষে নিজের হাতে পেলেন রানি কমলাবতী। পূর্ণ হলো তাঁর ষড়যন্ত্রের দ্বিতীয় ধাপ, কিন্তু তবুও ষড়যন্ত্র সম্পূর্ণ সফল হলো না তাঁর কারণ মাহারু বেগমের নির্দেশে বেগমের পরিচারিকারা পাকশালায় তাঁর উপর কড়া নজরদারি চালাতে লাগলো। রানি কমলার তৈরি প্রত্যেকটি খাদ্য মাহারু বেগমের নিয়োজিত খাদ্য পরীক্ষকরা ভাল করে পরীক্ষা করে তবেই তা পাঠাতো সুলতানের কক্ষে। এতো ত্যাগ স্বীকার করেও নিজের ষড়যন্ত্র সফল হলো না দেখে এবারে মানসিকভাবে কিছুটা বিপর্যস্ত হয়ে পড়লেন রানি কমলা।
মালিক কাফুরের দাক্ষিণাত্য অভিযান এবং লুণ্ঠন পর্ব
======================================
এদিকে সুলতানের নির্দেশে এবারে সমৃদ্ধশালী দাক্ষিণাত্যে লুণ্ঠন অভিযান শুরু করলো তুর্কি বাহিনী। দাক্ষিণাত্য অভিযানে তুর্কি বাহিনীর পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করলেন বহুকাল পূর্বে রানি কমলাবতীকে হরণ করবার অভিপ্রায়ে তার গুজরাট অভিযানের সময় নিজের একান্ত যৌন সঙ্গী হিসাবে হাজার স্বর্ণ দিনার দিয়ে ক্রয় করা খোঁজা মালিক কাফুরকে। দাক্ষিণাত্য অভিযানে কাকাতিয়া, হোয়শালা, পাণ্ড্য সহ যাবতীয় হিন্দু রাজ্যগুলিতে সফলভাবে লুণ্ঠন কার্য সম্পন্ন করলেন মালিক কাফুর। কাকাতিয়া রাজ্যের রাজধানি ওরাগুল্লু (ওয়ারাঙ্গল) কেল্লার প্রধান কালা থোরনাম শিব মন্দির, হোয়শালা রাজ্যের ধার্মিক রাজধানি হ্যালেবিরুর ১০৮ টি মন্দির, বেলুরের হোয়শালেশ্বর শিব মন্দির, মাদুরাইয়ের সুপ্রাচীন আর পবিত্র মীনাক্ষী আম্মান মন্দির সহ দক্ষিণের বহু গুরুত্বপূর্ণ প্রাচীন মন্দিরগুলি সম্পূর্ণরূপে ধ্বস্ত আর লুণ্ঠিত করে, বহু নিরীহ জনসাধারণের গণহত্যা করে সনাতনীদের রক্ত রুধিরে দাক্ষিণাত্যের ভূমি সিঞ্চিত করে উত্তরের পর দাক্ষিণাত্যেও সদর্পে ইসলামের বিজয়যাত্রা নির্ঘোষিত করে দীর্ঘ সফল অভিযান সম্পন্ন করে অগাধ রত্নরাজি সমেত দিল্লি প্রত্যাবর্তন করলেন মালিক কাফুর। এমনিতেই মালিক কাফুরের যৌন রতিক্রিয়ার ফলে তার প্রতি শুরু থেকেই বেশ কিছুটা দুর্বল ছিলেন আলাউদ্দিন। এবারে সমরভূমিতেও কাফুরের অসাধারণ কুশলতা, নৃশংসতা আর বর্বরতার পরিচয় পেয়ে আহ্লাদিত খিলজি তার কৃতদাস কাফুরকেই নিজের বাহিনীর প্রধান সেনাপতি পদে নিযুক্ত করলেন। এরপর ধিরে ধিরে দিল্লির যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রকগুলো পরিচালনার দায়িত্বও আলাউদ্দিন কাফুরের উপর ন্যস্ত করতে শুরু করলেন।
সূর্য কুণ্ডের ভগ্ন মন্দিরে শপথ গ্রহণ রানি কমলাবতীর
======================================
ওদিকে আলাউদ্দিনের গ্রাস থেকে নিজের সতীত্ব রক্ষা করবার জন্য চিতোরের রানি পদ্মাবতীর মহা জহরব্রতের সংবাদ কানে এসেছে তাঁর। রুসুইখানায় মাহারু বেগমের নজরদারির ফলে প্রাথমিকভাবে কিছুটা মানসিক বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়লেও ভিনদেশী স্মেচ্ছ আততায়ীদের হাত থেকে স্বধর্ম এবং সতীত্ব রক্ষার জন্য রানি পদ্মাবতীর অভূতপূর্ব ত্যাগের সংবাদ শ্রবণ করে একদিকে যেমন সতীমাতা পদ্মাবতীর প্রতি গর্বে হৃদয় ভরে উঠলো রানি কমলাবতীর তেমনি অপরদিকে আলাউদ্দিনকে তার কৃতকর্মের উচিত সাজাদানের প্রতিজ্ঞার সংকল্পও আর দৃঢ় হলো তাঁর। বহুদিন বাদে এক নির্জন দুপুরে ছদ্মবেশ ধারণ করে রানি কমলা তাঁর পুরাতন সখী রাজকুমারী সৈরিন্ধ্রীকে নিয়ে গেলেন দিল্লির অনতিদূরে অবস্থিত প্রাচীন সূর্য কুণ্ডে। চৌহান রাজাদের তৈরি সূর্যের কুণ্ডের পশ্চিমঘাটের সম্মুখে তখনও বিরাজমান ছিল দিল্লির একমাত্র হিন্দু শিব মন্দির। যদিও অনাদর আর অবহেলার ফলে এককালের বৈভবশালী সেই সুপ্রাচীন শিব মন্দির বর্তমানে প্রায় ভগ্নস্থুপে পরিণত হয়েছে এবং তুর্কিদের আক্রমণের ফলে মন্দিরের শিব লিঙ্গটিও প্রায় ভগ্নপ্রাপ্ত, তবুও রানি কমলা এবং রাজকুমারী সৈরিন্ধ্রী সূর্য কুণ্ডে স্নান পর্ব সেরে দীর্ঘদিন পরে নিজেদের সাথে আনা শুদ্ধ সনাতনী বস্ত্র ধারণ করে ধীর পদক্ষেপে প্রবেশ করলেন মন্দিরের অভ্যন্তরে। ঘন আধারছন্ন মন্দিরের ভেতরে তখন বিভিন্ন রকমের কীট পতঙ্গ আর নিশাচর বাদুড়দের বাস। রানি কমলার নির্দেশে সৈরিন্ধ্রী মশাল জ্বালতেই কিচকিচ শব্দ করে প্রবল বেগে ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে গেল বেশকিছু বাদুড়। ধূলিকণা, মাকড়শার জাল আর আগাছার স্তর পেরিয়ে মশালের আবছা আলো-আধারিতে সন্তর্পণে ভগ্নপ্রায় বিস্মৃত শিবলিঙ্গের নিকটে এসে আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না রানি কমলাবতী।
মূর্তির সামনে নতনাজু হয়ে বসে, যুক্তকরহস্তে প্রবল কান্নায় ভেঙে পড়লেন তিনি। তীব্র আবেগে নিজের মনে মনেই বলে উঠলেন, “হে দেবাদিদেব মহাদেব, হে প্রভু আর কত পরীক্ষা নেবেন আপনি আমার ? আপনি রণথম্বরের রানি রঙ্গাদেবী আর চিতোরের রানি পদ্মাবতীকে নিজেদের সতীত্ব, সম্ভ্রম আর স্বধর্ম রক্ষার সুযোগ দান করলেন কিন্তু আমাকে কেন সেই সুযোগ দান থেকে বিরত থাকলেন আপনি ? কেন আমাকে ঘৃণ্য স্মেচ্ছ যবনদের গণিকালয়ে তাদের রক্ষিতায় পরিণত করলেন ? কি মহা অপরাধ আর পাপ কর্ম করেছিলাম আমি, যার জন্য এতো কঠিন সাজা দিলেন আমায় প্রভু ? আর সাজা যখন দিলেনই তখন কেন আমার প্রতিশোধ গ্রহণের পথে পদে পদে বাধার সৃষ্টি করছেন আপনি ? আজ যখন রুসুইখানার নিয়ন্ত্রণ হাতে এলো আমার তখন কেন মাহারু বেগমকে নজরদার হিসাবে নিয়োগ করলেন আপনি ? এখন কি করবো আমি ? দয়া করে আমাকে অভীষ্ট লক্ষের সঠিক পথের দর্শন করান প্রভু, যাতে বর্বর স্মেচ্ছ সুলতানকে তার পাপের উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করতে আমি।”
