বিজয়নগরের বাঘ
==============
দাক্ষিণাত্যে তুর্কি আগ্রাসন
===================
জিয়াউদ্দিন বারানির লেখনী অনুযায়ী ১৩০৩ সালের প্রথমার্ধে দিল্লির বিজাতীয় তুর্কি দস্যু আলাউদ্দিন খিলজি তার দুই প্রিয় সেনাপতি মালিক জুনা আর মালিক ঝাজ্জুকে কাকাতিয়ার রাজধানি ওয়ারাঙ্গল বা ওরাগাল্লু আক্রমণ করবার জন্য প্রেরন করেন। কিন্তু রাজা দ্বিতীয় প্রতাপরুদ্রের রুদ্ররোষের সম্মুখে খড়কুটোর মতো উড়ে যায় তুর্কি বাহিনীর আক্রমণ। পরাজিত হয় খিলজি বাহিনী, কাকাতিয়ার বাহিনীর পাল্টা প্রহারে মৃত্যু হয় তুর্কি সেনাপতি মালিক জুনার আর গুরুতর আহত হন আরেক সেনাপতি মালিক ঝাজ্জু। পরবর্তীকালে সেনাবাহিনী থেকে অপসারিত হন মালিক ঝাজ্জু। এরপর ১৩০৮ সালে আলাউদ্দিন খিলজির নির্দেশে এক বিশাল বাহিনী সমেত পুনরায় কাকাতিয়ার রাজধানি ওরাগাল্লু আক্রমণ করেন তাঁর সবচেয়ে প্রিয়তম সেনাপতি মালিক কাফুর। কিন্তু সেই আক্রমণও সফলভাবে প্রতিহত করেন দ্বিতীয় প্রতাপরুদ্র।

এরপর মালিক কাফুর দেবগিরি আক্রমণ ও অধিকার করে পুনরায় ১৩১০ সালে আক্রমণ করেন কাকাতিয়া রাজ্য। সেই যুদ্ধে তুর্কি দস্যুদের পূর্ণরূপে সহায়তা দান করেন কাকাতিয়ার চির শত্রু দেবগিরি রাজ্যের শয়তান রাজা রামচন্দ্র যাদব। হ্যাঁ ইনিই দেবগিরির সেই মহান রাজা রামচন্দ্র যাদব যিনি নিজের সিংহাসন রক্ষা করার জন্য স্বেচ্ছায় নিজের কন্যা রাজকুমারী জাত্যাপল্লীকে খিলজির হারেমে প্রেরন করেছিলেন। দেবগিরির রাজার বিশ্বাসঘাতকতার ফলে সেই যুদ্ধে অবশেষে পরাজিত হন কাকাতিয়া নরেশ দ্বিতীয় প্রতাপরুদ্রদেব। কাফুরের বাহিনী তাঁর রাজধানিতে কিছুদিন অবাধে লুঠতরাজ চালায়। শেষে প্রতাপরুদ্রর কাছ থেকে ঐতিহাসিক কোহিনূর হিরকখণ্ড সহ এক বিশাল মোটা অঙ্কের রত্নরাজি তোলা হিসাবে সংগ্রহ করে এবং প্রতাপরুদ্রকে দিল্লির তুর্কি সুলতানের বশ্যতা স্বীকার করিয়ে দিল্লি ফিরে যান, কিন্তু স্বাধীনতা হরন হয় না কাকাতিয়া রাজ্যের, পতনও হয়না।

এরপর ১৩১৮ সালে পুনরায় কাকাতিয়া আক্রমণ করেন আলাউদ্দিন খিলজির পুত্র সুলতান মুবারক শাহ। এই যুদ্ধে তুর্কি বাহিনীর নেতৃত্বদান করেন গুজরাটের রানি কমলাবতী দেবীর কন্যা দেবালাদেবীর পতি সেনাপতি খুস্রু খান। খুস্রু খানের মধ্যস্ততায় দিল্লি সুলতানের সাথে এক সম্মানজনক সূত্রে রফা করেন কাকাতিয়া নরেশ প্রতাপরুদ্র। স্বাধীনতা হরন বা পতন হয় না কাকাতিয়া রাজ্যের।

এরপর ১৩২৩ সালে উলুগ খান (সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলক) এক বিশাল বাহিনী নিয়ে ফের কাকাতিয়া রাজ্য আক্রমণ করেন। তুঘলগ নিজে স্বয়ং ওরাগাল্লু মূল কেল্লা অবরোধ করেন এবং তাঁর বিশ্বস্ত সেনাপতি আবু রিজা কোটাগিরি কেল্লা অবরোধ করেন। ঠিক এইসময় তুর্কি বাহিনীতে গুজব রটে যে দিল্লিতে আচমকা মৃত্যু হয়েছে মহম্মদ বিন তুঘলকের পিতা সুলতান ঘিয়াত-আল-দিন তুঘলকের। তুর্কি শিবিরে শুরু হয় প্রবল সেনা বিদ্রোহ। রনে ভঙ্গ দিয়ে কাকাতিয়া ছেড়ে দিল্লি পলায়ন করতে বাধ্য হন মহম্মদ তুঘলক। পতন হয় না কাকাতিয়া রাজ্যের। এরপর ১৩২৩ থেকে ১৩২৬ সালের মধ্যে একে একে পতন হলো দেবগিরি, কাকাতিয়া, পাণ্ড্য আর কাম্পিলি সহ দাক্ষিণাত্যের তামাম সনাতনী রাজ্যগুলির। তুর্কি সেনা সাগরের সুনামির মাঝে একাকি এক প্রতিরোধ স্তম্ভের  ন্যায় যাবতীয় ঝড় ঝাপটা সহ্য করে থেকে গেল কেবলমাত্র হোয়শালা রাজ্যটি।

তুর্কি বাহিনীকে পলায়ন করতে দেখে যুদ্ধে বিজয় লাভ করেছেন মনে করে রাজ্য জুড়ে আনন্দ উৎসব শুরু করেন রাজা প্রতাপরুদ্র। তুলে নেওয়া হয় ওরাগাল্লু কেল্লার যাবতীয় সুরক্ষা ব্যবস্থাও। এই সুযোগের সম্পূর্ণ সদবহার করে চার মাস বাদে আচমকা ঝটিকা গতিতে এক বিশাল বাহিনী নিয়ে ফের ওরাগাল্লু আক্রমণ করে বসেন মহম্মদ বিন তুঘলক। এবারে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত রাজা দ্বিতীয় রুদ্রদেব। অবশেষে ১৩২৩ সালে পতন হয় রানি রুদ্রমাদেবীর স্মৃতিধন্য কাকাতিয়া রাজ্য। তুর্কি বাহিনীর হাতে বন্দি হন কাকাতিয়া রাজ্যের অন্তিম রাজা দ্বিতীয় প্রতাপরুদ্র। সেই সাথে বন্দি হন তাঁর রাজকোষাগারের সুরক্ষার দায়িত্ব থাকা দুই কিশোর যুবা ভ্রাতাও। এঁরা ছিলেন কাকাতিয়া রাজ্যের সামন্তরাজ কাম্পিলি নামক এক ক্ষুদ্র রাজ্যের রাজকুমার। দাক্ষিণাত্যের মুসুনারী নায়েক রাজপরিবারের ১৩৩০ সালের বিলাস শিলালিপির লেখনী অনুসারে ওরাগাল্লু থেকে দিল্লি যাত্রাপথে নর্মদা নদীতে ঝাঁপিয়ে পরে জলে ডুবে আত্মহত্যা করে বিজাতীয় যবন দস্যুদের হাত থেকে নিজের সম্মান রক্ষা করেন মহারানি রুদ্রমাদেবীর নাতি তথা হতভাগ্য রাজা দ্বিতীয় প্রতাপরুদ্র। কিন্তু সেই সুযোগ পাননি সেই সময় তুর্কি দস্যুদের হাতে বন্দি কাকাতিয়া রাজ্যের রাজকোষাগারের দায়িত্বে থাকা দুই কিশোর ভ্রাতা। পরবর্তীকালে এই দুই ভ্রাতাই দাক্ষিণাত্যের বুকে এক নয়া গৌরবজনক ঐতিহাসিক অধ্যায়ের সূত্রপাত ঘটান হিন্দু সাম্রাজ্য "বিজয়নগর" স্থাপিত করে। হ্যাঁ ঠিকই আন্দাজ করেছেন। এই দুই বীর ভ্রাতাই পরবর্তীকালে দাক্ষিণাত্যের ভূমিতে বিখ্যাত তুর্কিনাশক তথা সমৃদ্ধশালী হিন্দু সাম্রাজ্য বিজয়নগরের প্রতিষ্ঠাতা প্রথম আর দ্বিতীয় সম্রাট হরিহর আর বুক্কা রায় নামে সুপরিচিত হবেন। সেদিন তুর্কি শিবিরে বন্দিদের তালিকায় হাক্কা-বুক্কা ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন কাকাতিয়া রাজ্যের আরও পাঁচশত হতভাগ্য বীর সেনানি।

তুর্কি শিবিরে বন্দি বীর
================
এরপর সেকালের তুর্কি প্রথা অনুযায়ী অনান্য বন্দিদের সাথে হাক্কা আর বুক্কাকে নিয়ে আসা হলো তুর্কি রাজধানি দিল্লিতে। তাঁদের প্রাথমিকভাবে বন্দি করে রাখা হলো দিল্লির তুঘলকাবাদের অন্ধকারাছন্ন পাতাল কারাগারে। সেখানে ধর্ম পরিবর্তনের জন্য তাঁদের উপর শুরু হলো ভয়ানক অত্যাচার। ভিনদেশি তুর্কিদের নির্মম অত্যাচার সইতে না পেরে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য হলো অবশিষ্ট পাঁচশত সেনানি। কিন্তু শত অত্যাচার আর পিড়া সহ্য করেও যখন নিজ ধর্ম ত্যাগ করলেন না হাক্কা আর বুক্কা তখন সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলক কারাগারে প্রেরন করলেন তার সুলতানতের এক শাহী ইমামকে। এক সকালে হাবসি রক্ষী দ্বারা পরিবৃত হয়ে কারাগারে প্রবেশ করলেন শাহী ইমাম। ইমামের নির্দেশে হাক্কা-বুক্কার দুই হাত তাঁদের মাথার উপরে শক্ত আর মোটা দড়ি দিয়ে বাঁধা হলো আর তাঁদের পদযুগল লৌহ শৃঙ্খল দ্বারা আবদ্ধ করা হলো। এরপর জনাকয়েক রক্ষী বলপূর্বক তাঁদের গোমাংস মিশ্রিত খাদ্য ভক্ষণ করালো। তারপর ইমাম ক্রূর হাসি হেসে হাক্কা-বুক্কাকে জানালেন যে গোমাংস ভক্ষণ সনাতন ধর্মে নিষিদ্ধ আর নিষিদ্ধ মাংস ভক্ষণ করে তাঁরা এখন ধর্মচ্যুত হয়েছে। তৎকালীন জুগের গোঁড়া সনাতনী সমাজ কোনদিন আর দুই ভাইকে ফিরিয়ে নেবে না। অতএব ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে সুলতানের খিদমত করাই তাঁদের পক্ষে এখন একমাত্র মঙ্গলজনক উপায়।

এরপর নিরুপায় দুই ভাই বাধ্য হলেন ইসলাম ধর্ম কবুল করতে। ইমাম তাঁদের নয়া নামকরন করলেন কুতুবউদ্দিন খান আর কাম্রুদ্দিন খান নামে। তারপর তাঁদের প্রবেশিকা হলো সুলতানের বাহিনীতে। প্রাথমিকভাবে অনিচ্ছুক হাক্কা আর বুক্কাকে বলপূর্বক তুর্কি সেনাবাহিনীতে ভর্তি করানো হলেও দেখা গেল অল্প কিছুদিনের মধ্যেই যুদ্ধবিদ্যায় অসম্ভব আগ্রহান্বিত হয়ে পড়েছেন দাক্ষিণাত্যের এই দুই ভ্রাতা। এদিকে তখন দাক্ষিণাত্যে নিজের তুর্কি সাম্রাজ্য বিস্তার করতে শুরু করেছেন দিল্লির সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলক। যুদ্ধে তাঁদের প্রবল উৎসাহ লক্ষ্য করে দূরদর্শী সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলক অচিরেই উপলব্ধি করতে পারলেন যে তার দাক্ষিণাত্য অভিযানে এই দুই স্থানীয় যুবার সামরিক সহায়তা পেলে দাক্ষিণাত্যের ভূমিতে কাফের হিন্দুদের পরাজিত করে অনায়াসেই স্থাপন করা যাবে অর্ধচন্দ্র আর কলমা অঙ্কিত সবুজ তুর্কি ঝাণ্ডা। অতএব সুলতানের নির্দেশে ঝানু তুর্কি সর্দার মামুদ খিলজির অধীনে দুই ভাইয়ের যুদ্ধের প্রশিক্ষণ শুরু হলো। মাত্র বছহরখানেকের প্রশিক্ষণেই তিরন্দাজি, অসি চালনা, ভল্ল চালনা, ঘোড়সওয়ারি আর সফল যুদ্ধ পরিচালনায় রীতিমতো দক্ষ হয়ে উঠলেন কুতুবউদ্দিন আর কাম্রুদ্দিন। এদিকে কুতুব আর কাম্রুদ্দিনের অনুরোধে তুর্কি শিবিরে বন্দি কাকাতিয়া রাজ্যের পাঁচশত সেনাকেও তুর্কি সেনা শিবিরে অন্তর্ভুক্ত করা হলো। নিজের সিপাহীদের মুখে কুতুব আর কাম্রুদ্দিনের ভূয়সী প্রশংসা শুনে সুলতান একদিন নিজের দরবারে ডেকে পাঠালেন তাঁদের। তাঁরা দরবারে উপস্থিত হলে সুলতান তাঁদের জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমরা কি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ?” দুই ভ্রাতা দৃপ্ত স্বরে উত্তর দিলেন, “জরুর সুলতান”।
এবারে সুলতান তাঁদের দুজনকে নিজের সেনা সর্দার হিসাবে নিয়োগ করে বীরভূমি রাজপুতানার বিভিন্ন প্রান্তে প্রেরন করলেন তুর্কিদের বশ্যতা স্বীকার না করা অদম্য রাজপুত যোদ্ধাদের বিদ্রোহ দমন করবার জন্য।