এদিকে রানি কমলাকে এইভাবে অশ্রু ধারায় ভেঙে পড়তে দেখে সৈরিন্ধ্রী দ্রুত তাঁর সামনে এসে নিজের প্রিয় সখীকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, “দয়া করে শান্ত হন মহারানি। এভাবে ভেঙে পড়বেন না। স্বয়ং মহাদেব আপনাকে ষড়যন্ত্র সফল করার সঠিক মার্গ দর্শন করাবেন।”
অন্তিম ষড়যন্ত্রে সাফল্য লাভের পথের সন্ধান
=================================
সেদিন রাতেই রাজকুমারী সৈরিন্ধ্রীর কথা ফলে গেল অদ্ভুতভাবে। বিস্তর ভাবনা চিন্তার পরে নিজের ষড়যন্ত্রের অন্তিম ধাপ পূর্ণ করবার জন্য চতুর রানি কমলাবতীর মনের গহনে উদয় হলো আরেকটি পরিকল্পনা। তিনি উপলব্ধি করতে পারলেন যে এই মুহূর্তে আলাউদ্দিনের সবচেয়ে বিশ্বস্ত পাত্র হলেন একদা নিজেরই পুরাতন রাজ্যের অধিবাসী মালিক কাফুর। কাফুর এখন তুর্কি সুলতানের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি। দিল্লির সব রাজমহলের সব বিভাগে তার অবাধ গতিবিধি। কাফুরকে দিয়ে একবার যদি আলাউদ্দিনের মনে মাহারু বেগম সম্বন্ধে সন্দেহের বীজ বপন করা যায়, তবেই সম্পূর্ণ হবে ষড়যন্ত্রের অন্তিম ধাপ। খাদ্যে অষ্টবীজ চূর্ণ মিশ্রণ করে ধীরে ধীরে শয়তান তুর্কিকে ঠেলে দেওয়া যাবে এক যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুর পথে। এই সত্য উপলব্ধি করবার সাথে সাথেই রানি কমলা স্থির করে নিলেন তাঁর ষড়যন্ত্রের পরবর্তী পদক্ষেপ। মালিক কাফুরকে নিজের বশে আনবার জন্য শুরু করলেন পুরনো চালের মোড়কে নতুন পরিকল্পনা।
#Subhojit_Roy
মালিক কাফুরকে ষড়যন্ত্রে সামিলের প্রয়াস
==============================
দাক্ষিণাত্যে সফল অভিযান সম্পূর্ণ করে দিল্লি প্রত্যাবর্তন করলেন মালিক কাফুর। সাথে আনলেন দাক্ষিণাত্যের অসহায় হিন্দু রাজ্যগুলি থেকে বলপূর্বক হরণ করে নিয়ে আসা অগাধ ধনরাশি আর অগণিত রূপবতী রমণী। দাক্ষিণাত্য অভিযানে নিজের যৌন সাথী কাফুরের অভূতপূর্ব পরাক্রম, বর্বরতা আর নৃশংসতার পরিচয় লাভ করে আলাউদ্দিন তার পরেরদিনই দিল্লির সভাকক্ষে একটি বর্নাড্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আলাউদ্দিন তাকে দিল্লির সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতি পদে নিযুক্ত করলেন। এরপর দক্ষিণের কাফের রাজ্যগুলির সম্পদ আর সম্ভ্রম হরণের খুশিতে দিন কয়েক ধরে সমগ্র দিল্লি নগর জুড়ে চলল গণ উৎসব আর খানাপিনা। এরই মধ্যে একরাতে নিজের বিশ্বস্ত সেনা আর পরামর্শদাতাদের সাথে আনন্দ উৎসব আর খানাপিনা করে মদ্যপ অবস্থায় নিজের বাসভবনে ফিরলেন কাফুর। রাত শেষ হয়ে তখন ধীরে ধীরে ভোর হচ্ছে। পূর্ব দিগন্তে উঁকি মারছেন সূর্যদেব। ঊষাকালের স্মিগ্ধ নরম আলো কাফুরের ভবনের অভ্যন্তরে এসে প্রতিফলিত হচ্ছে। ঠিক এমন সময় হটাতই কাফুরের ভবনের বাতায়নের উপর এসে আসীন হলো এক শুভ্র কবুতর (পায়রা)। তখনকার দিনে যোগাযোগের প্রধান ব্যবস্থা ছিল এই বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত কবুতর বা কপোতপাখি। দিল্লির সুলতান, জেনানা মহল, গুপ্তচর থেকে সেনাবাহিনী সবাই দ্রুত নিজেদের সংবাদ অপর প্রান্তে পৌঁছে দেবার জন্য কপোত ব্যবহার করতেন। পরে মোগল আমলেও এই একই রীতি অনুসরণ করা হতো।
অভিজ্ঞ কাফুরের চোখ কপোতটিকে একঝলক দেখেই অনুধাবন করতে পারলো যে এটি কোন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বিশেষ শাহী কপোত। ধীরে ধীরে কপোতের সামনে এগিয়ে এলেন কাফুর। কপোতটি উড়ে পালালো না। কাফুর দেখলেন কপোতটির বাম পায়ে সুক্ষ সুতো দিয়ে বাঁধা একটি মসলিনের বস্ত্রখণ্ড। অধীর আগ্রহে কাফুর কপোতটিকে দুহাতে তুলে ধরে সন্তর্পণে ওর পা থেকে সুতো দিয়ে বাঁধা বস্ত্রখণ্ডটি উদ্ধার করলেন। এরপর কপোতটিকে পুনরায় উড়িয়ে দিয়ে নিজের ভবনের শয়নকক্ষে এসে বস্ত্রখণ্ডটি খুলে দেখলেন। যা ভাবেছিলেন ঠিক তাই। এটি আসলে একটি পত্র। পত্রটিতে কোন অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি কাফুরকে সাবধান করেছেন তার বিরুদ্ধে সংগঠিত হতে চলা একটি গভীর ষড়যন্ত্রের ব্যপারে।

পত্রটিতে লেখা, “মাননীয় সেনাপতি হুজুর-এ-আলা খোঁজা মালিক কাফুরকে আমার সেলাম। এই মুহূর্তে পত্রটি লাভ করে আপনি হয়তো আমার পরিচয় জানবার প্রয়াস করছেন। চিন্তা করবেন না খুব শীঘ্রই আপনি আমার পরিচয় লাভ করবেন। এখন শুধু এইটুকুই জেনে রাখুন আমি আপনার একজন শুভাকাঙ্ক্ষী। দিল্লির রাজনীতিতে আপনার ধুমকেতুর ন্যায় উত্থান পর্ব প্রত্যক্ষ করে এই মুহূর্তে দিল্লির রাজপুরীর অন্তরালে সুলতান হজরতের বহু প্রভাবশালী ব্যক্তি আপনার বিরুদ্ধে প্রবল ঈর্ষান্বিত। তবে এদের সবাইকেই এই মুহূর্তে ছাপিয়ে গেছেন সুলতানের দ্বিতীয় স্ত্রী মাহারু বেগম এবং তাঁর ভ্রাতা আমির-ই-মজলিশ আল্প খান। মাহারু বেগম তাঁর ভ্রাতা আমির-ই-মজলিশ আল্প খানের সাথে ষড়যন্ত্রে করে প্রথমে আপনাকে হত্যা করে এবং অতঃপর স্বয়ং সুলতানকেই নিজেদের পথ থেকে চিরতরে সরিয়ে নিজের জ্যৈষ্ঠ পুত্র শাদি খানকে দিল্লির নতুন সুলতান এবং কনিষ্ঠ পুত্র কুতুবউদ্দিন মুবারক শাহকে দিল্লির শাহী বাহিনীর সেনাপ্রধানের পদে আসীন করতে চাইছেন। এখন হয়তো আমার দেওয়া তথ্য আপনার কাছে মিথ্যে এবং অবাস্তব বলে বোধ হচ্ছে কিন্তু খুব দ্রুত আপনি আমার দাবির যথাযথ প্রমাণ পেয়ে যাবেন। ইতি আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী।”

পত্রটি পরে কিছুক্ষণের জন্য স্তম্ভিত হয়ে গেলেন মালিক কাফুর। আমির-ই-মজলিশ আল্প খানের ব্যবহার সত্যিই নিদারুণ সন্দেহজনক। আজ থেকে বেশ কয়েক বছর পূর্বে মুলতানের নিকট মঙ্গোলদের বিরুদ্ধে অভিযানের সময় মুলতান প্রদেশের শাসক জুনেদের সুন্দরী ভগিনী মাহারু বেগমের সৌন্দর্যের জালে আটকা পড়েন আলাউদ্দিন। জুনেদের নিকটে তার ভগিনীকে বিবাহের প্রস্তাব প্রেরণ করেন খিলজি। নিজের সুন্দরী ভগিনী মাহারু বেগমকে আলাউদ্দিনের হাতে সঁপে দিয়ে সুলতানের নেক নজরে আসেন জুনেদ। পরবর্তীকালে জুনেদ নিজের ভগিনীর সহায়তায় দিল্লির দরবারে অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তি হয়ে ওঠেন। ১২৯৮ সালে গুজরাট বিজয়ের পর আলাউদ্দিন তাকে আমির-ই-মজলিশ উপাধি দান করে মুলতানের সাথে সাথে গুজরাটের শাসক হিসাবেও মনোনীত করেন। সেই সাথে জুনেদের নয়া নামকরণ হয় আল্প খান। বর্তমানে মালিক কাফুরের পরে এই আল্প খানই সুলতানের নিকট দিল্লির দরবারে দ্বিতীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি। আল্প খান এবং তার ভগিনী মাহারু বেগমের উচ্চাকাঙ্ক্ষা অজানা নয় মালিক কাফুরের, এবং বর্তমানে কাফুরই তাদের একমাত্র পথের কাঁটা। অতএব পত্রটি পরে যারপরনাই চিন্তিত হলেন তিনি।

কি করবেন ভাবছেন ঠিক এহেন সময় তার বাতায়নের নিকট ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ শুনে মালিক কাফুর চমকিত হয়ে সেদিক পানে চাইতেই দেখতে পেলেন সেই কপোতটি পুনরায় ফিরে এসেছে। হয়তো গোপন পত্রের লেখক কাফুরের জবাবী পত্র লাভের আশাতেই কপোতটিকে ফেরত পাঠিয়েছেন। ক্ষণিক চিন্তা করে নিজের টেবিলের সামনে এলেন কাফুর। দোয়াত আর কলম বের করে সম্মুখে রাখা একটি বস্ত্রখণ্ড টেনে এনে তাতে লিখলেন, “আমার শুভ চিন্তা করার জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু আমি কেন বিশ্বাস করবো আপনার সাবধানবাণী ? আপনার অভিযোগের স্বপক্ষে কি প্রমাণ আছে ? এছাড়া আমি তো আপনার পরিচয় সম্বন্ধেও সম্পূর্ণ অজ্ঞ। কে আপনি ? কি আপনার পরিচয় ? আপনি কি করে অবগত হলেন যে আল্প খান আর মাহারু বেগম আমাকে এবং মাননীয় সুলতান-হজরতকে হত্যার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে ? আপনার সাহস থাকলে পর্দার অন্তরাল থেকে আত্মপ্রকাশ করে সামনে এসে আলোচনা করুন আমার সাথে।” এই পর্যন্ত লিখে কাফুর পত্রটি মুড়ে পুনরায় সুতিকা খণ্ড দিয়ে সেটি বেঁধে দিলেন কপোতের বাম পায়ে। এরপর পুনরায় উড়িয়ে দিলেন কপোতটিকে।

যথাসময়ে কাফুরের পত্র সমেত কপোত এসে উপস্থিত হলো সিরি কেল্লার জেনানা ভবনে রানি কমলার বাসভবন মোতি মহলে। পত্রটি পাঠ করে স্বস্তির হাসি হাসলেন রানি কমলা। এতো সহজেই তাঁর এই ঔষধ যে কাজে দেবে তা নিজেও ভাবতে পারেননি তিনি। মালিক কাফুর এবং মাহারু বেগম ও আল্প খানের উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর ব্যক্তিগত রেষারেষির ব্যপারে সম্পূর্ণভাবে অবগত ছিলেন তিনি। এখন মাহারু বেগমকে সরিয়ে নিজের পথ নিষ্কণ্টক করতে প্রয়োজন ছিল এই রেষারেষির সুযোগ নিয়ে মালিক কাফুরের মনে মাহারু বেগমের বিরুদ্ধে সন্দেহের বীজ বপন করা। এই কাজে প্রাথমিকভাবে সম্পূর্ণ সফল তিনি। এদিকে সুলতান আলাউদ্দিনের নিকট থেকে তিনি সম্প্রতি জানতে পেরেছেন আলাউদ্দিনের দ্বিতীয়বার দেবগীরি আক্রমণ করবার সিদ্ধান্তের কথা। আলাউদ্দিনের এবারের দেবগিরি অভিযানের উদ্দেশ্য সম্পদ লুণ্ঠন নয়।
মালিক কাফুরের দেবগিরি আক্রমণ এবং রাজকুমারী জাত্যপল্লীকে হরণ
===================================================
সম্প্রতি গুপ্তচর মারফৎ দেবগিরির বর্তমান রাজা রামচন্দ্রের অপরূপা রূপসী কন্যা রাজকুমারী জাত্যপল্লীর রূপ সৌন্দর্যের সংবাদ এসেছে আলাউদ্দিনের নিকট। এমনিতেই রঙ্গাদেবী আর পদ্মিনীকে হারিয়ে কুঞ্চিত ছিল খিলজির মন, এখন রাজকুমারী জাত্যপল্লীর সংবাদ শুনেই পুনরায় যেন আলাউদ্দিনের শরীরের কামনার আগুন জ্বলে উঠলো এক সুপ্ত আগ্নেয়গিরির ন্যায়। দ্বিতীয়বার দেবগিরি আক্রমণের বাহানা হিসাবে তিনি রাজা রামচন্দ্রের ন্যায় পত্র প্রেরণ করে গত সাত বছরের বকেয়া রাজস্ব কর বাবদ প্রায় দুই কোটি স্বর্ণমুদ্রা দাবি করলেন।

স্বভাবতই অতোগুলো স্বরনমুদ্রা রাজস্ব কর প্রদান করা সম্ভব হলো না রাজা রামচন্দ্রের পক্ষে। এদিকে আলাউদ্দিনের রুদ্ররোষ থেকে নিজের রাজ্য দেবগিরি যেনতেন প্রকারে রক্ষা করতে একটি ঘৃণ্য চাল চাললেন রাজা রামচন্দ্র। তিনি নিজের গুপ্তচর মারফৎ একটি গোপন পত্র প্রেরণ করলেন দিল্লিতে আলাউদ্দিনের নিকট। সেই পত্রে লিখলেন যে, “মাননীয় সুলতানকে দেবগিরি স্থিত তাঁর বিশ্বস্ত দাসের বিনম্র প্রণাম। নিতান্ত বাধ্য হয়েই আমি সুলতানকে একথা জানাচ্ছি যে গত সাত বছর ধরে আমার পুত্র রাজকুমার সিমহানের প্রবল আপত্তির ফলেই আপনাকে আপনার প্রদেয় কর দিতে অপারগ হয়েছি। আমি এখন বৃদ্ধ হয়েছি সুলতান। রাজসিংহাসনে আসীন থাকলেও রাজ্যে আজ আমার সেই পূর্বের প্রভাব নেই। বর্তমানে রাজকুমার সিমহানই রাজ্য পরিচালনার যাবতীয় দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। আপনি যদি দেবগিরিতে সেনা প্রেরণ করে দেবগিরির কোনরূপ ক্ষতি সাধন না করে রাজকুমার সিমহানকে অপসারিত করে পুনরায় আমার পূর্বের ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে পারেন তাহলে আমি আমার একমাত্র কন্যা রাজকুমারী জাত্যপল্লীকে আপনার হারেমে সমর্পিত করবো।”