মেবারের মহারানার মহাউত্থান
======================
ইসলাম ধর্মে রূপান্তরিত হবার পর অতিবাহিত হয়ে গেছে বছর দুয়েক সময়কাল। ততদিনে ভিনদেশি তুর্কিদের সাথে বসবাস করে নিজেদের পূর্ব ধর্ম আর সভ্যতার স্মৃতি বিলুপ্তপ্রায় হয়ে পড়েছিল দুই ভাইয়ের স্মৃতিপট থেকে। কিন্তু রাজপুতানায় প্রবেশ করে বিভিন্ন যুদ্ধে রাজপুত যোদ্ধাদের শৌর্য, পরাক্রম আর সনাতন ধর্ম ও সভ্যতার প্রতি অকুণ্ঠ প্রেম আর নিষ্ঠা লক্ষ্য করে ধিরে ধিরে কুতুব আর কাম্রুদ্দিনের মনের গহনেও পুনরায় জাগ্রত হতে শুরু করলো তাঁদের পূর্ব জীবনের গরিমাময় মধুর স্মৃতিময় দিনগুলি। কিন্তু সুলতানের নির্দেশ অনুযায়ী রাজপুতানার রনাঙ্গনে রীতিমতো দক্ষ রণকুশলতা, বীরত্ব আর পরাক্রম প্রদর্শন করে বহু যুদ্ধে তুর্কি বাহিনীকে জয়লাভ করতে সহায়তা করলেন তাঁরা। তাঁদের এই সাফল্য সংবাদ শুনে যারপরনাই খুশি হলেন সুলতান। দীর্ঘ এক বছরকাল যুদ্ধভূমিতে অতিবাহিত করবার পর পুনরায় দিল্লির তুঘলকাবাদে প্রত্যাবর্তন করলেন তাঁরা। তুঘলকাবাদে প্রত্যাবর্তন করে কুতুব আর কাম্রুদ্দিন পেলেন এক দুঃসংবাদ। মুহনত নইনসির লেখনী অনুসারে দিল্লির তুর্কি সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলকের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে তুর্কিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন মেবারের অধিপতি তথা চিতোরগড়ের উদ্ধারক মহাবীর মহারানা হামীর সিংহ। মহারানা হামীর সিংহের নেতৃত্বাধীন মেবারি বাহিনীর বিরুদ্ধে পরপর বেশ কয়েকটা যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিলেন তুর্কি সুলতান। সিংহ বিক্রমে তুর্কিদের হাত থেকে বহু স্মৃতি বিজড়িত মেবারের প্রধান কেল্লা চিতোরগড় ছিনিয়ে নেবার পর সমগ্র রাজপুতানাকে ভিনদেশি তুর্কিদের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করবার বাসনায় মহারানা হামীর সিংহের নির্দেশে তাঁর বাহিনী আচমকা আজমির আক্রমন করে আজমিরের তারাগড় কেল্লা ছিনিয়ে নিয়েছে। আর তারাগড় কেল্লার যুদ্ধে মহারানার ভল্লের আঘাতে নিহত হয়েছেন কেল্লার প্রধান তুর্কি সেনাপতি আকমল খান। পৃথ্বীরাজ চৌহানের জন্মস্থল আজমিরের তারাগড় কেল্লায় অর্ধচন্দ্র আর কলমা অঙ্কিত সবুজ তুর্কি ঝাণ্ডা ঝড়ে পরে এখন স্বগর্বে পতপত করে উড়ছে সূর্য অঙ্কিত মেবারের রাজকীয় গৈরিক ধ্বজ। এই সংবাদ শুনে যারপরনাই ক্রুদ্ধ হয়ে পড়েছেন সুলতান যৌনা খান ওরফে মহম্মদ বিন তুঘলক। তিনি তাঁর প্রধান সেনাপতি মুবারক শাহকে কারা প্রদেশ থেকে তলব করে এনেছেন মেবারের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য। এই সমাচার শুনে ভরা দরবার কক্ষে কুতুবউদ্দিন খান দৃপ্ত স্বরে বলে উঠলেন ,”হুজুরে আলা, জাহাঁপনা, এই মুহূর্তে রাজপুতানার সর্বোচ্চ শক্তিশালী রাজ্য মেবারের বিরুদ্ধে এক নির্ণায়ক যুদ্ধের আশু প্রয়োজন আর এই যুদ্ধে নেতৃত্বদান মুবারক শাহের মতো কোন মামুলি সিপাহী সালারের পক্ষে সম্ভব নয়। একমাত্র আমিই এই যুদ্ধের সফল নেতৃত্ব দান করতে পারি। আমাকে শাহী সেনার মুখ্য সিপাহী সালার করে রাজপুতানায় প্রেরন করুন। কসম খাচ্ছি একমাসের মধ্যে শরকশ হামীর সিংহের মস্তক কেটে আপনার পদযুগলের নিচে রাখবো।”

কুতুবউদ্দিনের পরাক্রম
=================
কুতুবউদ্দিনের এহেন দাবি শুনে ভয়ানক ক্রুদ্ধ হলেন মুবারক শাহ। তিনি এক নির্ণায়ক দ্বন্দ্বযুদ্ধের জন্য সরাসরি আহ্বান জানালেন কুতুবউদ্দিনকে। ঠিক হলো দ্বন্দ্বযুদ্ধে যদি কুতুব জয়ী হন তাহলেই তিনি মেবারের বিরুদ্ধে সুলতানের শাহী সেনার নেতৃত্বদানের সুযোগ পাবেন, অন্যথায় মুবারক শাহই মুখ্য সিপাহী সালহার থাকবেন। নিরুপায় সুলতান তুঘলক বাধ্য হলেন তার সায় দিতে। দ্বন্দ্বযুদ্ধ তিন পর্বে বিভক্ত হলো। প্রথম পর্বে তিরন্দাজির যুদ্ধে জয়লাভ করলেন কুতুব। দ্বিতীয় পর্বে অশ্বপৃষ্ঠে সওয়ার হয়ে দুই যোদ্ধার ভয়ানক ভল্লযুদ্ধ শুরু হলো। বেশ কিছুক্ষণ যুদ্ধ চলবার পর অবশেষে বিজয়ী হলেন মুবারক শাহ। এবারে শুরু হবে দ্বন্দ্বযুদ্ধের অন্তিম পর্ব, অসি যুদ্ধ। অসি যুদ্ধের পূর্বে থমথমে মেঘাছন্ন মুখমণ্ডল নিয়ে কুতুবের সম্মুখে এসে উপস্থিত হলেন কাম্রুদ্দিন। তিনি দ্বন্দ্বযুদ্ধের অন্তিম পর্বের ফলাফল নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করতেই, কুতুব আত্মবিশ্বাস পূর্ণ দৃপ্ত কণ্ঠে বলে উঠলেন, “চিন্তা করো না ভাইজান কাম্রুদ্দিন, মেবারের বিরুদ্ধে আসন্ন যুদ্ধে সুলতানের শাহী বাহিনীর নেতৃত্বদান করবো আমিই”। এরপর শুরু হলো অন্তিম পর্বের যুদ্ধ। দুই প্রতিদ্বন্দ্বীই দক্ষ যোদ্ধা। দুজনের তরবারির পারস্পরিক স্পর্শে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বিচ্ছুরিত হতে লাগলো, চতুর্দিক পরিপূর্ণ হয়ে উঠলো তরবারির ঝনঝনানির শব্দে আর দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর গর্জন ধ্বনিতে। বেশকিছুক্ষণ প্রতিস্পর্ধা চলবার পর আচমকা কুতুবের তরবারির এক জোরালো আঘাতে ভারসাম্য চ্যুত হয়ে টলমল করতে লাগলেন মুবারক। এই সুযোগের সম্পূর্ণ সদবহার করে কুতুব নিজের মুষ্টিবদ্ধ তরবারি শূন্যে উত্থোলিত করে দ্বিতীয়বারের জন্য এক ভয়ানক আঘাত করলেন মুবারকের উপর। এই দ্বিতীয় আঘাতের ফলে ভূপাতিত হলেন মুবারক। তুর্কি সেনাপতির হাত থেকে তার তরবারিও সশব্দে ছিটকে পড়লো বহু দূরে। প্রতিস্পর্ধার যুদ্ধে নির্ণায়কভাবে বিজয়ী হলেন কুতুব। যুদ্ধে কুতুবের অসাধারন পারদর্শিতা দেখে খোদ সুলতানও তার সিংহাসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে করতালি দিয়ে কুতুবকে অভিনন্দন জানালেন। এরপর এক প্রত্যুষে কুতুবউদ্দিনকে তুর্কি বাহিনীর নতুন সেনাপতি নিযুক্ত করে আজমিরে প্রেরন করলেন সুলতান। অনান্য অভিযানের মতো এই অভিযানেও নিজের কনিষ্ঠ ভ্রাতা কাম্রুদ্দিন আর কাকাতিয়া রাজ্যের পাঁচশত ধর্মান্তরিত সিপাহীকে সামিল করলেন কুতুব। শুরু হলো মেবারের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা। তখনও জানতেন না কুতুবউদ্দিন, কাম্রুদ্দিন আর কাকাতিয়া রাজ্যের পাঁচশত সিপাহী এই যুদ্ধ কিভাবে ঘুরিয়ে দেবে তাঁদের জীবনের স্রোতের ধারা।