এই পত্র পেয়েই আলাউদ্দিন নিজের কেল্লায় এক জরুরি সভার আয়োজন করলেন। সেই সভায় উপস্থিত হলেন মালিক কাফুর এবং আল্প খান সহ অনান্য প্রভাবশালী সর্দাররা। স্বভাবতই যুদ্ধের নেতৃত্ব নিজের কাঁধে নেবার আগ্রহ প্রকাশ করলেন মালিক কাফুর। কাফুরের দাবির বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ জানিয়ে আল্প খানও সুলতানের নিকট দরবার করলেন তাকেই যুদ্ধের নেতৃত্বদানের জন্য। আলাউদ্দিন খিলজি পড়লেন প্রবল বিড়ম্বনায়। একদিকে নিজের প্রিয়তম মালিক কাফুর অপরদিকে নিজের দ্বিতীয় বেগম মাহারুর ভ্রাতা আল্প খান। শেষপর্যন্ত দুজনের কাঁধেই সমান দায়িত্ব ভাগ করে এক বিশাল তুর্কি বাহিনী সমেত তাদের প্রেরণ করলেন মালওয়া এবং দেবগিরি অভিযানে। সেই অভিযানে মালিক কাফুরের বিরুদ্ধে পদে পদে অসহযোগিতা করলেন আল্প খান। এমনকি সুযোগমতো ছোটখাটো অন্তর্ঘাত করতেও পিছপা হলেন না। তবে নিজের চতুর বুদ্ধি, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব আর দেবগিরির দেশদ্রোহী রাজা রামচন্দ্রের সহায়তায় অবশেষে যুদ্ধে জয়লাভ করলেন কাফুর। দেবগিরির রাজকুমার সিমহনের যাবতীয় প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে দেবগিরির রাজধানিতে প্রবেশ করলো কাফুরের স্মেচ্ছ তুর্কি বাহিনী। পরাজিত রাজকুমার সিমহন তাঁর একমাত্র ভগিনী রাজকুমারী জাত্যপল্লীকে নিয়ে পলায়ন করবার প্রয়াস করলেন দক্ষিণ মহারাষ্ট্রে। কিন্তু নিজের পিতা রাজা রামচন্দ্রের গুপ্তচরের নিকট পূর্বেই সংবাদ পেয়ে পথিমধ্যেই নিজের ৩০ সহস্র বিশাল তুর্কি বাহিনী নিয়ে তাঁদের চতুর্দিক থেকে অবরুদ্ধ করলেন মালিক কাফুর। শেষপর্যন্ত নিজের প্রিয়তম ভ্রাতা রাজকুমার সিমহনের প্রাণের বিনিময়ে তুর্কি আততায়ীদের হাতে নিজেকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হলেন রাজকুমারী জাত্যপল্লী। নিজের সন্তানকে বিতাড়িত করে আর নিজের কন্যাকে তুর্কি দস্যুদের হাতে সঁপে দিয়ে পুনরায় দেবগিরির রাজসিংহাসনে আসীন হলেন ক্রূর রাজা রামচন্দ্র। তবে এবারে দেবগিরির উপর নজর রাখতে অধিকৃত মালওয়ার নতুন তুর্কি শাসক আইনুল মুল্ক মুলতানিকে দেবগিরির রাজপ্রাসাদে রেখে এলেন মালিক কাফুর। এদিকে প্রাণ হাতে করে কোনমতে কাকাতিয়া রাজ্যে পলায়ন করে মহারাজ প্রতাপরুদ্রদেবের (রানি রুদ্রমাদেবীর নাতি) আতিথ্য গ্রহণ করলেন সর্বহারা রাজকুমার সিমহন। অবশেষে দীর্ঘ যুদ্ধযাত্রা সম্পন্ন করে দিল্লির দরবারে প্রত্যাবর্তন করলেন কাফুর। সাথে আনলেন যুদ্ধজয়ের স্মৃতি স্বরূপ দেবগিরির শৃঙ্খলাবদ্ধ রূপসী রাজকুমারী জাত্যপল্লীদেবীকে। যদিও বনশালীর পদ্মাবত সিনেমায় দেবগিরির বিরুদ্ধে আলাউদ্দিনের প্রথম যুদ্ধের সময়ই রাজকুমারী জাত্যপল্লীকে বন্দিনী করে দিল্লি আনার ভুয়ো ইতিহাস দেখানো হয়েছিল। আমির খুস্রু এবং ইসামির মতে মালিক কাফুরের দ্বিতীয় দেবগিরি আক্রমণের সময়ই রাজকুমারী জাত্যপল্লীকে বন্দিনী করে দিল্লি নিয়ে আসা হয়েছিল।
রানি কমলার সাক্ষাৎ প্রার্থী কাফুর
========================
দিল্লি ফিরে বিমর্ষ কাফুর দিল্লির রাজসভায় দেবগিরির যুদ্ধে আল্প খানের বিশ্বাসঘাতকতা আর অসহযোগিতার অভিযোগ করলেন সুলতান আলাউদ্দিনের নিকট। দেবগিরির রাজকুমারী জাত্যপল্লীকে হরণের আনন্দে আত্মহারা আলাউদ্দিন কাফুরের অভিযোগকে স্বভাবতই আমল দিলেন না তেমন। এরফলে আল্প খানের বিরুদ্ধে আরও ক্ষুব্ধ ও অসহিষ্ণু হয়ে পড়লেন কাফুর। এহেন মহার্ঘ্য সুযোগের অপেক্ষাতেই যেন দিন গুনছিলেন রানি কমলা। দিন কয়েকের ব্যবধানে পুনরায় এক ভোরে রানি কমলার কপোত এলো কাফুরের ভবনে তাঁর পত্র নিয়ে। কাফুর দেখলেন সেই পত্রে লেখা রয়েছে, “আমি আপনাকে আগেই সাবধান করেছিলাম আমির-ই-মজলিশ আল্প খান এবং তার ভগিনী মাহারু বেগমের ষড়যন্ত্রের ব্যপারে। কিন্তু তখন বোধকরি আপনি আমার কথায় তেমন গুরুত্ব দেননি। উল্টে আমার অভিযোগের সত্যতা প্রমাণের জন্য আপনি আমার সাথে মুখোমুখি সাক্ষাৎ করতে চেয়েছিলেন। আমি আপনার প্রস্তাবে রাজি। আজ রাতে মোতি মহলে আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করবো। তবে আপনাকে একাকি আসতে হবে। আপনার অবগতে জানাই কেল্লায় আমার পরিচারিকারা গোপনে আপনার উপর নজর রাখবে। অতএব বিশ্বাসঘাতকতার প্রয়াস করলে সাক্ষাৎ তো দুরস্ত ভবিষ্যতে আর কোন প্রকার সহায়তায় পাবেন না আপনি আমার নিকট থেকে।”
রাত তখন মধ্য যামিনী। আধার রাতের নিশিতে আছন্ন সমগ্র সিরি কেল্লা। ঠিক এমন সময় নিজের সর্বাঙ্গ কৃষ্ণকায় বোরখা দ্বারা আচ্ছাদিত করে অত্যন্ত সন্তর্পণে নিজের ভবন থেকে বেরিয়ে এলেন মালিক কাফুর। একবার চেয়ে দেখলেন চারিপাশে। তাকে কেউ অনুসরণ করছে না এই ব্যপারে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হয়ে মশালের আলোয় আলোকিত সিরি কেল্লার অলিন্দ দিয়ে নিঃশব্দে পদচারণা করে এসে উপস্থিত হলেন মোতি মহলের সম্মুখে। মোতি মহলের সদর দ্বারে মৃদু করাঘাত করতেই খুলে গেল দ্বার। দ্বারের অপরপ্রান্তে দণ্ডায়মান নাদিরা বেগম কুর্নিশ করে স্বাগত জানালেন খোঁজা মালিক কাফুরকে। তিনি মোতি মহলের বৈঠকখানা কক্ষে প্রবেশ করতেই দেখতে পেলেন তার দিকে পেছন ফিরে রঙের পাত্র আর তুলি সমেত একটি সুক্ষ বস্ত্রখণ্ডে মর্মর তৈল চিত্র অঙ্কিত করছেন এক যুবতী। যুবতীর চারিপাশে দণ্ডায়মান জনা কয়েক পরিচারিকা তাঁকে সহায়তা করতে ব্যাস্ত। প্রবল আগ্রহে মালিক কাফুর বলে উঠলেন, “কে আপনি মতোরমা ? কি ব্যপারে আলোচনা করবার জন্য গোপন পত্র মারফৎ আমাকে মোতি মহলে ডেকে পাঠিয়েছেন ? আমার আর সুলতানের বিরুদ্ধে সাজিশে কারা যুক্ত আছে ?”
মালিক কাফুরের প্রশ্নবাণ শেষ হতেই চিত্র অঙ্কন স্থগিত করে তার দিকে পেছন ফিরে তাকালেন যিনি তাঁকে দর্শন করেই তীব্র বিস্ময়ের অভিঘাতে চমকে উঠলেন কাফুর। কোনমতে ক্ষীণ কণ্ঠে বলে উঠলেন, “একি কৌসর বাঈ আপনি ? আপনিই তাহলে মোতি বেগমের রানি সাহেবা ?”
কাফুরের প্রশ্নের জবাবে নিজের ওষ্ঠে তির্যক হাসি ফুটিয়ে রানি কমলাবতী বলে উঠলেন, “খোঁজাবন্দ মালিক কাফুরকে কৌসর বাঈের সেলাম। দেবগিরির যুদ্ধের পূর্বে আমিই আপনাকে ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে সাবধান করে খত প্রেরণ করেছিলাম। কিন্তু তখন আপনি আমার কথায় তেমন গুরুত্ব দেননি। এখন নিশ্চয়ই অনুধাবন করতে পারছেন আমার সাবধানবাণীর গুরুত্ব ?”
কাফুর কিছুটা উত্তেজিতভাবে দাঁতে দাঁত ঘষে কর্কশ কণ্ঠে বলে উঠলেন, “হারামখোর বেইমান আল্প খান। ওকে উচিত শিক্ষা প্রদান করবো আমি।”
-“আমির-ই-মজলিশ তো শতরঞ্জের মোহড়া মাত্র। পর্দার অন্তরালে আসল খিলাড়ি তো অন্য কেউ খোঁজাবন্দ।” রহস্যময় কণ্ঠে বলে উঠলেন রানি কমলা দেবী।
-“কে তিনি ? কে সেই বেইমান ? তুরন্ত আমাকে তার নাম জানান রানি সাহেবা”-উত্তেজিত ক্রুদ্ধ কণ্ঠে জিগ্যেস করলেন কাফুর।
এবারে মুহূর্ত খানেক নীরব থেকে আচমকা রানি কমলা বলে উঠলেন, “আপনি খুব ভালমতোই চেনেন তাকে। তিনি আর কেউ নন আমির-ই-মজলিশের ভগিনী তথা সুলতানের দ্বিতীয় বেগম সাহেবা মাহারু। একদিকে নিজের ভাইজানকে ব্যবহার করে আপনাকে সরাতে চাইছেন তিনি, অপরদিকে সুলতানকে হত্যা করে নিজের আওলাদ শাদি খানকে নতুন সুলতান করতে চাইছেন।”
রানি কমলার কথা শুনে ভয়ানক ক্রুদ্ধ কাফুর আচমকা নিজের অসি কোষমুক্ত করে শূন্যে উত্থলিত করে গর্জন করে বলে উঠলেন, “বেইমান আল্প খান, আল্লাহর কসম তোমাকে আর মাহারু বেগমকে আমি নিজের হাতে কাতিল করবো।”
রানি কমলা ক্রোধন্মত্ত কাফুরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মৃদু হাস্যমুখে নরম কণ্ঠে বললেন, “ধীরে খোঁজাবন্দ ধীরে। মাহারু বেগম আর আমির-ই-মজলিশ এখনও যথেষ্ট শক্তিশালী। ওদের ওপর সরাসরি আক্রমণ করলে আপনি সুলতানের বিষ নজরে পড়তে পারেন।”
-“তাহলে আমি এখন কি করবো রানি সাহেবা ?” কিছুটা অসহায়ভাবে জিগ্যেস করলেন কাফুর।
-“আপনি এখন সুলতানের সামনে আমির-ই-মজলিশ এবং মাহারু বেগমের আসল চরিত্র এবং অভিপ্রায় ফুটিয়ে তুলে সুলতানের নেক নজর থেকে তাদের নিচে নামিয়ে কোণঠাসা করবার প্রয়াস করুন। তারপর একবার আমির-ই-মজলিশ নিজের পদ মর্যাদা হারালে সুযোগ বুঝে কোন যুদ্ধক্ষেত্রে অন্তর্ঘাত করে তাকে হত্যা করুন। ওদিকে জেনানা মহলের মাহারু বেগমের বিশ্বাসঘাতকতার উপযুক্ত সাজার ব্যবস্থা আমি করবো।” নিজের ওষ্ঠের কোণে এক চিলতে রহস্যময় হাসি ফুটিয়ে বললেন রানি কমলা।
এর আগেও রানি কমলাবতীর অসাধারণ রূপ-সৌন্দর্যের বর্ণনা শুনেছেন কাফুর। এখন তা চাক্ষুষ দর্শন করে এবং রানি কমলার সুমিষ্ট মধুর বাক চাতুর্যে মুগ্ধ হয়ে তাঁর ছলনার ফাঁদে পা দিয়ে নিজের ভবনে ফিরে এলেন কাফুর।
অন্তিম ষড়যন্ত্রে রূপদান
==================
এরপর সেরাতে মোতি মহল ছেড়ে নিজের ভবনে ফিরে গেলেন মালিক কাফুর। দিন দুয়েক বাদে এক রাতে সুলতান আলাউদ্দিনের আলিশান শয়নকক্ষে তার বিছানায় সুলতানের সাথে মিলিত হলেন কাফুর। গভীর অভিমানী কণ্ঠে তিনি সেদিন আলাউদ্দিনকে বলেছিলেন, “মাননীয় সুলতান-এ-হজরত, আমি আপনাকে এতো ভালবাসি, আপনার জন্য নিজের জান কবুল করতেও সদা প্রস্তুত, কিন্তু তবুও আপনি আমার থেকেও আমির-ই-মজলিশ আল্প খানকেই অধিক ভরসা করেন। হয় আল্প খান থাকবে আর না হয় আমি। এবারে আমাকে জঞ্জির মুক্ত করুন সুলতান।”
স্বভাবতই নিজের প্রিয় সেনাপতি তথা যৌন সাথী মালিক কাফুরের অভিমানী অভিযোগ শুনে নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারলেন না আলাউদ্দিন। আমির-ই-মজলিশ আল্প খানকে তার পদ থেকে অপসারিত করে পুনরায় তাকে মুলতানে পাঠিয়ে দিলেন, আর সেই সাথে মাহারু বেগমকে গৃহ বন্দি করবার আদেশনামা জারি করলেন।
সুলতানের আদেশনামা কার্যকরী হবার পরে সেরাতে রাজকুমারী সৈরিন্ধ্রী মোতি মহলে প্রবেশ করে রানি কমলার দিকে তাকিয়ে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে উঠলেন, “মাননীয়া মহারানি, আপনার জন্য একটি অত্যন্ত জরুরী সুখবর আছে।”
-“সুখবর ? স্মেচ্ছদের এই হারেমের বন্দি শালায় কি আর সুসংবাদ থাকতে পারে। আমার জীবন থেকে যাবতীয় সুসংবাদ সেদিনই মুছে গেছে যেদিন আমার কন্যা দেবালার অন্নপ্রাশনের অনুষ্ঠানের কালরাত্রিতে শয়তান বিধর্মী স্মেচ্ছরা আমাকে বলপূর্বক হরণ করেছিল। তবুও বলুন শুনি কি সেই সুসংবাদ।” কিছুটা হতাশা মিশ্রিত বিষাদঘন কণ্ঠে বললেন রানি কমলা।