আজমিরের যুদ্ধে মহারানার রুদ্ররোষ
==========================
যা ভেবেছিলেন কুতুবউদ্দিন এই যুদ্ধে ঘটলো সম্পূর্ণ তার বিপরীত। মহারানা হামীরের রুদ্ররোষের সম্মুখে এবারেও সম্পূর্ণরূপে ছারখার হলো তুর্কি সেনা। যুদ্ধের অন্তিম লগ্নে পশুরাজ সিংহের ন্যায় স্বয়ং মহারানা হামীর এসে দণ্ডায়মান হলেন তারাগড় কেল্লার বুরুজে। মহারানার দক্ষিন হস্তে শোভা পাচ্ছে শূন্যে উত্থলিত তাঁর অসি। তুর্কি রক্তে শিক্ত সেই অসির শানিত ফলা সূর্য কিরনে জ্বলজ্বল করছে বিদ্যুৎ শিখার মতো আর তাঁর বাম হস্তে শোভা পাচ্ছে সূর্য অঙ্কিত মেবারের রাজকীয় গৈরিক ধ্বজ। বুরুজের উপর উপস্থিত হয়ে মহারানা সিংহনাদ করে উঠলেন, “হর হর মহাদেব”। প্রত্যুত্তরে অবশিষ্ট মেবারি সেনারা গর্জন করে উঠলেন, “জয় একলিঙ্গনাথ”। মহারানার ভৈরব মূর্তি আর তাঁর বাহিনীর তাণ্ডব নৃত্য দেখে তীব্র আতঙ্কে তখন রনে ভঙ্গ দিয়ে পলায়ন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো তুর্কি বাহিনী। নিজের পলায়নরত বাহিনীকে একত্রিত করবার প্রানপন প্রয়াস করেও ব্যর্থ হলেন সেনাপতি কুতুব আর কাম্রুদ্দিন। কিন্তু তবুও নিজেরা রনে ভঙ্গ না দিয়ে অসম যুদ্ধ করে যেতে লাগলেন মেবারি বাহিনীর বিরুদ্ধে। একসময় মেবারের বাহিনীর তরবারি আর ভল্লের আঘাতে আহত হয়ে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়লেন দুই ভাই। যখন তাঁদের জ্ঞান ফিরল তখন তাঁরা নিজেদের তারাগড় কেল্লার কারাগারে বন্দি অবস্থায় দেখতে পেলেন। অনান্য কাপুরুষ তুর্কি সেনাদের মতো নিজেদের ভূমির দুই সর্দারকে ফেলে পলায়ন করেননি কাকাতিয়া রাজ্যের পাঁচশত সিপাহীও। কিছু সময় পরে তাঁদের উপস্থিত করা হলো মহারানার সম্মুখে। মহারানা হামীর সিংহের সাথে পরিচিত হয়ে, রাজপুতানা, মেবার, চিতোর এবং সনাতন ধর্ম ও সভ্যতার প্রতি তাঁর প্রবল নিষ্ঠা ও প্রেম লক্ষ্য করে তাঁদেরও মনে পরে গেল ক্ষুদ্র কাম্পিলি রাজ্য আর কাকাতিয়া রাজ্যের রাজধানি ওরাগল্লুতে অতিবাহিত করে আসা তাঁদের অতীতকালের স্বর্ণোজ্বল কৈশোর আর যৌবনকালের দিনগুলির কথা। মনে পরে গেল তুর্কি শিবিরে বন্দি অবস্থায় তাঁদের উপর হয়ে আসা অকথ্য অত্যাচার আর বলপূর্বক নিষিদ্ধ মাংস সেবনের কথাও। তাঁদের তখনই ইচ্ছা হলো ভিনদেশি বিধর্মী যবন তুর্কিদের নজর এড়িয়ে পক্ষীর ন্যায় ডানা মেলে নিজেদের ফেলে আসা দেশ তুঙ্গাভদ্রা, কৃষ্ণা, কাবেরি নদীর স্মৃতি ধন্য সুজলাং সুফলাং দাক্ষিণাত্যের স্বর্ণ ভূমিতে ফিরে যাবার। বোধকরি তাঁদের মুখের ভাব দর্শন করে মহারানাও উপলব্ধি করতে পারলেন তাঁদের অন্তরের কথা। কুতুব আর কাম্রুদ্দিনের নিকটে জানতে চাইলেন তাঁদের পূর্ব জীবনের কাহিনী। তাঁদের মুখে সব শুনে তিনিও তখন এক জ্বালাময়ী উদ্দীপক ভাষণের মধ্যে দিয়ে তাঁদের অনুপ্রেরিত করলেন ভিনদেশি তুর্কি জিহাদি শক্তির বিরুদ্ধে মুক্তির জন্য অস্ত্রধারন করে, অধর্মকে পরাজিত করে দাক্ষিণাত্যের ভূমিতে বিপন্ন হয়ে পড়া সনাতন ধর্ম আর সভ্যতাকে পুনরায় স্বমহিমায় পুনঃরপ্রতিষ্ঠিত করবার জন্য। এরপর মহারানার নির্দেশে মুক্তি দান করা হল কুতুব আর কাম্রুদ্দিন সহ তাঁদের বিশ্বস্ত পাঁচশত সেনাকে।

দুই বীরের মাতৃভূমিতে প্রত্যাবর্তন
=======================
দাক্ষিণাত্যের যখন এহেন অবস্থা ঠিক সেই সময়ই মেবারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে দিল্লিতে ফিরে এলেন কুতুব আর কাম্রুদ্দিন। তাঁদের মুখে পরাজয়ের সংবাদ শুনে যারপরনাই ক্রুদ্ধ হলেন সুলতান। প্রাথমিকভাবে সুলতান সিদ্ধান্ত নিলেন শয়তান মহারানাকে তাঁর ঔদ্ধত্যের যোগ্য জবাব দানের জন্য এবারে নিজেই মেবার আক্রমন করবেন। কিন্তু অচিরেই তার মেবার আক্রমনের যাবতীয় পরিকল্পনা ভেস্তে গেল, যখন এক বিশাল মঙ্গোল বাহিনী ১৩২৮ থেকে ১৩২৯ সালের মধ্যে লামঘান আর মুলতান ছারখার করে খোদ তুর্কি রাজধানি দিল্লির অদূরে এসে উপস্থিত হলো। মঙ্গোলদের আতঙ্কে সন্ত্রস্ত্র সুলতান আপাতত তার মেবার অভিযান স্থগিত রেখে দাক্ষিণাত্যে পলায়ন করে অধিকৃত দেবগিরি রাজ্যের সাবেক রাজধানিতে তার তুর্কি সাম্রাজ্যের নয়া রাজধানি স্থাপন করবেন বলে ঠিক করলেন। দেবগিরি গমনের পূর্বে দাক্ষিণাত্যের বিদ্রোহী হোয়শালা নরেশ বীর বল্লালকে শায়েস্তা করবার জন্য এক বিশাল বাহিনী সমেত কুতুবউদ্দিন আর কাম্রুদ্দিনকে প্রেরন করলেন তাঁদের জন্মস্থান তথা মাতৃভূমি দাক্ষিণাত্যে।

এতকাল পরে এরকম অযাচিত ভাবে পুনরায় নিজেদের মাতৃভূমিতে প্রত্যাবর্তনের সুযোগ পেয়ে খুশিতে উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়লো কাম্রুদ্দিন আর কাকাতিয়া রাজ্যের পাঁচশত সিপাহী, কিন্তু এক অব্যক্ত দুঃখ ও যন্ত্রণায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠলো কুতুবউদ্দিনের হৃদয়। কুতুবের ভ্রাতা কাম্রুদ্দিন তাঁর নিকটে তাঁর দুঃখের কারন জানতে চাইলে, কুতুব ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বললেন, “করুনাময় ঈশ্বরের পরম কৃপায় পুনরায় আমরা নিজদের মাতৃভূমিতে প্রত্যাবর্তনের সুযোগ পাচ্ছি বটে কিন্তু এখন আমরা ধর্মচ্যুত যবনে পরিনত হয়েছি। দাক্ষিণাত্যে একবার আমাদের দর্শন লাভের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষারত আমাদের বাকি দুই ভ্রাতা আর ওখানকার সনাতনী সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিগন কি পুনরায় গ্রহণ করবেন আমাদের ? আমার তো মনে হয় না। উল্টে দাক্ষিণাত্যে পৌঁছে তুর্কি দস্যুদের হয়ে আমাদের অস্ত্রধারণ করতে হবে নিজেদেরই ভাই আর প্রজাদের বিরুদ্ধে।”

অগ্রজের মুখে এহেন কথা শুনে কাম্রুদ্দিন তাঁকে আশ্বস্ত করে বলে উঠলেন তুমি কিছু চিন্তা করো না, ঈশ্বর যেমন আমাদের সুযোগ দিয়েছেন মাতৃভূমিতে প্রত্যাবর্তনের তেমনি ঈশ্বরই আবার আমাদের সুযোগ দেবেন পুনরায় স্বধর্মে প্রত্যাবর্তন করে ভিনদেশি যবন দস্যুদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে তাঁদের দাক্ষিণাত্যের পবিত্র ভূমি থেকে বিতাড়িত করে এক শক্তিশালী সনাতনী সাম্রাজ্যে নির্মাণ করতে।”
এরপর দুই ভাই সেনা সমেত এগিয়ে চলল দাক্ষিণাত্যের প্রান্তে। বিশাল বাহিনী সমেত মাস দুয়েক যাত্রা শেষে এক প্রত্যুষে তাঁরা এসে উপস্থিত হলেন দাক্ষিণাত্যের ওরাগাল্লু কেল্লার প্রবেশদ্বার কালা থোরানাম শিব মন্দিরের ধ্বংসস্থুপের সম্মুখে। মাত্র এক শতাব্দী পূর্বেই সমৃদ্ধশালী কাকাতিয়া রাজ্যের রাজধানি ওরাগাল্লু নগরের কেল্লায় সিংহদ্বারের পার্শ্ববর্তী স্থানেই অবস্থিত ছিল শতাব্দী প্রাচীন স্বয়ম্ভু শিব মন্দির কালা থোরানাম ছিল স্বয়ম্ভু শিব মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রবেশের মূল দ্বার। কাকাতিয়া রাজ্যের ইতিহাস অনুসারে ১২৫৮ থেকে ১২৬২ সালে নিজের শাসনকালের অন্তিমলগ্নে এই শিব মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন তৎকালীন কাকাতিয়া নরেশ গনপতিদেব। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর কন্যা রানি রুদ্রমাদেবী এবং রুদ্রমাদেবীর জামাতা রাজা প্রতাপরুদ্র এই স্বয়ম্ভুশিব মন্দিরকে এক সমৃদ্ধশালী শিব মন্দিরের রূপদান করেন। গৌরবময় অতিতের সেই দিনগুলিতে গুজরাটের বিখ্যাত রুদ্র মহালয় শিব মন্দিরের সাথে এক সারিতে স্থান পেতো কাকাতিয়ার স্বয়ম্ভু শিব মন্দির। এরপর ১৩২৩ খ্রিষ্টাব্দে এক বিশাল বাহিনী সমেত আচমকা কাকাতিয়া রাজধানি ওরাগাল্লু আক্রমন করেন মহম্মদ বিন তুঘলক। তুর্কিদের এই চতুর্থ আক্রমনের সম্মুখে সম্পূর্ণ রূপে পরাজিত হন রুদ্রমা পুত্র প্রতাপরুদ্র। তারপর তুঘলকের নির্দেশে ভেঙে গুঁড়িয়ে মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হয় সমৃদ্ধশালী স্বয়ম্ভু শিব মন্দির। স্বয়ম্ভু মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের অন্তিম চিহ্ন হিসাবে অবস্থিত রয়েছে ওই মন্দিরের চারটি প্রবেশপথের প্রস্তর নির্মিত আর অসামান্য কারুকার্য মণ্ডিত চারটি প্রবেশদ্বার কালা থোরানাম। বর্তমানে এই কালা থোরানামই নবগঠিত তেলেঙ্গানা রাজ্যের সরকারি প্রতীক চিহ্ন।

কালা থোরানামের ধ্বংসাবশেষের সম্মুখে এসে হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়ে পড়লো কুতুব আর কাম্রুদ্দিন সহ পাঁচশত ধর্মান্তরিত সিপাহীর। এক রাতে তাঁরা এক গোপন সভা করলেন। সেই সভায় কুতুব আর কাম্রুদ্দিনের সম্মুখে সেই পাঁচশত সিপাহী শপথ গ্রহণ করলেন তুর্কিদের বিরুদ্ধে দুই ভ্রাতার বিদ্রোহে তাঁদের যথাযথ সহায়তা করবেন তাঁরা। বিদ্রোহের অঙ্গিকার তো করলেন তাঁরা, কিন্তু কিভাবে সফল হবে শক্তিশালী তুর্কি দস্যুদের বিরুদ্ধে এই বিদ্রোহের ষড়যন্ত্র। এমন সময় চতুর কুতুবউদ্দিনের নজর পড়লো কাকাতিয়া রাজ্যের দেখভালের দায়িত্বে থাকা তুর্কি সর্দার তথা কুতুবউদ্দিনের চরম শত্রু মুবারক শাহের দিকে। তরবারির প্রতিস্পর্ধায় কুতুবের নিকটে পরাজিত হয়ে তাঁর উপর অন্ধ ক্রোধে ফুঁসছিলেন মুবারক। আজমিরের যুদ্ধে মেবারের বিরুদ্ধে কুতুবের শোচনীয় পরাজয়ের পর দাক্ষিণাত্য অভিযানে পুনরায় মুবারককেই প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করেছেন সুলতান। এর ফলে সুযোগ পেয়ে কারনে-অকারনে কুতুবকে হেয় করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করেন না মুবারক। এই মুবারকের নিকটেই রয়েছে সুলতানের সিদ্ধান্ত কার্যকরী করবার শিলমোহর যুক্ত শাহী পাঞ্জা (অফিসিয়াল স্ট্যাম্প)। মুবারকের উপর নজর পড়তেই নিজের বিদ্রোহের প্রথম ধাপ সফল করবার জন্য এক বুদ্ধি খেলে গেলো চতুর কুতুবের মস্তিষ্কে। কিন্তু সেই ধাপ পূর্ণ করবার জন্য প্রয়োজন দ্বিতীয় ধাপের।
দিন দুয়েক পরে মুবারক শাহের নিকটে কুতুব আর কাম্রুদ্দিন জানতে পারলেন উত্তর ভারতে মঙ্গোলদের আগ্রাসন আর মেবারের সেনাবাহিনীর মহা বিদ্রোহের হাত থেকে দিল্লির সম্পদকে রক্ষা করবার জন্য সুলতান সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দিল্লি থেকে সরে এসে দাক্ষিণাত্যের ভূমিতে তার নতুন রাজধানি নির্মাণের। কিন্তু তার পূর্বে তিনি দাক্ষিণাত্যের ভূমি থেকে নির্মূল করতে চান স্থানীয় ভূস্বামীদের যাবতীয় প্রতিরোধ। এই মুহূর্তে দাক্ষিণাত্যের প্রতিরোধ বাহিনীর প্রধান নেতা হোয়শালা নরেশ বীর বল্লাল। অতএব ছলে বলে আর কৌশলে বীর বল্লালকে পরাজিত করে তাঁকে হত্যা করে হোয়শালা রাজ্য অধিগ্রহণ করে সমগ্র দাক্ষিণাত্য সুলতানের পদানত করে নিষ্কণ্টক করতে হবে সুলতানের দাক্ষিণাত্যের নয়া রাজধানি। তার এই পদক্ষেপের প্রথম ধাপ হিসাবে আগামিকাল তিরুবন্নমালাইয়ের দিকের অভিযান শুরু করবে তুর্কি বাহিনী। গুপ্তচরের কাছ থেকে প্রাপ্ত সংবাদ অনুযায়ী আপাতত তিরুবন্নমালাইয়ের নিজের বাহিনী সমেত অবস্থান করছেন মহারাজ বীর বল্লাল। ওখানে উপস্থিত হয়ে আচমকা আক্রমণ করে বিধ্বস্ত করতে হবে অনমনীয় বৃদ্ধ কাফের রাজাকে। এই সংবাদ শুনেই নিজেদের বিদ্রোহের সফল রূপায়নের দ্বিতীয় এবং অন্তিম ধাপের উপায় খুঁজে পেলেন কুতুবউদ্দিন।