-“মহারানি সুলতান আদেশনামা জারি করেছেন মাহারু বেগম এবং আল্প খানের বিরুদ্ধে। তার আদেশনামা অনুযায়ী আল্প খান নিজের আমির-ই-মজলিশ পদ হারিয়েছেন এবং মাহারু বেগমকে নিজের শিশামহলে গৃহবন্দী করবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয় সুলতান নিজের আমাকে বলে পাঠিয়েছেন যে আগামীকাল থেকে রসুই খানার পরিচালনার যাবতীয় দায়িত্ব আপনার এবং এমনকি মাহারু বেগমকে তার কুকর্মের জন্য গৃহ বন্দি করবার হুকুমনামা শোনানোর দায়িত্বও সুলতান আপনারই উপর ন্যস্ত করেছেন। এতো বছর পর অবশেষে সফল হতে চলেছে আপনার বিষ কন্যা হবার ষড়যন্ত্র। এবারে অন্তিম সময় উপস্থিত বর্বর সুলতানকে তার কুকর্মের চরম শাস্তি প্রদানের।” কোন রকমে এক নিশ্বাসে কথাগুলি বলে গেলেন রাজকুমারী সৈরিন্ধ্রী।
সৈরিন্ধ্রীর বক্তব্য শেষ হতেই অশ্রুশিক্ত চোখে দুহাতে তাঁকে জড়িয়ে ধরে অঝোর কান্নায় ভেঙে পড়লেন রানি কমলা। সেই অবস্থাতেও সৈরিন্ধ্রী আবেগপূর্ণ কণ্ঠে বললেন, “একি মহারানি এতো খুশির সংবাদটি শ্রবণ করেও আপনি কাঁদছেন ?”
-এ আমার শোকের কান্না নয় রাজকুমারী, এ হচ্ছে আনন্দাশ্রু। এতকাল পরে অবশেষে দেবাদিদেব মহাদেব এই অসহায়, লাঞ্ছিত আর নির্যাতিত ভারতীয় নারীর দিকে মুখ তুলে চেয়েছেন। এতদিন শয়তান আলাউদ্দিন ভারতীয় নারীদের কোমলতা আর কমনীয়তা দর্শন করেছে। এবারে আমি আলাউদ্দিনকে দেখিয়ে দেবো ভারতীয় রমণীদের মা দুর্গার ভৈরবী রূপ।”
পরের দিন প্রত্যুষে শিশামহলে নিজের বিশ্বস্ত পরিচারিকাদের সাথে জরুরী বাক্যালাপ করছিলেন মাহারু বেগম। ঠিক এমন সময় জনা কয়েক অস্ত্রধারী হাবসি রক্ষিণী নিয়ে মাহারুর কক্ষে প্রবেশ করলেন রানি কমলাবতী। তাঁকে দেখেই প্রবল ঈর্ষা আর বিরক্তিপূর্ণ জোরালো কণ্ঠে মাহারু বলে উঠলেন, “বিনা অনুমতিতে সুলতানের দ্বিতীয় বেগমের ব্যক্তগত মহলে প্রবেশ করার হিম্মত হয় কি করে দিল্লির হারেমের এক মামুলি তবাইফের ? এর জন্য তোমার কি শাস্তি হতে পারে সেটা জানো কৌসর বাঈ ?”
অপমানিত হয়েও রানি কমলা বিন্দুমাত্র উত্তেজিত না হয়ে হাসিমুখে নরম স্বরেই বললেন, “আমার কি শাস্তি হবে সেটা পরে দেখা যাবে এখন আপনি নিজেকে কিভাবে রক্ষা করবেন সেটাই ভাবুন। সুলতানকে হত্যা করবার জঘন্য ষড়যন্ত্র রচিত করবার ফলস্বরূপ, সুলতানের আদেশনামা অনুসারে আপনার ভাইজান তার আমির-ই-মজলিশের পদ হারিয়েছেন। বর্তমানে তিনি মুলতানে নির্বাসিত হয়েছেন এবং আপনাকেও গৃহবন্দী করবার আদেশ জারি করেছেন সুলতান।” এরপর রানি কমলা হাততালি দিয়ে ইশারা করতেই তুর্কি রক্ষিণীগণ দ্রুত এসে চতুর্দিক থেকে বেষ্টিত করলো মাহারু বেগমকে।
তারপর শুরু হলো রানি কমলার দীর্ঘদিনের লালিত ষড়যন্ত্রের অন্তিম ধাপ। রসুই খানার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ হাতে পেয়ে অষ্টবীজ চূর্ণ আয়ুর্বেদিক বিষ প্রয়োগ করে ধীরে ধীরে আলাউদ্দিনকে নিষ্ক্রিয় করলেন তিনি। প্রথমে স্মৃতিভ্রংশ রোগাক্রান্ত হলেন আলাউদ্দিন, পরে ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হয়ে যুদ্ধ যাত্রায় অংশগ্রহণ করবার শক্তিও হারালেন তিনি, এরপর মানসিক বিকারের লক্ষণও দেখা গেলো আলাউদ্দিনের মধ্যে এবং ১৩১৩-১৪ সাল নাগাদ চলাফেরা করবার ক্ষমতা এবং বাকশক্তিও হারালেন তিনি। এক সময়ে সমগ্র হিন্দুস্থান জুড়ে পবিত্র ইসলামিক সাম্রাজ্য স্থাপনের খোয়াব দেখা দোর্দণ্ডপ্রতাপ তুর্কি সুলতান পর্যবসিত হলেন শয্যায় শায়িত এক অতি দুর্বল জীর্ণ রোগাক্রান্ত, দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত মুমূর্ষু রোগীতে। শেষের দিকে সুলতানতের সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতায় সম্পূর্ণরূপে হারিয়েছিলেন তিনি। এবং আলাউদ্দিনের জীবনের অন্তিম সময়ে তার শয়নকক্ষে মুমূর্ষু সুলতানকে অষ্ট প্রহর নজরবন্দি করে রাখতেন মালিক কাফুর এবং রানি কমলাবতী। তাঁদের অনুমতি বিনা কোন ব্যক্তিই সাক্ষাৎ করতে পারতেন না সুলতানের সাথে। এমনকি নিশুতি রাতেও নিজেদের বিশ্বস্ত রক্ষীদের দ্বারা অবরুদ্ধ থাকতো সুলতানের শয়নকক্ষ।
ক্ষমতা লোভী মালিক কাফুর
=====================