সেই রাতে যখন গভীর নিদ্রায় মগ্ন কুতুবউদ্দিন ঠিক সেই সময় তিনি স্বপ্নে দেখতে পেলেন তাঁর শয্যার চতুর্দিক এক অপার্থিব আলোকছটার মালায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠলো। এরপর সেই আলোকমালার মধ্যে তাঁর সম্মুখে এসে উপস্থিত হলেন স্বয়ং মীনাক্ষী আম্মান দেবী আর সুন্দরেশ্বর দেব। তাঁদের দর্শন করে গভীর বিস্ময়ে অভিভূত যবন সেনাপতি কুতুবউদ্দিন নিজের শয্যা ত্যাগ করে উঠে দাঁড়িয়ে তাঁদের শ্রদ্ধাপূর্বক কুর্নিশ করে ভাব বিহ্বল কণ্ঠে তাঁদের নিকটে এক বিধর্মী যবনের শিবিরে আগমনের হেতু জানতে চাইলেন। উত্তরে মীনাক্ষী আম্মান দেবী আর সুন্দরেশ্বর দেব কুতুবকে জানালেন যে অদূর ভবিষ্যতে তিনি এবং তাঁর অনুজ ভ্রাতা হতে চলেছেন দাক্ষিণাত্যের মুক্তির দূত। অচিরেই এক মহান গুরুর সান্নিধ্য লাভ করতে চলেছেন তাঁরা, যার সহায়তায় কুতুব আর কাম্রুদ্দিন যাবতীয় বাধা অতিক্রম করে তাঁদের স্মেচ্ছ যবন ধর্ম ত্যাগ করে পুনরায় তাঁদের পুরাতন সনাতন ধর্মে প্রত্যাবর্তন করে ভিনদেশি স্মেচ্ছ তুর্কি দস্যুদের পরাজিত ও বিতাড়িত করে দাক্ষিণাত্যকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে এই পবিত্র ভূমিতে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিজয়ের স্মারক চিহ্ন হিসাবে স্থাপিত করতে চলেছেন এক অপ্রতিরোধ্য শক্তিশালী সাম্রাজ্যের।
এরপর মীনাক্ষী দেবী আর সুন্দরেশ্বর দেব বরাভয়ের ভঙ্গিতে কুতুবকে আশীর্বাদ করে অন্তর্লীন হয়ে গেলেন। সেই সাথে নিবে গেল চতুর্দিকের সেই অপার্থিব আলোক রশ্মি। নিদ্রা ভগ্ন হয়ে ধড়মড় করে বিছানার উপর উঠে বসলেন কুতুব। পরেরদিন সকালে ভ্রাতা কাম্রুদ্দিনের নিকটে জানতে পারলেন গত রাতে মীনাক্ষী আম্মান দেবী আর সুন্দরেশ্বর প্রভুকে তাঁকেও স্বপ্নে দর্শন দিয়ে দাক্ষিণাত্যকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে বিজয়ের স্মারকযুক্ত এক শক্তিশালী হিন্দু সাম্রাজ্য গঠনের জন্য আশীর্বাদ করেছেন। এরপর দুই ভাই বহুকাল পরে অশ্রুশিক্ত চোখে বাষ্পরুদ্ধ ক্ষীণ স্বরে বলে উঠলেন, “জয় মীনাক্ষী আম্মান দেবীর জয় ! হর হর মহাদেব !”


হোয়শালা রাজ বীর বল্লালের প্রতিরোধ
===========================
এদিকে রাজপুতানায় যখন মহারানা হামীরের যোগ্য নেতৃত্বে তুর্কিদের বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়িয়েছে একদা কোণঠাসা হয়ে পড়া সনাতন সভ্যতার সেনানিরা তখন অপরদিকে সদুর দাক্ষিণাত্যে সনাতন সভ্যতা রক্ষার গুরুদায়িত্ব সম্পূর্ণরূপে নিজের স্কন্ধে তুলে নিয়ে একাকি শক্তিশালী তুর্কি বাহিনীর বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রামে লিপ্ত হোয়শালা রাজ্যের প্রাজ্ঞ শাসক মহারাজ তৃতীয় বীর বল্লাল। তুর্কি বাহিনীর পদানত হয়ে তাঁদের বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে দেবগিরি, কাকাতিয়া, পাণ্ড্য, কাম্পিলি সহ তামাম দাক্ষিণাত্যের ছোট-বড় প্রায় সব হিন্দু রাজ্যগুলিই। ব্যাতিক্রম কেবলমাত্র হোয়শালা। তুর্কি বাহিনীর দ্বারা বিধ্বস্ত ও ধ্বংসপ্রাপ্ত রাজধানি বেলুর আর হ্যালেবিরুর ক্ষতিগ্রস্ত মন্দিরগুলিতে পরিদর্শন করে তুর্কি লুণ্ঠকদের নিকটে কখনও মাথানত না করে তাঁদের বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্রামের শপথ গ্রহণ করেছেন রাজা বীর বল্লাল। কিন্তু আজ বয়সের ভারে ন্যুব্জ তিনি। এই মুহূর্তে তাঁর এই মহাসংগ্রামে বৃদ্ধ রাজার পাশে দাঁড়ানোর মতো কোন যোগ্য বীর যুবা পুরুষের সন্ধানও পাননি তিনি। নিজের মন্ত্রী আর অমাত্যদের মুখে শুনেছেন সদুর রাজপুতানার মহারানা হামীর সিংহ নামধারী এক অকুতোভয় বীর যুবা পুরুষের কাহিনী। প্রত্যহ নিজের প্রধান অমাত্যর মুখে প্রত্যহ মহারানার শৌর্য আর পরাক্রমের স্তুতি শ্রবণ করেন তিনি আর মনে মনে চিন্তা করেন, আহা মহারানার ন্যায় এমনি কোন বীরপুরুষ কবে জন্মগ্রহন করবেন এই হতভাগ্য দাক্ষিণাত্যের ভূমিতে। নিত্যদিনের ন্যায় সেদিনও অমাত্য প্রধানের মুখে মেবারের মহারানার বন্দনা শুনছেন তিনি এমন সময় এক রাজকীয় রক্ষী মহারাজের কক্ষে প্রবেশ করে যুক্তকর হস্তে তাঁকে জানালেন যে হোয়শালার অন্যতম শক্তিশালী সর্দার সঙ্গম রাজ এসেছেন তাঁর সাক্ষাৎ প্রার্থী হয়ে। রাজা বীর বল্লালের মহাসংগ্রামের অন্যতম প্রধান সাথী এই সঙ্গমরাজ। তিনি তুঙ্গাভদ্রার তীরে কাম্পিলি নামক এক ক্ষুদ্র জনপদের শাসক। পূর্বে তিনি ছিলেন এক শান্তিপ্রিয় ব্যক্তি। তাঁর পাঁচ সন্তানের মধ্যে অগ্রজ দুই সন্তানকে প্রেরন করেছিলেন শক্তিশালী কাকাতিয়া রাজ্যের শাসক প্রতাপরুদ্রের দরবারে চাকুরির সন্ধানে। রাজকৃপা লাভ করে ওরাগাল্লু কেল্লার বৈভবশালী রাজপ্রাসাদে মহাসুখে বসবাস করছিল তাঁরা। অপরদিকে কাম্পিলি নগরের কেল্লায় নিজের অবশিষ্ট তিন সন্তানকে নিয়ে সুখে অতিবাহিত করছিলেন সঙ্গমরাজ। কিন্তু বাধ সাধলো ভিনদেশি যবন দস্যুরা। তারা আচমকা হামলা করলেন ওরাগাল্লুর প্রাসাদ কেল্লায়। পরাজিত ও বন্দি হলেন স্বয়ং মহারাজ প্রতাপরুদ্র। রাজার সাথে বিধর্মী যবনদের হাতে বন্দি হলেন তাঁর দুই জ্যৈষ্ঠ সন্তান হরিহর আর বুক্কা রায়। এরপর তুর্কি হামলায় সঙ্গমরাজ খোয়ালেন তাঁর রাজধানি কাম্পিলি নগরীও। এই কষ্ট সহ্য করতে না পেরে গত হলেন তাঁর অর্ধাঙ্গিনী। অবশিষ্ট তিন সন্তান কম্পন, মারাপ্পা আর মুদাপ্পাকে নিয়ে তিনি যখন সর্বহারা হয়ে এক যাযাবরের জীবন যাপন করছেন ঠিক সেই সময় ঈশ্বরের প্রেরিত দূতের ন্যায় সঙ্গমরাজের পাশে এসে দাঁড়ান হোয়শালা নরেশ বীর বল্লাল। রাজকৃপায় তিনি হোয়শালার প্রাসাদে স্থান পান। এরপর তুর্কিদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধের নেশায় একদা শান্তিকামী সঙ্গমরাজ পরিনত হন এক যোদ্ধায়। হোয়শালা সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণের সহায়তায় তাঁর সন্তানরাও যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন। ক্রমে দাক্ষিণাত্যে তুর্কিদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা রক্ষার যুদ্ধে হোয়শালা নরেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সেনানী হয়ে ওঠেন সঙ্গমরাজ এবং তাঁর পুত্ররা। সেই সঙ্গমরাজের মুখেই মহারাজ বীর বল্লাল জানতে পারলেন তুর্কি সাম্রাজ্যের উত্তরপ্রান্তে ভিনদেশি মঙ্গোল লুণ্ঠকদের ভয়াবহ হামলা এবং সদুর রাজপুতানায় মেবারের মহারানার যুগপৎ আগ্রাসন আর মহাবিদ্রোহে ভীত ও সন্ত্রস্ত্র হয়ে তুর্কি সুলতান আপাতত তার রাজপুতানা অভিযান সাময়িকভাবে স্থগিত রেখে এক বিশাল বাহিনী প্রেরন করছেন দাক্ষিণাত্যের ভূমিতে হোয়শালা রাজ্যকে ছারখার করে দেবগিরির রাজধানি নগরে নয়া তুর্কি রাজধানি গঠন করবেন।

মাধবাচার্যের আশ্রমে
===============
সঙ্গমরাজের মুখে এই দুঃসংবাদ শুনে রাজা বীর বল্লাল তাঁর সেনাদের যুদ্ধের সাজে সজ্জিত করে সসৈন্যে যাত্রা করলেন হোয়শালা রাজ্যের দক্ষিণপ্রান্তে অবস্থিত তিরুবন্নমালাইয় নগরের দিকে। তাঁর রাজ্যের এই প্রান্তে যেতে হলে যাত্রা করতে হতো দক্ষিণঘাট পর্বতমালার ঘন অরন্যে আচ্ছাদিত দুর্গম ও বন্ধুর পথ দিয়ে। উন্মুক্ত প্রান্তরের পরিবর্তে ঘন অরন্যে ঢাকা এই পার্বত্য প্রদেশে ভিনদেশি তুর্কিদের আগ্রাসন প্রতিহত করা যে অপেক্ষাকৃত সহজ সেই পরামর্শটা রাজাকে দিয়েছিলেন সঙ্গমরাজই। এই পার্বত্য প্রদেশেই অরন্যের মধ্যে পর্ণকুটির নির্মিত আশ্রমে শিষ্য সমেত বসবাস করতেন মাধবাচার্য বিদ্যারন্য। তিনি ছিলেন সংস্কৃত ভাষার এক মহাপণ্ডিত ব্যক্তি। সনাতন দর্শন শাস্ত্রের উপর সর্বদর্শনসংগ্রহ এবং অদ্বৈত বেদান্তর উপর পঞ্চদাসী নামধারী দুটি অসাধারন সংস্কৃত পুস্তক লিপিবদ্ধ করে গেছেন তিনি। বিদ্যারন্যের পূর্বের মাধবাচার্যরা শৃঙ্গেরী সারদা পিঠমের মুখ্য পূজারী ছিলেন। সনাতন ভারতবর্ষের ধর্মীয় ইতিহাস অনুসারে অদ্বৈত বেদান্ত ধর্মাবলম্বীদের জন্য নির্মিত মোট চারটি বিখ্যাত মন্দিরের মধ্যে অন্যতম ছিল এই শৃঙ্গেরী সারদা পিঠম। ৮০০ খ্রিষ্টাব্দে শ্রী আদি শঙ্করাচার্য নিজে স্বয়ং এই শৃঙ্গেরী সারদা পিঠম মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর নির্মাণ করেছিলেন। এরপর দাক্ষিণাত্যের কাকাতিয়া, চোল, পাণ্ড্য এবং হোয়শালা রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় এই শৃঙ্গেরী সারদা পিঠম মন্দির এক বর্ধিষ্ণু মন্দিরের রূপ নেয়। সেই সাথে দাক্ষিণাত্যের ইতিহাসে শৃঙ্গেরী মন্দিরের প্রধান মাধবাচার্যরাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করেন। কিন্তু আজ আর সেদিন নেই। দ্বাদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে দাক্ষিণাত্যের বুকে শুরু হয় স্মেচ্ছ যবনদের একের পর এক হানাদারি। সেই হামলায় এখানকার অনান্য প্রসিদ্ধ মন্দিরগুলোর মতো ব্যপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয় শৃঙ্গেরী মন্দিরও। তুর্কি হানাদারদের আগ্রাসন থেকে নিজের শিষ্যদের প্রান রক্ষা করবার জন্য বাধ্য হয়ে দক্ষিণঘাট পর্বতমালার ঘন অরন্যে আবৃত এই দুর্গম স্থানে নিজের আশ্রম স্থাপন করেছেন মাধবাচার্য বিদ্যারন্য। রাজা বীর বল্লালের মতো তিনিও প্রতিনিয়ত স্বপ্ন দেখেন এক স্বাধীন ও সমৃদ্ধশালী দাক্ষিণাত্যের। রোজকার মতো সেরাতেও যোগাভ্যাস সম্পন্ন করে আর আহারাদি পর্ব সাঙ্গ করে নিজের কুটিরে বিশ্রাম নিতে গেলেন বিদ্যারন্য। কিছুক্ষণের মধ্যেই গভীর নিদ্রায় মগ্ন হয়ে পড়লেন তিনি। নিদ্রার মধ্যেই স্বপ্নে ত্রিশূলধারী রূপে তাঁকে দেখা দিলেন স্বয়ং সুন্দরেশ্বর মহাদেব। মাধবাচার্য গভীর ভক্তিভরে তাঁকে প্রনাম করতেই সুন্দরেশ্বর দেব তাঁর দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন। এরপর ধিরে ধিরে তাঁর রূপ পরিবর্তন হয়ে মহাদেবের শরীর বিভক্ত হয়ে দুই সৌম্যকান্তি তরুন যুবা দেখা দিলেন। তাঁদের একহাতে তীক্ষ্ণধার তরবারি এবং অপরহাতে সূর্য, চন্দ্র, খঞ্জর এবং বরাহ চিহ্ন অঙ্কিত এক বিশাল গৈরিক ধ্বজ। প্রাচীন দাক্ষিণাত্যের সমাজে এই চারটি চিহ্নকেই বিজয়ের চিহ্ন হিসাবে মনে করা হতো। এরপর মাধবাচার্য যেন বহুদূর থেকে শুনতে পেলেন সুন্দরেশ্বর দেবের বানী, “ধর্মের জয় হোক আর অধর্মের বিনাশ হোক”। ঠিক সেসময়ই নিদ্রাভগ্ন হলো মাধবাচার্যের। তাঁর স্বগক্তি শ্রবণ করে মাধবাচার্যের কক্ষে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন তাঁর দুই শিষ্য। তাঁরা মাধবাচার্যের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে উদ্বিগ্ন স্বরে জিগ্যেস করলেন, “কি হয়েছে গুরুদেব ?”
মাধবাচার্য শিষ্যদের দিকে তাকিয়ে স্মিত হাস্যমুখে বলে উঠলেন, “ধর্মের জয় হোক আর অধর্মের বিনাশ হোক। বহুকাল প্রতীক্ষার পরে বিধর্মী যবন রাক্ষসদের বধ করবার জন্য অবশেষে সদুর রাজপুতানার মহারানা হামীর সিংহের ন্যায় দাক্ষিণাত্যের ভূমিতেও পদার্পণ হয়েছে দুই মহান বীর যুবার। আমাকে শীগগির নিয়ে চলো মহারাজ বীর বল্লালের নিকটে”।

তিরুবন্নমালাইয়ের যুদ্ধ এবং হোয়শালা বাহিনীর পরাক্রম
========================================
দাক্ষিণাত্যের ভৌগোলিক পটভূমি সম্বন্ধে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল দুই ভাই কুতুব আর কাম্রুদ্দিন জানতেন যে তিরুবন্নমালাই যেতে গেলে তুর্কি বাহিনীকে অতিক্রম করতে হবে পশ্চিমঘাট পর্বতমালার ঘন অরন্যে আচ্ছাদিত বিপদ সঙ্কুল দুর্গম পথ। তুর্কি শিবির থেকে পলায়ন করতে হলে এটাই উত্তম সময়। বীর বল্লালের বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রার পূর্বে ওরাগাল্লু নগরের শিবিরে আজই অন্তিম রজনী। আসন্ন যুদ্ধযাত্রার পূর্বে তুর্কি শিবিরে তখন উৎসবের মেহফিল বসেছে। শিবিরে তখন চলছে দাক্ষিণাত্যের বিভিন্ন রাজপরিবার থেকে অপহরণ করে নিয়ে আসা রূপসী নর্তকীদের নৃত্য প্রদর্শনী আর সেইসাথে চলছে উদ্দাম সুরাপান। ঠিক এহেন সুযোগকেই কাজে লাগিয়ে নিঃশব্দে জনা দশেক বিশ্বস্ত দেহরক্ষী নিয়ে মুবারক শাহের শিবিরের দিকে এগিয়ে চললেন কুতুব আর কাম্রুদ্দিন। মদ্যপ মুবারক তাঁদের অভিসন্ধি বুঝতে না পেরে দুই ভাইকে সমাদর করে নিজের শিবিরে দেহরক্ষী সমেত প্রবেশ করতে দিলেন। এরপর নাচগান আর মদের আসর যখন জমে উঠেছে ঠিক সেই সময় কুতুবের ষড়যন্ত্র অনুসারে তাঁর দেহরক্ষীরা মুবারক এবং তাঁর দেহরক্ষীদের সুরার মধ্যে তীব্র ঘুমের ওষুধ মিশ্রিত করে দিলেন। সেই সুরা আকণ্ঠ পান করে কিছুক্ষণের মধ্যেই গভীর নিদ্রামগ্ন হয়ে পড়লেন মুবারক এবং তাঁর অঙ্গরক্ষকরা। সেই সুযোগের সদবহার করে মুবারকের সিন্দুক ভেঙে সেখানে রক্ষিত সুলতানের শাহী শিলমোহর হাতিয়ে নিলেন কুতুবউদ্দিন। তারপর নিশুতি রাতের ঘন আধারের অন্তরালে নিঃশব্দে তাঁরা এসে উপস্থিত হলেন তুর্কি শিবিরের পশ্চাৎভাগে অবস্থিত অশ্বশালায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই অশ্বশালায় এসে উপস্থিত হলেন কুতুবদের বিশ্বস্ত অবশিষ্ট পাঁচশত সিপাহীও। এরপর তাঁরা তরবারি আর সুতীক্ষ্ণ খঞ্জর নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন অশ্বশালার প্রহরায় থাকা অর্ধ নিদ্রিত তুর্কি রক্ষীদের উপর। কিছুক্ষণের মধ্যেই তুর্কি রক্ষীদের বধ করে অশ্বশালা থেকে প্রয়োজন মতো বেশ কয়েকটি তেজি তুর্কি অশ্ব চুরি করে তার উপর সওয়ার হয়ে বসলেন কুতুবউদ্দিন ওরফে হরিহর রায়। এরপর তিনি তাঁর বিশ্বস্ত সিপাহীদের দিকে তাকিয়ে উদ্দাত্ত ও দৃপ্ত কণ্ঠে বলে উঠলেন, “আমার প্রিয় ভাই এবং মিত্রগণ অবশেষে সঠিক সময়কাল আসন্ন হয়েছে। এবারে আমরা বিছিন্ন সন্তানরা ফিরে যাবো আমাদের মায়ের কাছে। বহুকাল ধরে দাক্ষিণাত্য মাতা মুখবুজে সহ্য করেছে বিধর্মীদের বহু যাতনা। মায়ের কাছে ফিরে গিয়ে আমরা বিধর্মী স্মেচ্ছ দস্যুদের উপড়ে ফেলে শৃঙ্খলাবদ্ধ মাকে মুক্ত করবো। জয় মীনাক্ষী মাতা ! হর হর সুন্দরেশ্বর !”
তারপর রাতের আধারকে চিঁড়ে তিরুবন্নমালাইয়ের পানে তিরবেগে ছুটতে শুরু করলো পাঁচশত তুর্কি অশ্ব।

আনুমানিক ১৩৩০-৩১ সালের মধ্যভাগে তুর্কি দস্যুবাহিনীকে প্রতিরোধ করবার জন্য তিরুবন্নমালাই নগর থেকে উত্তরপ্রান্তে দক্ষিণঘাট পর্বতমালার পাদদেশের দিকে সসৈন্যে এগিয়ে এলেন অনমনীয় হোয়শালা নরেশ বীর বল্লাল। রাজা বীর বল্লাল তিরুবন্নমালাইয়ের যুদ্ধকে এক ধর্মযুদ্ধের আখ্যা দান করে নিকটবর্তী সমস্ত অবশিষ্ট হিন্দু ভূস্বামীদের আহ্বান জানালেন এই ধর্মযুদ্ধে সামিল হয়ে দাক্ষিণাত্যের ভূমিতে সনাতন ধর্ম ও সভ্যতাকে রক্ষার জন্য। অকুতোভয় রাজার ডাকে সাড়া দিয়ে যুদ্ধে সামিল হলেন বহু স্থানীয় হিন্দু ভূস্বামী। যুদ্ধের প্রধান সেনাপতি হিসাবে রাজা নিযুক্ত করলেন হাক্কা-বুক্কার পিতা সঙ্গমরাজকে। বীর বল্লালের চতুরঙ্গ বাহিনী সজ্জিত হলো পদাতিক, অশ্বারোহী, গজবাহিনী এবং ধনুর্ধর বাহিনী দ্বারা। অপরদিকে তুর্কিদের বাহিনী সজ্জিত ছিল পদাতিক। দ্রুতগতির হাল্কা অশ্বারোহী এবং শ্লথগতির ভারী অশ্বারোহী বাহিনী, তীরন্দাজ আর গোলন্দাজ বাহিনী দ্বারা। এর মধ্যে গোলন্দাজ বাহিনী ছিল তৎকালীন যুগের দাক্ষিণাত্যের সনাতন ধর্মাবলম্বী রাজাদের একের পর এক পরাজয়ের মুখ্য কারন। তুর্কি গোলন্দাজ বাহিনী সজ্জিত ছিল ট্রাবুচেট এবং ব্যালিস্টা দ্বারা। এই ধরনের অস্ত্র পাঠকরা নিশ্চয়ই পদ্মাবত সিনেমায় আলাউদ্দিন খিলজির বাহিনীতে দেখেছেন। ট্রাবুচেট দিয়ে কামান বা তোপের ন্যায় বহুদূর পর্যন্ত বিশাল বিশাল প্রস্তরখণ্ড নিক্ষেপ করা হতো শত্রু শিবিরের উপর আর অতিকায় ধনুক ব্যালিস্টা দিয়ে ক্ষেপণাস্ত্রের ন্যায় সুবিশাল অতিকায় তির নিক্ষেপ করে একসাথে হত্যা করা হতো বহু শত্রুকে। এই ধরনের আধুনিক মধ্যযুগীয় সমরাস্ত্র দাক্ষিণাত্যের সনাতনী রাজাদের নিকট অনুপস্থিত থাকার ফলে ইতিপূর্বে মালিক কাফুর এবং মহম্মদ বিন তুঘলকের নিকটে বহুবার পরাজয়ের মুখোমুখি হতে হয়েছে তাঁদের। তুর্কিদের বিরুদ্ধে বহু যুদ্ধের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন হোয়শালা নরেশ বীর বল্লাল এইসব সমরাস্ত্র সম্বন্ধে পূর্ব থেকেই ওয়াকিবহাল ছিলেন বলে যুদ্ধক্ষেত্রে নিজ সেনাদের রক্ষার জন্য একাধিক ট্রেঞ্চ খনন করে রেখেছিলেন।