এদিকে ততদিনে ক্ষমতার আস্বাদ পেয়েছেন খোঁজা মালিক কাফুর। দিল্লির মসনদে নিজের প্রভাব জোরালো করবার অভিপ্রায়ে এক ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র রচনা করলেন তিনি। গুজরাট এবং মালওয়ায় হিন্দু প্রজাদের বিদ্রোহ চরম আকার ধারণ করতে তা দমন করবার জন্য মুমূর্ষু সুলতানের নাম করে আল্প খানকে গুজরাটে যাবার নির্দেশ দিলেন তিনি। নির্দেশ পেয়ে নিজের ভগিনীর জ্যৈষ্ঠ সন্তান তথা আলাউদ্দিনের দ্বিতীয় সন্তান শাদিকে নিয়ে মুলতান ত্যাগ করে গুজরাটে এলেন আল্প খান। সেই যুদ্ধে অন্তর্ঘাত করে গুপ্ত ঘাতক দ্বারা আল্প খান এবং শাদি খানকে হত্যা করলেন মালিক কাফুর। ওদিকে রানি কমলাবতীর ষড়যন্ত্রে শিশামহলে গৃহবন্দি মাহারু বেগমের কক্ষে আচমকা একদিন এসে পৌঁছল মুলতান নিবাসি এক অজ্ঞাত ব্যক্তির বিশেষ উপহার সামগ্রী। কৌতূহলী হয়ে সেই উপহার সামগ্রী খুলতেই আচমকা দুটি বিষধর ভ্রমর মৌমাছি এসে তাদের তীব্র হূলের দংশনে বিদ্ধ করলো মাহারু বেগমকে। তীব্র বিষ ক্রিয়ায় গুরুতর অসুস্থ হয়ে কিছুদিনের মধ্যেই মৃত্যু হলো তার। এদিকে আম্মী জানের মৃত্যু সংবাদ শুনে দেবগিরি থেকে দিল্লি এসে পৌঁছতেই মালিক কাফুরের নির্দেশে বন্দি করে কারাগারে নিক্ষিপ্ত করা হলো মাহারুর দ্বিতীয় সন্তান কুতুবউদ্দিন মুবারক শাহ খিলজিকে। সেই সময় সদুর মহারাষ্ট্রে থাকায় মালিক কাফুরের রোষানল থেকে সাময়িকভাবে রক্ষা পেলো আলাউদ্দিনের জ্যৈষ্ঠ সন্তান খিজির খান। অপরদিকে আলাউদ্দিনের প্রথম স্ত্রী মালিকা-এ-জাহানের কি পরিনতি হয়েছিল সে বিষয়ে অধিক তথ্য না পেলেও আমির খুস্রু, জিয়াউল বার্নি এবং ইসামি তাঁদের লেখনিতে ইঙ্গিত দিয়েছেন ১৩০৩ সালে চিতোরের যুদ্ধে রাওয়াল রতন সিংহকে গোপনে সহায়তা করবার অভিযোগে ক্রুদ্ধ আলাউদ্দিন তাঁকে কারাবন্দি করেন এবং আলাউদ্দিনের মৃত্যুর পর মসনদের লোভে মালিক কাফুর কারাগারের গুপ্ত ঘাতক প্রেরণ করে তাঁকে হত্যা করে। পরে আলাউদ্দিনের মৃত্যুর পর ক্ষমতালোভী মালিক কাফুরের বিশ্বস্ত দেহরক্ষীদের প্রচুর ধনরত্ন উৎকোচ দিয়ে তাদের বিশ্বাস ক্রয় করে মালিক কাফুরকে তার নিজের ভবনেই হত্যা করে আরেকবার নিজের তীক্ষ্ণধার ভেদ বুদ্ধির পরিচয় দেন রানি কমলাবতী। এদিকে দীর্ঘ যাতনা সয়ে নিজের পাপের উপযুক্ত সাজা ভোগ করে অবশেষে ১৩১৬ খ্রিষ্টাব্দে হুড়পরীদের লোকে যাত্রা করলেন আলাউদ্দিন খিলজি।
রাজকুমারী জাত্যপল্লীর সাথে রানি কমলার সাক্ষাৎকার পর্ব
==========================================
এদিকে নিজের জীবনের অন্তিম লগ্নে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে যখন নিজের শয়নকক্ষে শয্যাশায়ী ছিলেন আলাউদ্দিন খিলজি ঠিক সেই সময় একদিন রাজকুমারী সৈরিন্ধ্রী এসে রানি কমলাকে সংবাদ দিলো দেবগিরি থেকে আগত রাজকুমারী জাত্যপল্লী দেবীর। সেই সময় রাজকুমারী জাত্যপল্লী সন্তান সম্ভবা ছিলেন এবং নিজের অসহ্য যন্ত্রণায় নিজের ভবন চাঁদনি মহলে অসহায়ভাবে কাতরাচ্ছিলেন। রাজকুমারীর সেবা যত্ন করবার মতো যোগ্য কোন নারী সেই মুহূর্তে চাঁদনি মহলে ছিল না।
স্বধর্মীয় রাজকুমারী জাত্যপল্লীকে নিজের কন্যার মতোই স্নেহ করতেন রানি কমলা। সৈরিন্ধ্রীর নিকট সংবাদ পেয়ে তিনি উপস্থিত হলেন রাজকুমারী জাত্যপল্লীর শয়নকক্ষে। নিজের মায়ের মতোই অপার স্নেহ-মমতা সহকারে দিবারাত্র সেবাযত্ন করলেন তাঁর। দিন কয়েক পশ্চাতে এক ফুটফুটে পুত্র সন্তানের জন্মদান করলেন রাজকুমারী জাত্যপল্লী। তুর্কি হারেমের ইসলামিক কাজী সেই সন্তানের নামকরণ করলেন শাহজাদে শিহাবউদ্দিন ওমর। এরপর রাজকুমারী কিছুটা সুস্থ হয়ে সব শুনে এক সকালে শয্যায় নিজের মাথার কাছে বসে তাঁর সেবা যত্নে মগ্ন থাকা রানি কমলার দক্ষিণ হস্ত আঁকড়ে ধরে আবেগপূর্ণ কণ্ঠে বললেন, “আপনি নিজের মার মতোই আমার সেবা-যত্ন করেছেন। এই দুঃসময়ে আপনি আমার পাশে না থাকলে আমি হয়তো আজ আর সূর্যালোক দর্শন করতে পারতাম না। এর জন্য আপনাকে ধন্যবাদ জানানোর কোন ভাষাই আমি খুঁজে পাচ্ছি না। আপনার প্রতি আমার একটা বিনীত অনুরোধ, আপনাকে কি আমি মা বলে সম্বোধন করতে পারি ?”
রাজকুমারী জাত্যপল্লীর মন্তব্য শুনে দীর্ঘদিন পরে আচমকাই নিজের কন্যা রাজকুমারী দেবালার কথা স্মৃতির মণিকোঠায় ফুটে উঠলো রানি কমলার। তিনি যেন জাত্যপল্লীর মুখাবয়বে নিজের কন্যা দেবালারই দর্শন পেলেন। অশ্রুশিক্ত চোখে বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন, “অবশ্যই তুমি আমাকে মা বলে সম্বোধন করতে পারো রাজকুমারী। এর জন্য অনুমতি নেবার কোন প্রয়োজন নেই।”
এরপর আচমকাই রাজকুমারী জাত্যপল্লী বলে উঠলেন, “আপনাকে আমি চিনতে পেরেছি মা। আপনি গুজরাটের মহারানি তথা আমার প্রিয় সখী রাজকুমারী দেবালার মা, মহারানি কমলাবতী।”
একথা শুনে তীব্র বিস্ময়ের অভিঘাতে রানি দেবলা বলে উঠলেন, “তুমি আমাকে আর আমার কন্যাকে চেনো ? বলতে পারবে এখন কোথায় আছে আমার ছোট্ট শিশুকন্যা দেবালা আর মহারাজ কর্ণ সিংহই বা কোথায় আছেন ? আমার অনুপস্থিতিতে কেমন আছেন তিনি ? নিদারুণ শোক আর দুঃখের অভিঘাতে নিশ্চয়ই মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছেন তিনি ? তাই না ?”