দুই যুযুধান বাহিনী মুখোমুখি হলো তিরুবন্নমালাইয় নগর থেকে বেশ কিছুটা দূরবর্তী এক প্রান্তরে। উত্তরে তুর্কি বাহিনীর পশ্চাৎভাগে বিরাজমান ছিল অরন্যে আচ্ছাদিত পশ্চিমঘাট পর্বতমালা। ১৩৩১ সালের মে মাসের এক ভোরে বেজে উঠলো ধর্মযুদ্ধের দামাম। আল্লাহ-আকবর ধ্বনিতে বীর বল্লালের বাহিনীর উপর নাগাড়ে প্রস্তরখণ্ডের গোলা আর অতিকায় তির বর্ষণ শুরু করলো তুর্কি বাহিনী। হোয়শালার সেনাবাহিনী ট্রেঞ্চে আত্মগোপন করে নিজেদের সুরক্ষিত করলেন। একসময় নিঃশেষ হয়ে এলো তুর্কি শিবিরের প্রস্তর গোলা আর অতিকায় তির। কিন্তু সেরকম কোন প্রভাব পড়লো না বীর বল্লালের বাহিনীর উপর। এই দৃশ্য প্রত্যক্ষ করে অবার্চীন কাফের হোয়শালা রাজার প্রতি ভয়ানক ক্রুদ্ধ হয়ে মুবারক শাহ তাঁর হাল্কা অশ্বারোহী বাহিনীকে নির্দেশ দিলেন আক্রমনের। তুর্কি অশ্বারোহী বাহিনী তাঁদের ঘোড়ার খুড়ে ধুলো উড়িয়ে আল্লাহ-আকবর রবে ধেয়ে গেল হোয়শালা বাহিনীর দিকে। সেনাপতি সঙ্গমরাজের নির্দেশে হোয়শালার তিরন্দাজরা এবারে পাল্টা তির বর্ষণ শুরু করলো তুর্কি বাহিনীর উপর। তিরের আঘাতে বেঘোরে মারা পড়লো বেশ কিছু হাল্কা তুর্কি অশ্বারোহী সেনা। বাকিরা আরও কাছে আসতেই সঙ্গম পুত্র কুমার কম্পন অশ্বপৃষ্ঠে আসীন হয়ে তরবারি হস্তে নিজ বাহিনী সমেত “জয় সুন্দরেশ্বর” রবে গগন বিদীর্ণ করে ঝাঁপিয়ে পড়লেন তাদের উপর। কুমার কম্পনের তীক্ষ্ণ অসির ফলার আঘাতে মারা পড়লো অধিকাংশ তুর্কি সেনা। বাকিরা কোনরকমে প্রান হাতে করে পলায়ন করতে বাধ্য হলো। এরপর বিরক্ত মুবারক শাহ নিজে তাঁর ভারী অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে ধেয়ে এলেন হোয়শালা বাহিনীর দিকে। দুই সঙ্গম পুত্র মারাপ্পা আর মুদাপ্পা তাঁদের হস্তী পৃষ্ঠে আসীন হয়ে “জয় মীনাক্ষী মাতা” রবে হিংস্র শার্দূলের ন্যায় ধেয়ে গেলেন মুবারক শাহদের পানে। শুরু হলো এক ভয়ানক রক্তক্ষয়ী ধর্মযুদ্ধ (ক্রুসেড)। বিকেলের দিকে হোয়শালা হস্তী বাহিনীর পদদলিত হয়ে বিধ্বস্ত মুবারক শাহের তুর্কি বাহিনী যখন ঘুরে দাঁড়ানোর প্রানপন প্রয়াসে ব্যস্ত ঠিক সেই সময় পশ্চাৎভাগের পশ্চিমঘাট পর্বতমালার ঢাল বেয়ে “হর হর সুন্দরেশ্বর” রবে উন্মুক্ত তরবারি হস্তে তুর্কি বাহিনীর দিকে ধেয়ে এলো পাঁচশত অজ্ঞাত পরিচয় অশ্বারোহী বাহিনী। তাঁদের তরবারির আঘাতে রক্তাক্ত কলেবরে ক্ষতবিক্ষত দেহে একের পর এক লুটিয়ে পড়তে লাগলো স্মেচ্ছ তুর্কি বাহিনী। কুতুবউদ্দিনের তরবারির আঘাতে তুর্কি সেনাপতি মুবারক শাহ গুরুতর আহত হয়ে ধরাশায়ী হয়ে মুহূর্তের মধ্যে জাহান্নমের পথে যাত্রা করলেন। অবশিষ্ট তুর্কি বাহিনী তীব্র আতঙ্কে ছত্রভঙ্গ হয়ে রনে ভঙ্গ দিয়ে সমরভূমি ত্যাগ করে তিরবেগে পলায়ন করলেন।

তিরুবন্নমালাইয়ের ধর্মযুদ্ধে অভূতপূর্ব বিজয়লাভ করলেন রাজা বীর বল্লাল। ভিনদেশি স্মেচ্ছ বাহিনীর বিরুদ্ধে জয়লাভের পর হোয়শালা বাহিনী যখন আনন্দ উৎসবে ব্যস্ত ঠিক সেই সময় সঙ্গমরাজকে সাথে নিয়ে দুই অজ্ঞাত পরিচয় সাহায্যকারী যবন যোদ্ধা কুতুব আর কাম্রুদ্দিনের সাথে দেখা করতে এলেন রাজা বীর বল্লাল। রাজার সাথে দেখা করবার কর রাজা তাঁদের পরিচয় এবং সামরিক সাহায্যের কারন জানতে চাইলেন। তখন কুতুব নিজেদের আসল পরিচয় দিয়ে সংক্ষেপে নিজেদের পূর্ব জীবনের কাহিনী শুনিয়ে সনাতন ধর্মের রক্ষার জন্য হোয়শালা বাহিনীতে যোগদান করবার আগ্রহ প্রকাশ করলেন। এদিকে বহুকাল প্রতীক্ষার পর নিজের দুই হারানো সন্তান হাক্কা আর বুক্কাকে ফিরে পেয়ে এক অনাবিল আবেগে অশ্রুশিক্ত হয়ে উঠলো সঙ্গমরাজের দুই চক্ষু। সঙ্গমরাজের বাকি তিন সন্তান কম্পন, মারাপ্পা আর মুদাপ্পাও তাঁদের জ্যৈষ্ঠ দুই ভ্রাতার সাথে পুনর্মিলিত হয়ে আবেগে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লেন। রাজা বীর বল্লালও তিরুবন্নমালাইয়ের যুদ্ধে হাক্কা-বুক্কার অসাধারন শৌর্য আর পরাক্রম দেখে অভিভূত হয়ে নিজের সেনাবাহিনীতে তাঁদের সামিল করতে রাজি হলেন। কিন্তু অচিরেই রাজার ইচ্ছায় বাধ সাধল হোয়শালার প্রভাবশালী ব্রাহ্মণ পুরোহিতগণ, অমাত্য পরিষদ আর অনান্য সামন্ত রাজারা। তাঁরা সমশ্বরে বলে উঠলেন দুজন ধর্মচ্যুত বিধর্মী স্মেচ্ছ যবন ব্যক্তিকে কিছুতেই যুক্ত করা যাবে না হোয়শালা বাহিনীতে। নিজের বিদ্রোহী গোঁড়া সভাসদদের সাথে প্রবল বাকবিতণ্ডার পরে হার মানতে বাধ্য হলেন রাজা বীর বল্লাল। তিনি হাক্কা-বুক্কার দিকে তাকিয়ে বেদনা বিধুর স্বরে বলে উঠলেন, “হে দুই তরুন যুবা, আমি নিরুপায়। হোয়শালা রাজ্যের বাহিনীতে তোমাদের জন্য কোন স্থান নেই।”
রাজা সবেমাত্র তাঁর বক্তব্য শেষ করেছেন এমন সময় অদূরপ্রান্ত থেকে শোনা গেল এক অতি পরিচিত কণ্ঠস্বর, “ধর্মের জয় হোক, অধর্মের বিনাশ হোক”। সবাই চমকিত হয়ে দেখতে পেলেন অকুস্থলের দিকে ধির নিশ্চল পদক্ষেপে তাঁর দুই শিষ্য সমেত এগিয়ে আসছেন স্বয়ং মাধবাচার্য বিদ্যারন্য।

মাধবাচার্যের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ
===================
মাধবাচার্য বিদ্যারন্যকে এগিয়ে আসতে দেখে মুহূর্তের মধ্যে স্তব্ধ হয়ে পড়লো বাকবিতণ্ডায় দীর্ণ রাজা বীর বল্লালের আনন্দ উৎসবের মঞ্চ। স্বয়ং রাজা মাধবাচার্যের দিকে ফিরে যুক্তকর হস্তে নতনাজু হয়ে তাঁকে প্রনাম জানালেন। রাজার দেখাদেখি সঙ্গমরাজ, তাঁর তিন কনিষ্ঠ পুত্র এবং উৎসবে উপস্থিত অনান্য মন্ত্রী পারিষদ আর ব্রাহ্মণ পুরোহিতরাও তাঁকে স্বশ্রদ্ধ প্রনাম জানালেন। এরপর রাজা বিনম্র স্বরে মাধবাচার্যের নিকট তাঁর আগমনের হেতু জানতে চাইলেন। মাধবাচার্য বিদ্যারন্য কোন উত্তর না দিয়ে স্মিত হাস্যমুখে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন অদূরেই সংকোচিত ভাবে স্মেচ্ছ তুর্কি পোশাক পরিহিত অবস্থায় দণ্ডায়মান কুতুবউদ্দিন আর কাম্রুদ্দিনের দিকে। মাধবাচার্যের সাথে দৃষ্টি বিনিময় হতেই দুই ভ্রাতা সমস্ত দ্বিধা আর সঙ্কোচ বিস্মৃত হয়ে তাঁর সম্মুখে এগিয়ে এসে নতনাজু হয়ে মাধবাচার্যের পদজুগল স্পর্শ করে গভীর আবেগপূর্ণ স্বরে বলে উঠলেন, “প্রনাম গুরুদেব। স্মেচ্ছ শিবিরে বহুকাল বন্দি জীবন অতিবাহিত করবার পর আবার আমরা ফিরে এসেছি আমাদের জন্মভূমিতে। মহারানা হামীর সিংহের আদর্শে নিজেদের বলীয়ান করে আমরা দুই ভাই নিজেদের অবশিষ্ট জীবন উৎসর্গ করতে চাই বিধর্মী স্মেচ্ছ যবনদের গ্রাস থেকে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে শৃঙ্খলা মুক্ত করবার জন্য। দয়া করে আমাদের ফিরিয়ে দেবেন না গুরুদেব”।

মাধবাচার্য বিদ্যারন্য শান্ত, সমাহিতভাবে কুতুব আর কাম্রুদ্দিনের মাথায় তাঁর দুহাত স্পর্শ করে বলে উঠলেন,
"যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানিরভবতী ভারত
অভুথ্যানম অধর্মস্য তদাতমনম শ্রীজামায়াম
পরিত্রানয়া সাধুনাং বিনাশায়ও চা দুষ্কৃতাম
ধর্মসংস্থাপনার্থে সম্ভবানী যুগে যুগে ।।
স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণের এই অমোঘ বানীকে এক মহা সত্যে পরিনত করে দেবাদিদেব সুন্দরেশ্বর আর মাতা মীনাক্ষী দেবীর আশীর্বাদে সদুর রাজপুতানায় যেমন অভুথ্যান হয়েছে মহারানা হামীর সিংহের, ঠিক তেমনি এই দাক্ষিণাত্যের ভূমিতে মুক্তির দূত হিসাবে তোমাদের প্রেরন করেছেন মীনাক্ষী মাতা আর সুন্দরেশ্বর দেব। অদূর ভবিষ্যতে তোমাদের দুই ভ্রাতার বাহুবল আর অসির জোরে কলঙ্ক মুক্ত হবে দাক্ষিণাত্য। হে বৎস উঠে দাঁড়াও তোমরা, তোমাদের হাতে সময় স্বল্প, কিন্তু লক্ষ্য বিশাল। হোয়শালার সেনাবাহিনীতে যোগদান তোমাদের বিধির বিধান। তা খণ্ডাতে পারবে না কেউই।”

মাধবাচার্যের ভাষণ শুনে বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে পড়লেন সঙ্গমরাজ এবং মহারাজ বীর বল্লাল। যারপরনাই ক্ষুব্ধ হলেন হোয়শালার ব্রাহ্মণ পুরোহিত বর্গ। প্রধান রাজপুরোহিত সুন্দরা আপ্পা তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলে উঠলেন, “মাননীয় মাধবাচার্য মহাশয়, আমাদের দাক্ষিণাত্যের ব্রাহ্মণ পুরোহিতবর্গের নিকটে আপনি দেবতুল্য। আপনার সর্ব উপদেশ আমরা সবসময় আশু নির্দেশ হিসাবে পালন করে এসেছি। কিন্তু এযাত্রা আমরা আপনার উপদেশ পালন করতে অপারগ। একদিকে আপনি ধর্মের জয় এবং অধর্মের বিনাশ কামনা করছেন, অপরদিকে আপনি ধর্মচ্যুত দুইজন স্মেচ্ছ যবনকে আমাদের মুক্তির দূত হিসাবে ঘোষণা করে তাঁদের মহারাজার সেনাবাহিনীতে যোগদান করবার নির্দেশ দিচ্ছেন। এ কেমনধারা দুমুখো বিচার আপনার ? আমরা পুরোহিতরা স্বধর্ম অবস্থায় জীবিত থাকতে কখনই এই অনাচার সহ্য করবো না। সঙ্গমরাজের ধর্মচ্যুত দুই অপবিত্র স্মেচ্ছ সন্তানদের অবিলম্বে হোয়শালা রাজ্য থেকে নিলম্বিত করার জোরালো দাবি জানাচ্ছি আমরা।”
ব্রাহ্মণদের দাবিতে সায় জানালো হোয়শালার ক্ষত্রিয় যোদ্ধা এবং অমাত্য পারিষদরাও। চতুর্দিকে যখন কুতুব আর কাম্রুদ্দিন ভ্রাতাকে নিলম্বিত করবার দাবি জোরালো হচ্ছে ঠিক এহেন সময় মাধবাচার্য বিদ্যারন্য তাঁর চিরপরিচিত শান্ত-সৌম্য কণ্ঠে বলে উঠলেন, “আপনারা হয়তো বিস্মৃত হয়ে পড়েছেন যে পূর্বে এরাও আমার-আপনার মতোই সনাতন ধর্মাবলম্বী ছিলেন। যবনদের দ্বারা তীব্র অত্যাচারের সম্মুখীন হয়ে এরা স্মেচ্ছ ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছেন। সেদিন যখন যবন বাহিনী এদের বন্দি করে দিল্লির কারাগারে নিয়ে গিয়ে বলপূর্বক গোমাংস ভক্ষণ করিয়ে স্মেচ্ছ ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য করেছিল, তখন কেন কোনরূপ বাধা দান করেননি আপনারা ব্রাহ্মণ পুরোহিতরা ? তখন কোথায় লুকায়িত হয়ে পড়েছিল আপনাদের ধর্মীয় আচার-আচরণ ? ভিনদেশি স্মেচ্ছ দস্যু সর্দার আলাউদ্দিন খিলজি, মালিক কাফুর এবং মহম্মদ বিন তুঘলক যখন আমাদের মাতৃভূমির উপর একের পর এক হামলা পরিচালনা করছিল, আমাদের একের পর এক ধর্মীয় স্থান ধ্বংস করছিল, বেলুর এবং হ্যালেবিরুতে অগনিত নিরীহ আর নিরস্ত্র ভক্তগণদের নির্মমভাবে গনহত্যা করছিল, মাদুরাই নগরে যখন মীনাক্ষী আম্মান মাতা আর সুন্দরেশ্বর দেবের পবিত্র মন্দিররাজি ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে আমাদের ধর্মকে সমূলে উৎপাটিত করছিল, তখন কোথায় ছিল আপনাদের ধর্মীয় রীতিনীতি ? আজ যখন বিজাতীয় শক্তির হাতে পদানত মাতৃভূমি, বিধর্মী স্মেচ্ছদের রক্তচক্ষুর সম্মুখে সঙ্কটাপন্ন সনাতন ধর্ম তখনও আপনাদের মনের মধ্যে এহেন ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতার উদ্ভব হয় কোথা থেকে ? স্বয়ং মীনাক্ষী মাতা আর সুন্দরেশ্বর দেব স্বপ্নে আমাকে দেখা দিয়ে জানিয়েছেন এঁরাই আমাদের মুক্তির দূত। আমি ওদের পুনরায় স্বধর্মে ফিরিয়ে এনে দুই ভ্রাতাকে মহান ক্ষত্রিয় যোদ্ধা হিসাবে ইতিহাসের পাতায় চির অমর হতে সহায়তা করবো। আজ পুনর্জন্ম হবে এদের। দেখি আমাকে বাধা দান করবার মতো দুঃসাহস আর স্পর্ধা কার হয়। জয় সুন্দরেশ্বর।”

হাক্কা-বুক্কার স্বধর্মে প্রত্যাবর্তন
=====================
বলাই বাহুল্য মাধবাচার্যের এহেন আবেগপূর্ণ ভাষণের পর আর প্রতিবাদ জানানোর মতো দুঃসাহস হলো না কারও। সেদিনই মাধবাচার্যের সাথে তাঁর আশ্রমে গেলেন কুতুবউদ্দিন, কাম্রুদ্দিন আর তাঁদের চির বিশ্বস্ত পাঁচশত কাকাতিয়া সিপাহী। মাতৃভূমিতে প্রত্যাবর্তনের পর এবারে মাধবাচার্য এবং তাঁর শিষ্যদের সাহায্যে ইসলাম ধর্ম বর্জন করে পুনরায় বহু শতাব্দী প্রাচীন স্বধর্মে প্রত্যাবর্তন করে পুনর্জন্ম লাভ করলেন তাঁরা। প্রত্যাবর্তনের পর পুনরায় তাঁদের নাম হলো হরিহর আর বুক্কা রায়। এরপর সারম্ভে হোয়শালা সেনাবাহিনীতে যোগদান করলেন তাঁরা। নিজেদের জীবনের বেশ কয়েকটি বছর তুর্কি বাহিনীতে অতিবাহিত করবার ফলে তুর্কি শিবিরের ছল-কপটতা পূর্ণ আধুনিক যুদ্ধনিতি সম্বন্ধে যথেষ্ট পরিচিত ছিলেন তাঁরা। দাক্ষিণাত্যের স্বাধীনতা সংগ্রামে তুর্কিদের বিরুদ্ধে সফলতার সাথে তুর্কি যুদ্ধনিতিই গ্রহণ করলেন তাঁরা। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই রাজা বীর বল্লালের অত্যন্ত প্রিয়পাত্র হয়ে উঠলেন তাঁরা। এদিকে সৌম্যকান্তি বীর যুবা পুরুষ হরিহর রায়ের সাথে প্রনয় বন্ধনে আবদ্ধ হলেন বীর বল্লালের এক নাতনী, রাজকুমারী অরুন্ধুতী।

হোসাপট্টনার যুদ্ধ এবং বিজয়নগরের নির্মাণ
===============================
ইতিমধ্যেই অতিবাহিত হয়েছে আরও কয়েকটি বছর। মঙ্গোল আক্রমণ এবং মহারানা হামীর সিংহের অভুথ্যানে সন্ত্রস্ত্র হয়ে প্রাচীন দেবগিরি রাজ্যের রাজধানিতে নিজের নতুন রাজধানি স্থাপন করেছিলেন সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলক। হিন্দু রাজ্য দেবগিরি অধিকার করবার পর তাঁদের রাজধানির নাম পরিবর্তন করে “দৌলতাবাদ” রেখেছেন তিনি। তখন ১৩৩৫সালের অন্তিম ভাগ। পিতা সঙ্গমরাজের অনুরোধে একদিন রাজা বীর বল্লাল তাঁদের উপর দায়িত্ব অর্পণ করলেন তাঁদের পৈত্রিক ভূমি কাম্পিলি রাজ্যের রাজধানি হোসাপট্টনা নগর তুর্কিদের অধিকার মুক্ত করবার। তুঙ্গাভদ্রা নদীর তটে অবস্থিত প্রাচীন হোসাপট্টনা নগর চতুর্দিক দিয়ে এক সুউচ্চ প্রাকার দ্বারা বেষ্টিত ছিল। সেই প্রাকার নগরীর নিরাপদ ঘেরাটোপের মধ্যে নিজের ৫০০০ সিপাহী সমেত সেনা শিবির স্থাপন করে বসবাস করছিল তুর্কি সেনাধক্ষ্য সুলেমান পাশা। সরাসরি যুদ্ধ করে জয়লাভ বেশ সময় সাপেক্ষ ব্যপার ছিল। আবার হোসাপট্টনার যুদ্ধ অধিকদিন স্থায়ী হলে সুলেমান পাশার দূতের পত্র পেয়ে দৌলতাবাদ থেকে বিশাল তুর্কি সেনা প্রেরন করতে অধিক সময় লাগবে না সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলকের। অতএব এক ঝটিকা আর অপ্রতাশিত যুদ্ধের সাহায্যে দ্রুত স্বাধীন করতে হবে নিজেদের পিতৃভূমি হোসাপট্টনা নগর।

তিরুবন্নমালাইয়ে রাজা বীর বল্লালের গোপন মন্ত্রনাকক্ষে আয়োজন করা হলো এক বিশেষ সভার। সভায় যুদ্ধের জন্য মহারাজের নিকটে ২০০০ সেনা চাইলেন সেনাপতি হরিহর রায় (হাক্কা)। আর সেই সাথে নিজের বিশ্বস্ত পাঁচশত সিপাহীকে সামিল করলেন হোসাপট্টনার যুদ্ধযাত্রায়। নিজের দুই কনিষ্ঠ ভ্রাতা কম্পন রায় আর মারাপ্পা রায়কে হোয়শালার অবশিষ্ট ২০০০ বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে তাঁদের লুকিয়ে রাখলেন হোসাপট্টনা নগরের অনতিদূরে ঘন অরন্য আর পর্বতে ঘেরা এক বিশেষ গুপ্ত স্থানে। এরপর হাক্কা রায় নিজে তাঁর বিশ্বস্ত ভ্রাতা বুক্কা আর পাঁচশত সেনাকে নিয়ে পুনরায় তুর্কিদের ছদ্মবেশ ধারন করে হোসাপট্টনা নগর কেল্লার দিকে অগ্রসর হলেন তাঁরা। হাক্কা এবং বুক্কা সসৈন্যে যখন হোসাপট্টনা নগর কেল্লায় এসে পৌঁছলেন তখন সন্ধ্যাকাল আসন্ন। নগরের চতুর্দিক থেকে ভেসে আসছে আজানের ধ্বনি। নগরের তুর্কি দ্বাররক্ষী তাঁদের পরিচয় জানতে চাইলে হাক্কা আর বুক্কা চোস্ত ফার্সি ভাষায় নিজেদের সুলতানের বিশেষ সেনাপতির হিসাবে পরিচয় দিলেন। তাঁদের বেশভূষা আর আচার আচরণ দেখে এবং ভাষা শুনে দ্বার রক্ষীদের মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহের উদ্রেগ হলো না। প্রাকারের ফটক উন্মুক্ত করে দিলেন তাঁরা। এরপর হোসাপট্টনা নগরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলেন তাঁরা। নগরের বিধ্বস্ত মন্দিররাজি এবং স্বল্প সংখ্যক সনাতন ধর্মাবলম্বী প্রজাদের শোচনীয় দুর্দশা দর্শন করে ব্যাথিত হলো তাঁদের হৃদয়। কিন্তু বাইরে তা প্রকাশ না করে তাঁরা এসে উপস্থিত হলেন নিজেদের পূর্ববর্তী পারিবারিক প্রাসাদে। নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাসে আজ সেই প্রাসাদ তুর্কি নগর কোটাল সেনাধক্ষ্য সুলেমান পাশার বাসস্থান। একদা প্রত্যহ সন্ধ্যায় যে প্রাসাদে সন্ধ্যারতি হতো, শঙ্খনাদ শোনা যেতো আর কাঁসর ঘণ্টার মধুর ধ্বনি অনুরনিত হতো আজ সেই প্রাসাদ থেকে ভেসে আসছে স্মেচ্ছদের আজানের ধ্বনি। আজান শেষে দুই ভাইয়ের সাথে এসে সাক্ষাৎ করলেন সুলেমান পাশা। তিনি তাঁদের আগমনের হেতু জানতে চাইলে তাঁরা সুলেমানকে কুর্নিশ করে জানালেন যে মহামান্য সুলতান হজরতের নির্দেশে তাঁরা এসেছেন হোসাপট্টনা নগরীর শাসনের দায়িত্বভার গ্রহণ করতে। সুলতান সুলেমান পাশাকে ডেকে পাঠিয়েছেন তাঁর নয়া রাজধানি দৌলতাবাদে। সেখানে অন্য এক গুরুত্বপূর্ণ অভিযানে সুলেমানকে প্রেরন করবেন তিনি। এরপর সুলতানের নির্দেশের প্রমান হিসাবে হরিহর রায় একটি পত্র এগিয়ে দিলেন সুলেমানের দিকে। পত্রে স্পষ্টরূপে লিখিত রয়েছে সুলতানের নির্দেশ। পত্রের নিচে রয়েছে সুলতানের স্বাক্ষর যুক্ত শাহী শিলমোহরের ছাপ। ওরাগাল্লু কেল্লায় অবস্থিত মুবারক শাহের শিবির থেকে পলায়নের সময় তার সিন্দুক ভেঙে চুরি করে আনা সুলতানের শাহী শিলমোহর দিয়েই এই নকল পত্রটি তৈরি করেছিলেন চতুর চূড়ামণি হরিহর রায়।

পত্রে খোদ সুলতানের শাহী শিলমোহরের চিহ্ন দর্শন করে মনে আর কোন সন্দেহ রইলো না সুলেমানের। তিনি হাক্কা আর বুক্কার সম্মুখে নতনাজু হয়ে কুর্নিশ করে বলে উঠলেন, “মহামান্য সুলতান হজরতের নির্দেশই পালিত হবে হুজুর। আজ থেকে হোসাপট্টনা নগর আর এই কেল্লা আপনাদের অধীনে সঁপে দিলাম আমি।” এরপর পরেরদিন প্রত্যুষে হোসাপট্টনা নগরে নিজের বিশ্বস্ত কিছু সিপাহীকে রেখে অবশিষ্ট সেনাদের নিয়ে নগর ত্যাগ করে দৌলতাবাদের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন সুলেমান পাশা। সুলেমান এবং তার তুর্কি বাহিনী নগর ত্যাগ করতেই নিজেদের স্বমূর্তি ধারন করলেন হাক্কা আর বুক্কা। প্রবল ঘৃণাভরে নিজেদের তুর্কিবেশ ত্যাগ করে নিজেদের তীক্ষ্ণধার অসি উন্মুক্ত করে “জয় মীনাক্ষী মাতা” রবে চতুর্দিক বিদীর্ণ করে বিশ্বস্ত পাঁচশত সেনা সমেত ক্ষুধার্ত সিংহের ন্যায় ঝাঁপিয়ে পড়লেন নগরে অবস্থানকারী অবশিষ্ট তুর্কি বাহিনীর উপর। এই অতর্কিত হামলার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিল না তুর্কিরা। কিছুক্ষণের মধ্যেই হাক্কা-বুক্কার অসির আঘাতে ক্ষতবিক্ষত রক্তাপ্লুত অবস্থায় ভূলুণ্ঠিত হয়ে জাহান্নমের পথে যাত্রা করলো তারা। এরই মধ্যে জনা দুয়েক তুর্কি সিপাহী আহত অবস্থাতে কোনমতে হাক্কা-বুক্কার নজর এড়িয়ে নিজেদের প্রান বাঁচিয়ে কাপুরুষের ন্যায় পলায়ন করলো। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর অবশেষে বিধর্মী স্মেচ্ছ বাহিনীর অধিকার মুক্ত হলো হোসাপট্টনা নগর। হরিহর রায়ের নির্দেশে নগর প্রাসাদের বুরুজের উপর থেকে অর্ধচন্দ্র অঙ্কিত সবুজ রঙের তুর্কি পতাকা প্রবল ঘৃণাভরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে স্বগর্বে বুরুজ শীর্ষে স্থাপিত হলো বিজয় চিহ্ন যুক্ত সূর্য, চন্দ্র আর বরাহ অঙ্কিত হরিহর-বুক্কার প্রিয় গৈরিক পতাকা। পৈত্রিক রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তর থেকে মুহুর্মুহু ভেসে এলো হারিয়ে যাওয়া শঙ্খনাদ এবং কাঁসর ঘণ্টার ধ্বনি। চতুর্দিকে শোনা গেল প্রবল গর্জন ধ্বনি, “জয় মীনাক্ষী মাতা ! হর হর সুন্দরেশ্বর !”

পবিত্র নর্মদা নদীর জল দিয়ে প্রাসাদ ধুইয়ে আর পুরোহিতদের দিয়ে শোধন করে বহুকাল পরে নিজেদের পৈত্রিক প্রাসাদে পুনরায় স্বগর্বে প্রবেশ করলেন হাক্কা আর বুক্কা। অপরদিকে হোসাপট্টনা নগর ত্যাগ করে বেশ কিছুদূর অগ্রসর হয়ে অরন্যে আচ্ছাদিত পার্বত্য প্রদেশে পৌঁছতেই সুলেমান পাশা দেখতে পেলেন দুটি অশ্বে সওয়ার হয়ে তাদের দিকে সবেগে ধেয়ে আসছে তাদেরই দুইজন সিপাহী। গুরুতর আহত তারা। তাদের নিকট থেকে সুলেমান জানতে পারলেন ছলনার সাহায্যে হাক্কা-বুক্কার হোসাপট্টনা নগর অধিগ্রহণ করবার সংবাদ। যারপরনাই ক্রুদ্ধ হয়ে সুলেমান যখন সবে তার সিপাহীদের নির্দেশ দিয়েছেন পুনরায় হোসাপট্টনা নগরের দিকে ধাবিত হবার, ঠিক সেই মুহূর্তেই আচমকা প্রবল কালবৈশাখী ঝড়ের ন্যায় দুলে উঠলো তাদের পথের দুপাশের ঝোপঝাড়। তারপর সুলেমান এবং তার তুর্কি বাহিনী কিছু বুঝে উঠবার পূর্বেই দুপাশের অরন্য আর পর্বত প্রান্ত কাঁপিয়ে “হর হর সুন্দরেশ্বর” ধ্বনিতে গর্জন করে অস্ত্র সস্ত্র সমেত তাদের দিকে পঙ্গপালের ন্যায় ধেয়ে এলো কম্পন আর মারাপ্পা রায়ের নেতৃত্বাধীন হোয়শালা বাহিনী। এই অপ্রত্যাশিত আর অতর্কিত আক্রমনের সম্মুখে কোনরকম প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারলেন না সুলেমান পাশা। কম্পন আর মারাপ্পার তরবারি আর ভল্ল আর তিরের আঘাতে কচুকাটা হলো তার বাহিনী। কম্পনের অসির আঘাতে সুলেমানের মস্তক তার ধড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে লুটিয়ে পড়লো মাটিতে। বিজয় গৌরবে হোয়শালা বাহিনীর বীর সেনানীরা নিজেদের অসি আর ভল্ল শূন্যে উত্থলিত করে মীনাক্ষী মাতার শ্লোগানে ব্যাস্ত হয়ে পড়লেন।

হরিহর রায়ের রাজ্যাভিষেক
====================
দিন কয়েক পরে রাজা বীর বল্লাল তাঁর মন্ত্রী পারিষদ আর সঙ্গমরাজকে নিয়ে উপস্থিত হলেন হোসাপট্টনা নগরে। তারপর হরিহর রায়কে হোসাপট্টনা নগর আর কাম্পিলির নতুন রাজা হিসাবে ঘোষণা করে নিজের হাতে তাঁর মস্তকে রাজমুকুট পরিয়ে দিয়ে হাক্কাকে দান করলেন বহু মুল্যবান রত্নকচিত তাঁর বিশেষ ছুরিকা। সেই সাথে হরিহর আর বুক্কা রায়কে সরকারিভাবে হোয়শালা রাজ্যের প্রধান রক্ষক হিসাবে ঘোষণা করলেন। এরপর নিজের সিংহাসন ত্যাগ করে উঠে দাঁড়িয়ে সেখানে উপস্থিত মাধবাচার্য বিদ্যারন্য, রাজা বীর বল্লাল এবং সঙ্গমরাজের পদস্পর্শ করে তাঁদের বিনম্রতা পূর্বক প্রনাম জানিয়ে রাজা হরিহর রায় তাঁর দক্ষিণ হস্তে বিজয় চিহ্ন যুক্ত নিজের নবনির্মিত গৈরিক ধ্বজ স্বগর্বে শূন্যে উড্ডীন করে দৃপ্ত স্বরে বলে উঠলেন, “বিজাতীয় স্মেচ্ছ বর্বর দস্যুদের ন্যায় আজ হয়তো অগাধ ধন সম্পদের অধিকারী নই আমরা, কিন্তু ধর্মযুদ্ধের পবিত্র রনাঙ্গনে প্রবাহিত করবার রক্ত আমাদের ধমনীতে যবনদের থেকে কয়েকগুন অধিকমাত্রায় প্রবাহিত হচ্ছে। আর বিজাতীয় স্মেচ্ছদের দাসত্ব নয়, এবার থেকে স্বাধীন দাক্ষিণাত্যের পবিত্র ভূমি শাসন করবে দাক্ষিণাত্যের সনাতন ধর্মাবলম্বী ভূমিপুত্ররাই। আমি রাজা হরিহর রায় আজ আপনাদের সম্মুখে শপথ গ্রহণ করছি, স্মেচ্ছ তুর্কিদের পরাধীনতার শৃঙ্খলে আর আবদ্ধ করতে দেবো না আপনাদের। এবার দাক্ষিণাত্যের চতুর্দিকে উড্ডীন হবে বিজয়ের চিহ্নযুক্ত গৈরিক রঙা আবীর, আর বিজাতীয় শত্রুদের বিরুদ্ধে বিজয়ের শপথ নিয়ে শুরু করা আমার নয়া রাজ্যের নাম কাম্পিলির পরিবর্তে হবে বিজয়নগর। আর বিজয়নগরের রাজধানি হোসাপট্টনা নগরের নয়া নাম হবে হাম্পি। আশাকরি আপনাদের আশীর্বাদ আর শুভেচ্ছায় অদূর ভবিষ্যতে দাক্ষিণাত্যের সর্বত্র থেকে যবন দস্যুদের বিতাড়িত করে আজকের এই ক্ষুদ্র বিজয়নগর রাজ্য একদা এক মহাশক্তিশালী সাম্রাজ্যে পরিনত হবে। জয় মীনাক্ষী মাতা ! জয় সুন্দরেশ্বর দেব !
রাজা হরিহর রায়ের ভাষণ শেষ হতেই তাঁর সভাকক্ষ থেকে মুক্তির আলোয় উচ্ছ্বসিত প্রজাদের মধ্যেও অনুরণিত হলো একই জয়ধ্বনি।
প্রবল উচ্ছ্বাস আর উদ্দীপনার মধ্যেও নীরব রইলেন মাধবাচার্য বিদ্যারন্য। মেঘাছন্ন মুখে চিন্তিত স্বরে তিনি স্বগোক্তি করে বলে উঠলেন, “এই তো সবে তোমাদের যাত্রার শুরু। এখনও বিস্তর দুর্গম আর দুরারোহ পথ পাড়ি দিতে হবে তোমাদের। যবন শক্তির হাত থেকে মুক্ত করতে হবে মাদুরাই নগরে বন্দি মীনাক্ষী আম্মান মাতা আর সুন্দরেশ্বর দেবকে। আশীর্বাদ করি সফল হোক তোমাদের যাত্রা। স্বাধীনতার যুদ্ধে সর্বদা বিজয়ী হও তোমরা।”

এদিকে হরিহর রায়ের হাত ধরে যখন বিজয়নগর রাজ্যের পত্তন ঘটছে ঠিক সেই সময় মাদুরাই নগরে নেমে আসছে দুর্ভাগ্যের করাল ছায়া। ১৩৩৫ সালের অন্তিমপর্বে তুর্কি সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলকের নির্দেশে তার এক সেনাপতি জালালউদ্দিন এহেসান খান এক বিশাল তুর্কি বাহিনী নিয়ে আচমকা আক্রমণ করে অধিকার করলেন মাদুরাই নগর এবং তারপরেই দিল্লির সুলতানত থেকে নিজেকে স্বাধীন ঘোষণা করে দাক্ষিণাত্যের পবিত্র মন্দির নগরী মাদুরাইয়ে স্থাপন করলেন ইসলামিক মাদুরাই সুলতানত। বর্বরোচিত ভাবে ধ্বংস করে ধুলোয় মিশিয়ে দিলেন মীনাক্ষী আম্মান মন্দিরের একাংশ। পরবর্তীকালে ১৩৪২ খ্রিষ্টাব্দে মাদুরাই নগরকে যবন মুক্ত করবার এক ধর্মযুদ্ধে এই এহেসান খানের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে বীরগতিপ্রাপ্ত হয়েছিলেন অকুতোভয় বৃদ্ধ হোয়শালা নৃপতি তৃতীয় বীর বল্লাল। বীর বল্লালের মৃত্যুর সাথে সাথেই অবলুপ্ত হয়েছিল হোয়শালা রাজ্যের এবং দাক্ষিণাত্যের ইতিহাসের পর্দায় নাটকীয় অভুথ্যান ঘটেছিল বিজয়নগর রাজ্যের। আরও কয়েক শতাব্দী বাদে বাহুবলি সম্রাট কৃষ্ণদেব রায়ের তরবারির জোরে বিজয়নগর রাজ্য পরিনত হয়েছিল এক মহাশক্তিধর হিন্দু সাম্রাজ্যে। রাজা হাক্কা এবং তাঁর চার ভ্রাতা জড়িয়ে পড়েছিলেন ঐতিহাসিক আনিগণ্ডির যুদ্ধে। সেই যুদ্ধের বিস্তারিত বিবরণ আপনারা ইতিমধ্যেই পাঠ করেছেন ভারতীয় সার্জিকাল স্ট্রাইক পর্বে। কিন্তু আনিগণ্ডির যুদ্ধ ছাড়াও রায়চুরের যুদ্ধ, দুয়ারসমুদ্রের যুদ্ধ সহ আরও একাধিক যুদ্ধে হাক্কা আর বুক্কা রায় নির্ণায়ক ভাবে পরাজিত ও বিতাড়িত করতে সফল হয়েছিলেন মহম্মদ বিন তুঘলক এবং জালালউদ্দিন এহেসান খানের মিলিত তুর্কি বাহিনীকে। ইচ্ছা আছে পরবর্তীকালে সময় পেলে হাক্কা-বুক্কার সেইসব যুদ্ধযাত্রার বিস্তারিত বিবরণ এই পেজে লিপিবদ্ধ করবার।

Comments

  1. Play LuckyClub Casino site
    Luckyclub has a huge welcome bonus, and it's one of the best casinos to play slot machines, blackjack, and baccarat. They also luckyclub provide an

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

বিষ কন্যা