রাজকুমারী জাত্যপল্লী কিছুক্ষণ নীরব থেকে ক্ষীণ ও বিষণ্ণ কণ্ঠে বলে উঠলেন, “মহারাজ এবং রাজকুমারী বর্তমানে দেবগিরির রাজ অতিথি। তবে পিতা রামচন্দ্র তাঁদের বিরুদ্ধে বিরূপ মনভাবাপন্ন অপরদিকে তুর্কি শাহজাদা খিজির খানের বিষ নজরে আক্রান্ত হয়েছেন আপনার কন্যা রাজকুমারী দেবালা। আমি জানি না ঈশ্বর আমার প্রিয় সখী রাজকুমারী দেবালা এবং মহারাজ কর্ণের নিয়তিতে কি লিখে রেখে গেছেন।”
রানি কমলার ভয়ানক দুঃস্বপ্ন
=====================
এই সংবাদ পেয়ে নিজের বিছিন্ন কন্যা এবং পতির জন্য পুনরায় শোকে এবং দুঃখে স্তব্ধ হয়ে গেলেন রানি কমলা। সে রাতে নিজের ভবন মোতি মহলে ফিরে সারারাত কন্যা দেবালা এবং মহারাজ কর্ণের কথা চিন্তা করতে করতেই প্রায় বিনিদ্র রজনী যাপন করলেন। ভোররাতে রানি কমলার দুই চোখের পাতা নিদ্রার আবেশে জড়িয়ে এলো। সেই সময় তিনি দেখলেন এক ভয়ানক দুঃস্বপ্ন। তিনি দেখতে পেলেন তাঁর চোখের সম্মুখে তীব্র উল্লাসধ্বনিতে মত্ত বর্বর তুর্কি দস্যুরা, এবং ভূমিতে শায়িত মস্তক হীন এক রক্তাক্ত মরদেহ। মরদেহের পাশে নতনাজু হয়ে বসে তাঁকে দুই বাহুতে জড়িয়ে ধরে ক্রন্দনরত এক কিশোরী কন্যা। সেই কন্যার মুখ ঘন কুহেলিকা দ্বারা আবৃত। এরপরই মরদেহের পার্শ্বে তাঁর রুধিরাপ্লুত মস্তকটি দেখেই তীব্র আতঙ্কে শিউড়ে উঠলেন রানি কমলা। মৃত ব্যক্তি আর কেউ নন স্বয়ং অপসারিত গুজরাট নরেশ তথা তাঁর পতিদেব রাজা কর্ণ সিংহ বাঘেলা।
মুহূর্তের মধ্যেই তীক্ষ্ণ কণ্ঠে, “মহারাজ” বলে আর্তনাদ করে নিদ্রাভগ্ন হয়ে বিছানার ওপর উঠে বসলেন তিনি। এরপর রানি কমলা দুহিতা রাজকুমারী দেবালা এবং তাঁর পতি মহারাজ কর্ণ সিংহ বাঘেলার ভাগ্যে কি ঘটলো সেটা অন্য আরেক কাহিনী। পরে কখনও সময় পেলে বিষ কন্যাঃ দেবালা পর্বে আপনাদের শোনাবো সেই বেদনা বিধুর ঐতিহাসিক কাহিনী।
লেখকের নিবেদন
=============
দিল্লি নগরের বিভিন্ন তুর্কি হারেমে বন্দিনী অসহায় ভারতীয় রমণীদের আরব, মধ্যপ্রাচ্য সহ অনান্য বিদেশি রাষ্ট্রে পাচার হওয়া রুখতে আলাউদ্দিন খিলজির শেষ সময়ে রানি কমলা দিল্লির বুকে যাবতীয় গণিকালয় নিষিদ্ধ ঘোষণা করে একটি আদেশনামা তৈরি করেন। সেই আদেশনামায় দিল্লির বুকে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ হয় পতিতাবৃত্তি এবং ঘোষণা জারি করা হয় কোন তুর্কি পুরুষকে প্রকাশ্যে কোন গনিকার সাথে দেখা গেলে সেই পুরুষকে বাধ্য করা হবে সেই গনিকাকে বিবাহ করবার জন্য। এরপর সেই আদেশনামাটি আলাউদ্দিনের শয়নকক্ষে নিয়ে এসে সুলতানের কক্ষে রক্ষিত শাহী শিলমোহর নিয়ে আদেশনামার নিচে শিলমোহরের ছাপ দিয়ে আদেশটিকে বৈধ রূপ দেন চতুর রানি কমলাবতী দেবী। মৃত্যুপথযাত্রী বাকশক্তি হীন মুমূর্ষু কামুক সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি নিজের শয্যায় শুয়ে নীরবে অসহায়ভাবে তা প্রত্যক্ষ করা ব্যতীত আর কিছুই করতে পারেননি সেদিন। এছাড়াও চৌহান (পৃথ্বীরাজ) রাজবংশের বীরাঙ্গনা নারীদের আত্মবলিদানকে স্বীকৃতি দান করতে দিল্লির নিকটবর্তী ফরিদাবাদের চৌহান রাজবংশ দ্বারা নির্মিত সূর্যকুণ্ড এবং কুণ্ডের পার্শ্ববর্তী শতাব্দী প্রাচীন দিল্লির একমাত্র হিন্দু মন্দিরটির সংস্কার করে তাঁদের পুরাতন রূপ আর কৌলীন্য কিছুটা হলেও ফিরিয়ে দেন রানি কমলাবতী। এরপর রানির মৃত্যুর কিছু বছর বাদে মহম্মদ বিন তুঘলক দিল্লির সুলতান হয়ে পুনরায় গুঁড়িয়ে দেন সূর্য কুণ্ডের পার্শ্ববর্তী মন্দিরটি। এরপর সময়ের স্রোতের সাথে সাথে ব্রিটিশ, কংগ্রেসি আর কমিউনিস্ট ঐতিহাসিকদের কলমের খোঁচায় ইতিহাসের পাতা থেকে ধিরে ধিরে মুছে গিয়ে ভারতবাসীর বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গেছে রানি কমলাবতীর আত্মত্যাগের মর্মরস্পর্শী ইতিহাস। ওইসব ঐতিহাসিকদের লেখনিতে এক বীরাঙ্গনা নারী থেকে তিনি পরিণত হয়েছেন দিল্লির তুর্কি হারেমের এক আলৌকিক রূপসী তথা চরিত্রহীন বেশ্যায়, যিনি তাঁর রূপ যৌবন দিয়ে বশ করেছিলেন সুলতান আলাউদ্দিন খিলজিকে এবং নিজের সঙ্কীর্ণ স্বার্থ চরিতার্থ করবার অভিপ্রায়ে যার কটাক্ষ ইঙ্গিতে হারেম থেকে মধ্যপ্রাচ্যের দাস বাজারে একে একে অদৃশ্য হয়েছেন আলাউদ্দিন দ্বারা হরণ হওয়া অনান্য ভারতীয় রমণীরা। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় এইসব ঔপনিবেশিক ঐতিহাসিকদের বিকৃত লেখনির দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল কালজয়ী বঙ্গীয় লেখক শ্রী শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কলমও।
#Subhojit_Roy

Comments

  1. লেখাগুলি সংক্ষিপ্ত করে বেশী ছড়ানো দরকার

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog