ভারুচের মহাযুদ্ধ (প্রথম পর্ব)
=====================
সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন
================
রাজস্থানের ঐতিহাসিক যুদ্ধে সংযুক্ত ভারতীয় বাহিনীর নির্ণায়ক বিজয়ের পর অতিবাহিত হয়েছে প্রায় ২৮৭ বছর, অর্থাৎ প্রায় পৌনে তিন শতাব্দী। ওই যুদ্ধের পর ভারতবর্ষের ভূমি থেকে সমূলে উৎপাটিত হয়েছিল আরব খলিফাদের যাবতীয় প্রভাব। এর মধ্যে ভারতবর্ষ আর কোনরূপ বড় ধরনের বৈদেশিক আগ্রাসনের সম্মুখীন হয়নি। পূজা-আর্চা, নাচ-গান, প্রেম-কলহ আর পারস্পরিক যুদ্ধ-বিগ্রহ ও ব্যবসা বানিজ্যের মধ্যে দিয়ে মোটের উপর বেশ শান্তিপূর্ণ নিরুপ্রদবেই অতিবাহিত হচ্ছিল ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজপরিবার আর প্রজাদের জীবন। কিন্তু এরই মধ্যে ভারতবর্ষের পশ্চিম প্রান্তে ঘূর্ণাবর্তের প্রবল ঝঞ্ঝার ন্যায় ইসলামিক জিহাদের তরবারি হস্তে আবির্ভূত হলো মামেলুক তুর্কি জাতি। গজনী অধিকার করে সুলতান সেবুক্তিগীনের নেতৃত্বে এবারে তারা সমৃদ্ধশালী ভারতবর্ষের দিকে অগ্রসর হলো। মামেলুক তুর্কিদের বাধাদানের উদ্দেশ্যে নীলমের তটে পুনরায় একত্রিত হয়েছিল ভারতীয় বাহিনী। কিন্তু সেই সংযুক্ত বাহিনীর নেতা রাজা আনন্দপালের নির্বুদ্ধিতার ফলে ঐতিহাসিক নীলমের ধর্মযুদ্ধে বিজয়ের মুখ থেকে পরাজয়ের গ্লানিতে পতিত হয়েছিল সংযুক্ত বাহিনীর প্রয়াস। এরপর ৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে সেবুক্তিগীনের মৃত্যুর পর নিজের জ্যৈষ্ঠ ভ্রাতা ইসমাইলকে হত্যা করে গজনীর তখৎ অধিকার করলো ইয়ামিন-উদদ্দৌলা-আবুল-কাশিম-মামুদ-ইবান-সেবুক্তিগীন। পরবর্তীকালে ইনিই ইতিহাসের পাতায় কুখ্যাতি লাভ করেন সুলতান মামুদ গজনী নামে। জিহাদের লক্ষ্যে অনুপ্রাণিত হয়ে কম করেও ২৮-৩০ বার ভারতবর্ষে হামলা চালিয়েছিলেন সুলতান মামুদ গজনী। লুণ্ঠন করেছিলেন মুলতান, থানেশ্বর, কনৌজ, নগরকোট, আজমির আর গুজরাটের একাধিক দেবালয়।
১০২৫ খ্রিষ্টাব্দের প্রথমার্ধ। আসন্ন শিবরাত্রি উপলক্ষে নববধূর সাজে সজ্জিত হয়ে উঠেছে গুজরাটের প্রভাসপট্টন জেলায় অবস্থিত শতাব্দী প্রাচীন সোমনাথ মন্দির প্রাঙ্গণ। সেইকালে মাইলের পর মাইল জুড়ে বিস্তৃত ছিল সোমনাথ মন্দির প্রাঙ্গণ। মূল মন্দির ছাড়াও সেই প্রাঙ্গণ মধ্যে ছিল আরও অসংখ্য মন্দির সমূহ। মন্দির রাজির স্বর্ণ আর রৌপ্য দ্বারা নির্মিত স্তম্ভ আর খিলানগুলির ধবল দৃশ্যাবলী বহু দূর থেকে দর্শন করে সেগুলিকে তুষারে আচ্ছাদিত হিমালয়ের পর্বত শৃঙ্গ বলেই ভ্রম হতো। মন্দির পরিসরের অধিকাংশ মন্দির সমূহ উচ্চমানের সুদৃশ্য শ্বেত প্রস্তর দ্বারা নির্মিত। সোমনাথ মহালয়ার মূল গর্ভগৃহের মণ্ডপের মহামূল্যবান হিরে, পদ্মরাগমনি আর নীলকান্তমনি দ্বারা সজ্জিত সুবিশাল স্তম্ভগুলি থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছিল এক অপার্থিব আলোকরশ্মি। সেই আলোকরশ্মি যেন নীরব লয়ে প্রাচীন ভারতবর্ষের বৈভব আর সমৃদ্ধের পরিচয় ছড়িয়ে দিচ্ছিল দূর থেকে বহুদূরের প্রান্তে। মূল গর্ভ গৃহের শৃঙ্গটি স্বর্ণ চাদর দ্বারা আচ্ছাদিত ছিল। অমূল্য মনি-মানিক্য খচিত রত্নরাজি দিয়ে নির্মিত ছয়শত বিশালকায় স্তম্ভ সমূহ মূল গর্ভ গৃহের রঙ্গ-মণ্ডপটি যেন অতীব যত্ন সহকারে রক্ষা করছিল। শিব রাত্রি উপলক্ষে সোমনাথ মন্দির দর্শনে হাজির প্রায় হাজার দশেক ভক্ত সমূহ বিশালকায় মূল রঙ্গ-মণ্ডপের উপর একসাথে অবস্থান করে অধীর আগ্রহে অপেক্ষারত ছিল সোমনাথের জ্যোতির্লিঙ্গ দর্শন করে পুণ্য লাভের আশায়। মণ্ডপের সম্মুখপ্রান্তে আলো-আধারির মধ্যে অবস্থিত মহালয়ের রত্ন-খচিত আলৌকিক ভাসমান জ্যোতির্লিঙ্গ। স্বর্ণ দণ্ডের মশাল আর স্বর্ণ প্রদীপের আলোকমালায় ঝলমল করছে গর্ভগৃহের উপরের ছাত আর চারিপাশের প্রাকারে খোদিত অসংখ্য বহুমূল্য রত্নরাজি। চন্দন -কেশর আর কস্তূরী দ্বারা নির্মিত ধূপের সুগন্ধে গর্ভ গৃহের চতুর্দিক ম-ম করছে। অসংখ্য ঘণ্টা-ধ্বনির মিঠে সুরেলা আওয়াজ মণ্ডপের চতুর্দিকে অনুরণিত হচ্ছে। রঙ্গ-মণ্ডপের একপাশে প্রস্তর নির্মিত স্বচ্ছ শান বাধানো তলদেশে একাধিক সুসজ্জিতা অপরূপা অসূর্যস্পর্শা যৌবনবতী নারী নানা রকম মূল্যবান রত্ন আভূষণে নিজেদের অঙ্গ সজ্জিত করে মন্দিরের স্বর্ণ ঘণ্টা অনুরণিত করে নতমস্তকে শিবের আরাধনায় মগ্ন। প্রায় পাঁচশত ব্রাহ্মণ পুরোহিতের একাগ্র চিত্তে বৈদিক মন্ত্রোচ্চারণ আর তিনশত গায়কের সুরেলা কণ্ঠের ভক্তি মূলক সঙ্গিতে গর্ভ গৃহ পরিপূর্ণ। অসংখ্য সুসজ্জিত অপরূপা অপ্সরাসম দেবদাসী নর্তকীদের নৃত্যের নূপুর ধ্বনির সুরেলা আওয়াজ প্রতিফলিত হচ্ছে মন্দির প্রাঙ্গনের প্রাকারে। ঠিক এহেন সময়ে মন্দির প্রাঙ্গনের উত্তরপ্রান্তে মূল প্রবেশ দ্বারের উপরে অবস্থিত বিশালকায় বিপদ ঘণ্টিটা ঢং ঢং করে সশব্দে বেজে উঠলো, সম্মুখপ্রান্তে এক তীব্র হট্টগোল শোনা গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই জনাকয়েক রক্তাপ্লুত রাজপ্রহরী গর্ভ গৃহের নিকটে কোনোরকমে ছুটে এসে আহত ও উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠল, "সর্বনাশ হয়েছে সর্বনাশ, গজনীর যবন লুণ্ঠক দস্যু সর্দার তার বিশাল বাহিনী সমেত কালবৈশাখীর ঘূর্ণি ঝড়ের মতই প্রবল বেগে ধেয়ে আসছে মহালয়ায় দিকে। গজনীর স্মেচ্ছ বাহিনীকে বাধাদান করতে গিয়ে নিহত হয়েছে মহারাজ ভীমদেব দ্বারা নিযুক্ত প্রায় সব রাজপ্রহরী। সঙ্গে সঙ্গে স্তব্ধ হয়ে গেল পুরোহিতদের মন্ত্রোচ্চারণ, বন্ধ হয়ে গেল দেবদাসীদের নৃত্যকলা। গর্ভ গৃহের চতুর্দিক ভরে উঠল হাজার হাজার অসহায় ভক্তগনের আর্তনাদ আর হাহাকারে।
অনতি বিলম্বেই সোমনাথ মন্দির প্রাঙ্গনের বহির্দেশে শোনা গেল একাধিক অশ্বের হেস্রাধ্বনি আর উল্লসিত তুর্কি বাহিনীর অস্ত্রের ঝনঝনানি। কিছুক্ষণের মধ্যেই অশ্বপৃষ্ঠে সওয়ার হয়ে এক বিশাল লুণ্ঠক বাহিনী সমেত গজনীর সুলতান মামুদ আর তাঁর অন্যতম প্রধান সেনাপতি গাজি সইদ সালার শাহু প্রবেশ করলেন সোমনাথ মন্দির প্রাঙ্গণের অভ্যন্তরে। তাঁদের চোখে-মুখে তখন কাফের হিন্দুদের বধ করে তাঁদের দেবালয় লুণ্ঠন করে পবিত্র জেহাদ সফল করার উন্মাদনার ঝিলিক। তুর্কি জল্লাদদের হাত থেকে মন্দির প্রাঙ্গণ আর সেখানে উপস্থিত অগণিত নিরীহ ও নিরস্ত্র ভক্তজনকে রক্ষার জন্য সামান্য অস্ত্র হাতে রে রে করে তুর্কি বাহিনীর দিকে ধেয়ে গেলেন ব্রাহ্মণ পূজারীদের দল। যুদ্ধবিদ্যায় সম্পূর্ণরূপে অজ্ঞ পুরোহিতরা কিছুক্ষণের মধ্যেই গণহত্যার শিকার হলেন তুর্কি বাহিনীর হাতে। পুরোহিতদের লোহিত রুধিরের ধারায় শিক্ত হয়ে উঠলো মন্দির প্রাঙ্গণ। এরপর মামুদের নির্দেশে বন্দি করা হলো প্রধান পুরোহিতকে। নিজের এবং ভক্তদের প্রাণের বিনিময়ে তিনি তুর্কিদের হাতে মন্দিরের যাবতীয় রত্নরাজি আর রূপসী দেবদাসী নর্তকীদের সমর্পিত করতে চাইলেন। সোমনাথ মন্দিরের অগাধ ধনরাশি সম্বন্ধে সম্পূর্ণ রূপে অবগত ছিলেন মামুদ গজনী। প্রধান পুরোহিতের প্রস্তাবে রাজি হলেন তিনি। কিন্তু বাধ সাধল মামুদের প্রধান সেনাপতি তথা ভগ্নীপতি সালার শাহু। তিনি দাবি করলেন কাফেরদের সম্পূর্ণরূপে ধ্বস্ত করবার জন্য প্রধান পুরোহিতকে তুর্কিদের হাতে দান করতে হবে মন্দিরের আলৌকিক ভাসমান জ্যোতির্লিঙ্গ, সেই সাথে ইসলাম ধর্ম কবুল করতে হবে মন্দির প্রাঙ্গণে উপস্থিত সকলকে। স্বভাবতই তীব্র ঘৃণা সহকারে সালার শাহুর এই প্রস্তাব পালন করতে অস্বীকার করলেন প্রধান পুরোহিত। এরপর যা হবার তাই হলো। সুলতান মামুদের নির্দেশে তুর্কি জল্লাদদের খাঁড়া নেমে এলো প্রধান পুরোহিত সহ ভক্তকুলের উপর। সহস্র সনাতন ধর্মাবলম্বী ভক্তগণের মৃতদেহের স্থুপে পরিপূর্ণ হয়ে উঠলো সুবিশাল মন্দির প্রাঙ্গণ। তাঁদের রক্তে পিচ্ছিল হয়ে উঠলো মন্দির পরিসর। মন্দিরের অগাধ ধনরাশি, জ্যোতির্লিঙ্গ বলপূর্বক লুণ্ঠন করে আর দেবদাসী নর্তকীদের বন্দি করে মৃত্যুপুরী সোমনাথ মন্দির প্রাঙ্গণকে ত্যাগ করে গজনীর উদ্দেশ্যে পাড়ি জমালেন সুলতান মামুদ। মামুদের সভাকবি আল-বেরুনির লেখনি অনুসারে সেবার একই দিনে মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে তুর্কিদের তরবারির আঘাতে বধ হয়েছিল শিবরাত্রি উপলক্ষে বিশাল মন্দির পরিসর জুড়ে অবস্থিত প্রায় পঞ্চাশ সহস্র অপবিত্র কাফের পুন্যার্থীর।
মহারাজ ভোজের প্রত্যাঘাত
====================
মন্দির থেকে লুণ্ঠিত যাবতীয় রত্নরাজি আর জ্যোতির্লিঙ্গ বেশ কয়েকটি উটের পিঠে এবং উট চালিত শকটে পরিপূর্ণ করে আর লৌহ পিঞ্জর দ্বারা আচ্ছাদিত কয়েকটি অশ্বচালিত শকটে বন্দিনী দেবদাসীদের নিয়ে পাঞ্জাবের দিকে যাত্রা শুরু করলো সুলতান মামুদের তুর্কি বাহিনী। এতো মালপত্র থাকার দরুন মন্থর হয়ে উঠেছিল তাঁদের যাত্রার গতিবেগ। এদিকে যাত্রাপথের মধ্যেই তুর্কি সুলতান গুপ্তচর মারফৎ পেলেন একটি দুঃসংবাদ। তিনি জানতে পারলেন সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠনের সংবাদ পেয়ে মালওয়ার শক্তিশালী নরেশ মহারাজ ভোজদেব পারমার তাঁর বিশাল বাহিনী সমেত দ্রুতগতিতে ধাবমান হয়েছেন পাঞ্জাবের উদ্দেশ্যে। বীরবর মহারাজ ভোজের লক্ষ্য যাত্রাপথেই গজনী বাহিনীকে আক্রমণ করে তাঁদের পরাজিত করে তাঁদের দ্বারা লুণ্ঠিত যাবতীয় রত্নরাজি আর পবিত্র জ্যোতির্লিঙ্গ পুনরুদ্ধার করার।
ভোজের আগমনী সংবাদ শুনে তীব্র আতঙ্কে কম্পিত হলো সুলতান মামুদের অন্তরাত্মা। এই অবস্থায় মহারাজ ভোজের বাহিনীর হাতে আক্রান্ত হলে খড়কুটোর মতো উড়ে যাবে তুর্কিদের যাবতীয় প্রতিরোধ। সোমনাথ মন্দির থেকে লুণ্ঠিত যাবতীয় রত্নরাজি তো খোয়াতে হবেই সেই সাথে হয়তো খোয়াতে হবে নিজের পৈতৃক প্রাণটাও। যদিও বা প্রাণটা রক্ষা পায় গজনী ফিরতে হবে ঘৃণ্য কাফের বাহিনীর হাতে পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে। এইরূপ বিপরীত পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পাবার জন্য এক অসাধারণ পরিকল্পনা করলেন গজনীর চতুর সুলতান। তিনি নিজের বাহিনীকে দুই ভাগে বিভাজিত করলেন। একটি ভাগের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে সোমনাথ মহালয় থেকে লুণ্ঠিত জ্যোতির্লিঙ্গ সহ সিংহভাগ রত্নরাজি সমেত রাজস্থানের থর মরুভূমির বিপদ সঙ্কুল পথে গজনীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। তুর্কি বাহিনীর অপর ভাগের নেতৃত্ব তুলে দেওয়া হলো সালার শাহুর কাঁধে। তিনি সোমনাথ মহালয় থেকে লুণ্ঠিত অবশিষ্ট রত্নরাজি আর বন্দিনী দেবদাসীদের নিয়ে মুলতানের পথে গজনীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। এদিকে মামুদ সুচতুর রূপে গুপ্তচর মারফৎ রটিয়ে দিলেন তাঁর বাহিনী মহালয়ার জ্যোতির্লিঙ্গ আর লুণ্ঠিত রত্নরাজি নিয়ে মুলতানের দিকে যাত্রা করেছেন।
মুলতানের যুদ্ধ
===========
এই সংবাদ লাভ করেই উত্তেজিত মালওয়া নরেশ ভোজদেব তাঁর বাহিনী সমেত জঙ্গলাকীর্ণ হ্রস্বতর পথে দ্রুতগতিতে ধাবমান হলেন মুলতানের উদ্দেশ্যে। মুলতানের নিকট একটি সমৃদ্ধশালী জনপদে পৌঁছে সেখানকার যাবতীয় নাগরিক বৃন্দকে অনত্র সরিয়ে সাময়িকভাবে দখল নিলেন জনপদের। এরপর মহারাজ ভোজ আর তাঁর বাহিনী নাগরিকদের ছদ্মবেশ ধারন করে অস্ত্রশস্ত্র সমেত সেই জনপদে অধির আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলেন সুলতান মামুদের বাহিনীকে স্বাগত জানানোর জন্য। পরেরদিন প্রত্যুষে গনিমতের মাল সমেত সালার শাহুর বাহিনী সেই জনপদে উপস্থিত হয়ে সাময়িক শিবির স্থাপন করে যখন জনপদের ছদ্মবেশী নাগরিকদের নিকট নিজেদের অস্ত্রশস্ত্র প্রদর্শন করে তাঁদের শঙ্কিত করে নগরবাসীদের গৃহ থেকে লুণ্ঠিত খাদ্যদ্রব্য ভোজন করতে আর সুরাপান করতে ব্যস্ত ঠিক সেই সময়ই জনপদের চতুর্দিক ভৈরব কণ্ঠে “হর হর মহাদেব” রবে আন্দোলিত হলো। এরপর সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত তুর্কি বাহিনী তীব্র বিস্ময়ে দেখতে পেলো যে জনপদের নিরীহ নাগরিক বৃন্দ নিজেদের নাগরিকের পোশাক ত্যাগ করে লৌহ জালিকা, বর্ম ও শিরস্ত্রাণ পরিহিত হয়ে তরবারি, ভল্ল আর তিরধনুক হস্তে তাদের চতুর্দিক থেকে বেষ্টিত করে ফেলেছে। এরপর যা ঘটলো তা কেবল যুদ্ধের নামে প্রহসন মাত্র। মহারাজ ভোজের নির্দেশে তাঁর বাহিনী হিংস্র শার্দূলের ন্যায় ঝাঁপিয়ে পড়লো তুর্কি আততায়ী দস্যুদের উপর। কিছুক্ষণের মধ্যেই মালওয়ার বাহিনীর হাতে সম্পূর্ণ রূপে বিধ্বস্ত হলো সালার শাহুর তুর্কি বাহিনী। তুর্কি সেনাদের রক্তাক্ত মরদেহের স্থুপে পিচ্ছিল হয়ে উঠলো মুলতানের সেই জনপদ। অতর্কিত আক্রমণে পরাজিত হয়ে নিজের প্রাণ রক্ষার তাগিদে, নিজের কিছু বিশ্বাসী দেহরক্ষী সমেত সেই জনপদ ত্যাগ করে পলায়ন করলেন সেনাপতি সালার শাহু। নিজের অশ্বারোহী বাহিনী সমেত তিরবেগে তাঁকে ধাওয়া করলেন মহারাজ ভোজ। কিছুক্ষণের মধ্যেই সালার মাসুদ আর তাঁর দেহরক্ষীদের চতুর্দিক থেকে বেষ্টিত করলেন ভোজ আর তাঁর বাহিনী। এরপর মহারাজ ভোজের তীক্ষ্ণ অসির আঘাতে সালার শাহুর মুণ্ডু তাঁর ধড় থেকে বিছিন্ন হয়ে মুলতানের মাটিতে ভূপাতিত হলো। সালার শাহুকে হত্যা করে বিজয়ীর বেশে জনপদে ফিরে এলেন মহারাজ ভোজ। চতুর্দিক থেকে তখন সিংহ গর্জনে ভেসে আসছে কেবলই “হর হর মহাদেব” ধ্বনি। পুনরায় জনপদে প্রবেশ করে মহারাজ ভোজের নির্দেশে তাঁর বাহিনী মুক্ত করলো লৌহ পিঞ্জর দ্বারা আচ্ছাদিত শকটে বন্দিনী দেবদাসীদের, উদ্ধার করাহ হলো সালার মাসুদের বাহিনীর শিবিরে রক্ষিত সোমনাথ মহালয়ায় লুণ্ঠিত রত্নরাজি। তুর্কি শিবিরে প্রবেশ করে বিস্মিত ভোজ দেখতে পেলেন এতো অতি যৎসামান্য রত্নরাজি আর মহালয়ার পবিত্র জ্যোতির্লিঙ্গও অনুপস্থিত। এরপর সেনা গুপ্তচরের নিকটে সুলতান মামুদের চতুর পরিকল্পনার সম্বন্ধে জ্ঞাত হলেন তিনি। মুহূর্তের মধ্যেই এই অভূতপূর্ব জয়ের আনন্দ পরিণত হলো বিষাদে। বিভিন্ন ঐতিহাসিকগণের মতে নিজের জীবনের অন্তিমক্ষণ পর্যন্ত সেদিনের কথা ভুলতে পারেননি মহারাজ ভোজ।
মামুদের গজনী প্রত্যাবর্তন আর মৃত্যু
==========================
অপরদিকে থর মরুভূমির পথে নানান বিপদের সম্মুখীন হয়েও শেষপর্যন্ত মহালয়ার জ্যোতির্লিঙ্গ আর লুণ্ঠিত রত্নরাজি সমেত সফলভাবে গজনী প্রত্যাবর্তন করতে সমর্থ হয়েছিলেন সুলতান মামুদ। গজনীতে সফলভাবে প্রত্যাবর্তনের পর মামুদের নির্দেশে সোমনাথ মহালয়া থেকে লুণ্ঠিত ধনরাশির অর্ধেক অংশ দিয়ে পুনর্নির্মাণ করা হয়েছিল গজনী নগরের প্রধান মসজিদের আর সোমনাথ মহালয়ার গর্ভগৃহের প্রাচীন জ্যোতির্লিঙ্গটি টুকরো টুকরো করে গুঁড়িয়ে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল গজনী নগরের সেই প্রধান মসজিদের প্রবেশপথের সোপানশ্রেণীতে যাতে সঠিক ধর্মে বিশ্বাসীরা (মুসলিমরা) অবিশ্বাসীদের (হিন্দু) পৌত্তলিক ঈশ্বরকে তাদের পদতলে মাড়িয়ে মসজিদে প্রবেশ করে ইসলামের বিজয়যাত্রা ঘোষণা করতে পারে। সেই সময় তুর্কি সুলতান ৫৪ বছরের এক মধ্য বয়স্ক ব্যক্তি। বহু যুদ্ধে রক্তাক্ত আর ক্ষতবিক্ষত হয়ে বয়সের ভারে তখন তিনি নুব্জ। সোমনাথ মহালয়ার বিপুল রত্নরাজি লুণ্ঠন করবার পর সেই বছরেরই অন্তিম লগ্নে পাঞ্জাব সীমান্তে জাটদের বিরুদ্ধে একটি মামুলি যুদ্ধযাত্রা করবার পর বয়স জনিত কারনে ভারতবর্ষের ভূমিতে আর হামলা করবার সাহস দেখাননি তিনি। ১০৩০ খ্রিষ্টাব্দে মামুদের এন্তেকালের পর প্রয়াত সুলতানের ইচ্ছানুসারে গজনীর নয়া সুলতান হলেন মহম্মদ। কিন্তু কয়েক মাস শাসন করবার পর তাঁর জমজ ভ্রাতা মাসুদ-আল-দিন আচমকা গজনী শহরে সেনা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে মহম্মদকে বন্দি করে গজনীর তখতের দখল নিলেন। এরপর তিনি গজনী বাহিনীর সেনাপ্রধানের পদে নিযুক্ত করলেন মুলতানের যুদ্ধে মহারাজ ভোজের হিন্দু বাহিনীর হাতে নিহত সালার শাহুর জ্যৈষ্ঠ পুত্র সালার মাসুদকে। মালওয়া নরেশ ভোজের হাতে নিজের আব্বাজান গাজি সালার শাহুর মর্মান্তিক মৃত্যুর কথা তখনও ভুলতে পারেননি তিনি। গজনী বাহিনীর সেনাপতি হিসাবে নিযুক্ত হয়েই তিনি আল্লাহর নামে শপথ করে প্রতিজ্ঞা করলেন প্রয়াত সুলতান মামুদ গজনীর পথ অনুসরণ করে পুনরায় ভারতবর্ষ আক্রমণ করে মহারাজ ভোজকে পরাজিত ও হত্যা করে মালওয়া সহ ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চল অধিগ্রহণ করে ভারতবর্ষের বুকে এক স্থায়ী ইসলামের সাম্রাজ্য স্থাপন করবার।
সালার মাসুদের ভারত আক্রমণ
=======================
ভারতবর্ষে ইসলামিক সাম্রাজ্য স্থাপন করে গাজি হবার বাসনায় আর নিজের পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নেবার তাড়নায় সালার মাসুদ তৎকালীন গজনী অধিপতি সুলতান মাসুদ-আল-দিনকে রাজি করিয়ে ১০৩৩ খ্রিষ্টাব্দের অন্তিমভাগে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার বাহিনীর এক বিশাল লস্কর সমেত যাত্রা শুরু করলেন মালওয়ার উদ্দেশ্যে। মামুদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে মুলতান প্রদেশ দিয়ে মূল ভারতীয় ভূখণ্ডে প্রবেশ করলেন সালার মাসুদ আর তাঁর বিশাল স্মেচ্ছ বাহিনী। সনাতন আর বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী স্থানীয় রাজাদের পরাজিত ও হত্যা করে একে একে অধিকার করলেন ভাতিণ্ডা, থানেশ্বর, নগরকোট, কনৌজ এবং গোয়ালিয়র। মথুরা, বৃন্দাবন, অযোধ্যা আর কাশী সহ সনাতন ধর্মাবলম্বীদের একাধিক নগর আক্রমণ করে লণ্ডভণ্ড আর ধ্বস্ত করলেন। উত্তর আর মধ্য ভারতের যেখানে যেখানে উপস্থিত হলো সালার মাসুদ আর তাঁর তুর্কি বাহিনী সেইসব স্থানই পরিপূর্ণ হয়ে উঠলো লক্ষ লক্ষ অসহায় প্রজাদের মরদেহের স্থুপে, শিক্ত হয়ে উঠলো বৌদ্ধ আর সনাতন ধর্মাবলম্বী প্রজাদের রক্তে। এরপর মালওয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে ১০৩৪ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ-এপ্রিল মাস নাগাদ বর্তমান লখনো নগরের নিকটে সরযূ নদীর তটবর্তী ভারুচ নামক একটি স্থানে নিজের সেনা শিবির স্থাপন করলেন।
রাজা সুহালদেবের তুর্কি বধের প্রতিজ্ঞা
============================
তুর্কিদের দস্যু বাহিনীর রোষানল থেকে কোনমতে নিজেদের প্রাণ বাঁচিয়ে অগণিত দুঃস্থ আর নিপীড়িত প্রজাগণ সহায় সম্বলহীন হয়ে উত্তরপ্রদেশের শ্রাবস্তী রাজ্যের সীমানায় এসে আশ্রয় গ্রহণ করলেন। বর্তমান উত্তরপ্রদেশের নেপাল ঘেঁষা দেবিপট্টন জেলায় অবস্থিত শ্রাবস্তী এক বহু প্রাচীন ভারতীয় রাজ্য। গৌতম বুদ্ধ তাঁর ভারত যাত্রাকালে এই শ্রাবস্তী নগরে বেশ কিছুদিন অতিবাহিত করেছিলেন। সেই সময় শ্রাবস্তীর রাজা ছিলেন মধ্য তিরিশের এক তরতাজা তেজদৃপ্ত তরুণ যুবা সুহালদেব বাইস। তিনি বাইস রাজপুত গোষ্ঠীর একজন বীর ক্ষত্রিয় যোদ্ধা ছিলেন। তিনি ইতিপূর্বেই নিজের রাজসভার অমাত্য এবং পারিষদগণের মুখে সমগ্র উত্তর ভারত জুড়ে সালার মাসুদ আর তাঁর ভিনদেশি স্মেচ্ছ যবন বাহিনীর ভয়ানক সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের বিস্তৃত কাহিনী শুনেছিলেন। এবারে অমাত্যদের অনুরোধে তিনি একদিন শ্রাবস্তী রাজ্যের দক্ষিণ সীমান্তে আশ্রয় গ্রহণ করা উত্তর ভারতের অনান্য রাজ্যের সহায় সম্বলহীন অসহায় প্রজাদের শিবিরে গেলেন নিজের চোখে তাঁদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে। কোনমতে তুর্কি দস্যুদের তরবারির আঘাত এড়িয়ে প্রাণ হাতে করে শ্রাবস্তী রাজ্যে পরবাসী উদ্বাস্তুদের ন্যায় আশ্রয় গ্রহণ করা প্রজাগণের মুখে তিনি শুনলেন যবন দস্যুদের অত্যাচারের বিস্তারিত বিবরণ, জানলেন কিভাবে তুর্কি দস্যুরা থানেশ্বর, মথুরা, বৃন্দাবন, কনৌজ, অযোধ্যা আর কাশীর মতো পবিত্র নগরগুলিতে আক্রমণ চালিয়ে ধ্বস্ত আর লুণ্ঠন করেছে অগণিত সনাতন দেবালয় আর বৌদ্ধ মঠ সমূহ, কিভাবে অগণিত ভারতীয় প্রজাদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে আর অগণিত ভারতীয় রমণী আর যুবতী গণকে বন্দিনী করে তুর্কি শাসকদের যৌনদাসী বানানোর অভিপ্রায়ে লৌহ পিঞ্জর দ্বারা বেষ্টিত উট চালিত শকটে করে চালান করা হয়েছে সদুর গজনীর উদ্দেশ্যে। আশ্রিত প্রজাদের মুখ থেকে তুর্কি বাহিনীর সন্ত্রাসের বিস্তারিত বিবরণ শুনে যারপরনাই ক্ষুব্ধ হলেন তিনি। সেই মুহূর্তেই রাজা সুহালদেব নিজের কোষবদ্ধ অসি উন্মুক্ত করে প্রতিজ্ঞা করলেন ভারতবর্ষের ভূমিকে তুর্কি সেনাপতি সালার মাসুদ আর তাঁর স্মেচ্ছ যবন বাহিনীর রুধিরে শিক্ত করে পুনরায় ভারতবর্ষের বুকে ধর্মের স্থাপনা করবেন তিনি।
রাজা সুহালদেব গুপ্তচর মারফৎ সংবাদ পেলেন এই মুহূর্তে দুর্নিবার তুর্কি দস্যু বাহিনীতে রয়েছে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার সুবিশাল সেনা। চতুর সুহালদেব অচিরেই অনুধাবন করতে পারলেন একাকি তাঁর পক্ষে সাগরের জলস্রোতের ন্যায় এই সুবিশাল তুর্কি বাহিনীকে পরাজিত করা কোনমতেই সম্ভব নয়। এই মুহূর্তে আবেগের বশবর্তী হয়ে আক্রমনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে তা এক চরম হটকারী সিদ্ধান্ত হিসাবে বিবেচিত হবে। অতএব তিনি সেই পন্থা অবলম্বন করলেন যা সেদিন থেকে ২৯৬ বছর পূর্বে রাজস্থানের ঐতিহাসিক যুদ্ধের পূর্বে করেছিলেন গুর্জর-প্রতিহার সম্রাট প্রথম নাগভট্ট। সম্রাট নাগভট্টের পদাঙ্ক অনুসরণ করে রাজা সুহালদেব ভিনদেশি যবন বাহিনীর বিরুদ্ধে একত্রিত হয়ে একটি সংযুক্ত বাহিনী গঠন করে যুদ্ধ করবার আহ্বান জানিয়ে পত্র প্রেরন করলেন উত্তর, মধ্য ও পশ্চিম ভারতের একাধিক রাজ্যে। সেই পত্রে লিখিত ছিল সম্রাট নাগভট্টের ন্যায় প্রায় অনুরূপ আর্তি, “হে ভারতবর্ষের রাজন্যগণ, রঘুপতি রাঘব রামচন্দ্র, পঞ্চ পাণ্ডব ভ্রাতা আর শ্রীকৃষ্ণের জন্মভূমি তথা বহু শতাব্দী প্রাচীন রামায়ণ ও মহাভারতের স্মৃতিধন্য ভারতবর্ষ আজ পুনরায় একবার ভিনদেশি স্মেচ্ছ যবন দস্যু দ্বারা আক্রান্ত, স্মেচ্ছদের আগ্রাসনে আজ পুনরায় একবার বিনাশের মুখে আমাদের সনাতন ধর্ম, সভ্যতা আর সংস্কৃতি। উত্তর ও মধ্য ভারতের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে বিধর্মী তুর্কি দস্যুদের রোষানলে ভস্মীভূত আর ধ্বস্ত হয়েছে ভারতবর্ষের একাধিক পবিত্র নগরী, লুণ্ঠিত হয়েছে অগণিত দেবালয়, নিহত ও আশ্রয়হীন হয়েছে অগণিত অসহায় প্রজাগণ, বিজাতীয় তুর্কিদের হাতে সম্মানহানীর শিকার হয়েছে ভারতবর্ষের নারীরা। পূর্বের যবন দস্যু হামিরা (তুর্কি আমির বা সুলতান) মামুদ গজনীর মৃত্যুর পর আপনারা হয়তো নিজেদের নিরাপদ মনে করেছিলেন, কিন্তু আপনাদের সেই ধারনা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত প্রমাণিত করে আজ পুনরায় উত্তর-পশ্চিম প্রান্ত থেকে ইসলামের তরবারি হস্তে উপস্থিত হয়েছে দুর্নিবার স্মেচ্ছ দস্যুরা। আপনাদের সম্মুখে অন্তিম সুযোগ। আসুন আমরা এই মুহূর্তে একত্রিত হয়ে একটি বিশাল সংযুক্ত বাহিনী গঠন করে স্মেচ্ছ বাহিনীকে আক্রমণ করে রুদ্র মহাদেবের ন্যায় তছনছ আর ধ্বস্ত করে তুর্কি সেনাপতি সালার মাসুদকে দেখিয়ে দেই সনাতন ভারতবর্ষের সামরিক ক্ষমতা, রক্ষা করি সনাতন ভারতবর্ষের বহু শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহ্য, সভ্যতা আর সংস্কৃতি।”
সংযুক্ত ভারতীয় বাহিনীর গঠন ও ভোজের রণকৌশল
======================================
উত্তর ও মধ্য ভারতের বিভিন্ন রাজ্য সহ রাজা সুহালদেবের এই পত্র প্রেরন করা হলো মালওয়া রাজ্যে মহারাজ ভোজদেব পারমারের রাজসভাতেও। ইতিপূর্বেই গুপ্তচর মারফৎ তিনি সংবাদ পেয়েছিলেন সালার মাসুদের ভারত অভিযান পর্বের এবং এও জানতে পেরেছিলেন যে সালার মাসুদের ভারত আগমনের অন্যতম উদ্দেশ্য আজ থেকে নয় বছর পূর্বে তাঁরই তরবারির আঘাতে মৃত সালার শাহুর হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ। কিন্তু সুলতানের মামুদের বাহিনীর বিরুদ্ধে মুলতানের সেই ঐতিহাসিক যুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন এক তরুণ যুবা কিন্তু আজ তিনি এক মধ্য বয়স্ক প্রাজ্ঞ শাসক। অতএব আবেগের বশবর্তী হয়ে দ্রুত কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করে সালার মাসুদ আর তাঁর তুর্কি বাহিনীর আগ্রাসন থেকে মালওয়াকে সুরক্ষিত করতে গোপনে সামরিক প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেন। অপরদিকে রাজা সুহালদেবের পত্র পাঠ করে তুর্কি বাহিনীর ধর্মীয় সন্ত্রাস থেকে ভারতবর্ষকে রক্ষা করবার বাসনায় তাঁকে সবরকম সেনা সহায়তা দেবার আশ্বাস দান করলেন রায় রায়েব, রায় অর্জুন, রায় ভিখান, রায় কনক, রায় কল্যান, রায় মাকারু, রায় অরুণ, রায় বীরবল, রায় শ্রীপাল, রায় হরপাল, রায় নারায়ণ সিংহ দেব, রায় নরসিংহদেব সহ উত্তর ও মধ্য ভারতের ছোটবড় প্রায় ১৭ টি রাজ্যের রাজারা। এদিকে কিছুদিনের মধ্যেই শ্রাবস্তীর নরেশ সুহালদেবকে পত্র মারফৎ নিজের রাজধানি ধার নগরীর রাজসভায় বিস্তারিত আলোচনার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন মহারাজ ভোজদেব। আমন্ত্রণ গ্রহণ করে ধার নগরীতে রাজা ভোজের সাথে সাক্ষাৎ করলেন রাজা সুহালদেব আর অনান্য রাজারা। সেই সভায় সর্ব সম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলো তুর্কি বাহিনীর বিরুদ্ধে আসন্ন মহাযুদ্ধে নিজের রণহস্তী বাহিনী সমেত অংশগ্রহণ করবেন মহারাজ ভোজদেব পারমার। যুদ্ধে বিজয়ী হলে তুর্কি দস্যুদের শিবির লুণ্ঠন থেকে প্রাপ্ত রত্নভাণ্ডারের ৩০% ভাগ মালওয়া নরেশকে প্রদান করতে হবে। এছাড়া আসন্ন মহাযুদ্ধের নেতৃত্বদান করবেন শ্রাবস্তীর তরুণ রাজা সুহালদেব, তবে যুদ্ধের রণকৌশল রচনা করবেন বহু যুদ্ধে অভিজ্ঞ চতুর আর রণকৌশলী মহারাজ ভোজ। এরপর শুরু হলো আসন্ন মহাযুদ্ধের প্রস্তুতি। কিছুদিনের মধ্যেই দেখা গেল রাজা সুহালদেবের নেতৃত্বাধিন প্রায় লক্ষাধিক সেনার এক সুবিশাল সংযুক্ত ভারতীয় বাহিনী মালওয়া থেকে যাত্রা শুরু করেছে ভারুচের উদ্দেশ্যে। গুপ্তচরের মুখ থেকে সংযুক্ত ভারতীয় বাহিনীর আগমনী সংবাদ পেলেন তুর্কি সেনাপতি সালার মাসুদও। তিনিও তাঁর পূর্বসূরি মামুদ গজনীর ন্যায় কাফের বাহিনীকে পরাজিত ও ধ্বস্ত করে ভারতবর্ষের বুকে ইসলামের সাম্রাজ্য দার-উল-ইসলাম স্থাপন করবার শপথ গ্রহণ করলেন।
মধ্যপ্রদেশের বর্তমান রাজধানি ভূপাল থেকে মাত্র ২৮ কিলোমিটার দূরে রায়সেন জেলার বেটওয়া নদীর তটে ঘন অরণ্যের মধ্যে অবস্থিত কয়েকটি পর্ণ কুটির। আসলে এ হলো আচার্য শেখরাদিত্যের গুরুকুল। বহু বছর ধরে গুরুকুলেই শিক্ষার্থীদের অস্ত্র ও শাস্ত্র বিদ্যা প্রদান করেন আচার্য শেখরাদিত্য। ইনিই মালওয়া নরেশ ভোজদেব পারমারের অস্ত্রগুরু। কিশোর বয়সে রাজমহলের যাবতীয় সুখ স্বাচ্ছন্দ্য আর বৈভব থেকে বহুদূরে আচার্য শেখরাদিত্যের গুরুকুলেই অস্ত্র ও শাস্ত্র বিদ্যা পাঠ সম্পন্ন করেছিলেন মহারাজ ভোজ। আজ পশ্চিম প্রান্তের ভিনদেশি বিজাতীয় বর্বর স্মেচ্ছদের করাল গ্রাস থেকে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখার ধর্মযুদ্ধে যাত্রার পূর্বে মহারাজ ভোজ একাকি ছদ্মবেশ ধারণ করে সামান্য কিছু দেহরক্ষী পরিবৃত হয়ে পুনরায় পাড়ি জমালেন কৈশোরকালের গুরুকুলে। কথিত আছে এই যাত্রায় ভোজের সাথি ছিলেন শ্রাবস্তী নরেশ সুহালদেবও।

ঊষাকালে যাত্রা শুরু করে মধ্যাহ্ন নাগাদ তাঁরা এসে উপস্থিত হলেন গুরুকুলে। মহারাজ ভোজ তাঁর নতুন সাথি রাজা সুহালদেবকে নিয়ে সাক্ষাৎ করলেন আচার্য শেখরাদিত্যের সাথে। গুরুদেবের সম্মুখে নতনাজু হয়ে তাঁকে শ্রদ্ধা পূর্বক প্রণাম জানিয়ে বিধর্মী যবন জেহাদিদের বিরুদ্ধে নিজেদের আসন্ন ধর্মযুদ্ধ যাত্রার কথা বলে গুরুকদেবের আশীর্বাদ প্রার্থনা করলেন তাঁরা। মহারাজ ভোজ আর রাজা সুহালদেবকে আশীর্বাদ প্রদান করে আচার্য শেখরাদিত্যে সৌম্য কণ্ঠে বললেন, “পবিত্র গীতার শ্লোক অনুযায়ী যুগে যুগে যখনই ধর্মের বিনাশ সাধনের জন্য অধর্মের অভ্যুথান ঘটেছে তখনই অশুভ শক্তির বিনাশ সাধন করে, সাধু শক্তি আর ধর্মের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য পরম করুণাময় ঈশ্বরের আশীর্বাদে কোন না কোন মহান ধর্ম যোদ্ধা ধরিত্রীর মাটিতে অবতীর্ণ হয়েছেন। সেই সকল ধর্ম যোদ্ধাগণের সিংহের ন্যায় তেজদৃপ্ত হৃদয়, হস্তীর ন্যায় বলিষ্ঠ বাহুবল আর হিমালয় পর্বতের ন্যায় ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তার সম্মুখে অধর্মের সেনানীরা বারংবার পরাজিত হয়ে পলায়ন করতে বাধ্য হয়েছে। অধর্মের সেনানি স্মেচ্ছ যবন বাহিনীর দ্বারা ভারতবর্ষের বুকে আজ পুনরায় সঙ্কটাপন্ন সনাতন ধর্ম, সভ্যতা আর সংস্কৃতি। বর্তমানে পশ্চিম প্রান্ত থেকে আগত অধর্মের এই শক্তিকে পরাভূত করে ধর্মের পুনঃর সংস্থাপনের জন্য পরম মঙ্গলময় ঈশ্বর দ্বারা প্রেরিত ধর্মযোদ্ধা তোমরা। স্বয়ং ঈশ্বরের দূত যারা তাঁদের আর আমার আশীর্বাদের প্রয়োজন কি ? তবুও তোমার অস্ত্র আর শাস্ত্র গুরু হিসাবে আশীর্বাদ করছি আমি, আসন্ন ধর্মযুদ্ধে অধর্মকে শোচনীয় রূপে পরাজিত করে বিজয়ী হবে তোমরা।”

“কিন্তু গুরুদেব এই যুদ্ধে স্মেচ্ছদের বিরুদ্ধে ছলনার আশ্রয় গ্রহণ করাটা কি উচিত হবে”, কিছুটা দ্বিধাভরা কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন মহারাজ ভোজ,
জবাবে আচার্য শেখরাদিত্য শান্ত, সমাহিত কণ্ঠে বললেন, “হে রাজন আমাদের পবিত্র গীতাতেই লেখা রয়েছে তোমার সংশয়ের নিদান। দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন করে ধর্ম রক্ষার প্রয়োজনে কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ আর পঞ্চপাণ্ডবরাও কৌরব বাহিনীর বিরুদ্ধে একাধিকবার ছলনার আশ্রয় নিয়েছিলেন। অতএব এই ধর্মযুদ্ধেও বর্বর তুর্কি বাহিনীর বিরুদ্ধে যে কোন ছলনার আশ্রয় গ্রহণে বিন্দুমাত্র পাপ নেই। তোমরা এগিয়ে যাও ঈশ্বরের আশীর্বাদ রয়েছে তোমাদের উপর”

এরপর মহারাজ ভোজ আর রাজা সুহালদেব আচার্য শেখরাদিত্যের আশীর্বাদ নিয়ে তাঁর আশ্রমের একপ্রান্তে অবস্থিত বেলেপাথর দ্বারা নির্মিত একটি শিব মন্দিরে পূজো দান করে ফিরে এলেন। আসবার সময় মহাদেবের প্রস্তর মূর্তির সামনে প্রতিজ্ঞা করলেন ভোজ যে যবন বাহিনীর বিরুদ্ধে আসন্ন মহাযুদ্ধে বিজয়ী হলে তিনি এখানেই নির্মাণ করবেন একটি সুরম্য শিব মন্দির আর স্থাপন করবেন তাঁর নতুন রাজধানি।

সংযুক্ত বাহিনীর রণকৌশল
===================
১০৩৪ খ্রিষ্টাব্দের গ্রীষ্মের অন্তিমলগ্নে ভিনদেশি স্মেচ্ছ শিবিরে দূত মারফৎ পত্র প্রেরণ করলো সংযুক্ত বাহিনী। সেই পত্রে তুর্কি সেনাপতি সালার মাসুদের প্রতি সংযুক্ত বাহিনীর বার্তা ছিল, “নিজের এবং নিজের স্মেচ্ছ বাহিনীর মঙ্গল কামনা করলে আর নিজেদের প্রাণ রক্ষা করতে ইচ্ছুক হলে অবিলম্বে শ্রীরামচন্দ্রের স্মৃতিধন্য পবিত্র ভারতবর্ষের ভূমি ত্যাগ করে গজনীতে প্রত্যাবর্তন করো, আদেশ অমান্য করলে অদূর ভবিষ্যতে নিজ ভূমে পলায়নের আর সুযোগ পাবে না।”

পত্র পাঠ করে সালার মাসুদ ঔদ্ধত্যপূর্ণ কণ্ঠে জবাব দান করে বলেছিলেন, “রাব্বানা আন সুরুল খুদা ওয়াল ইসলামা ফিল-এ-হিন্দ” অর্থাৎ হিন্দুস্থান সহ সমগ্র দুনিয়া খোদা আর তাঁর ভক্ত ইসলামের। এই দুনিয়ায় অবিশ্বাসীদের কোন স্থান নেই। অতএব হিন্দুস্থান ত্যাগ করে পশ্চাৎপশরন করবারও কোন প্রশ্নই নেই।
সালার মাসুদের এহেন জবাব পেয়ে যারপরনাই ক্রুদ্ধ হলেন সংযুক্ত বাহিনীর নেতা রাজা সুহালদেব আর পরামর্শদাতা মহারাজ ভোজ। কিন্তু ক্রোধের বশবর্তী হয়ে তাঁরা উপস্থিত বুদ্ধি হারালেন না। আসন্ন মহাযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেন। ভোজের রণনীতি অনুসারে সংযুক্ত বাহিনীকে বেশ কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করে উত্তর, পূর্ব, পশ্চিম আর দক্ষিণ প্রান্তের বিভিন্ন পথ দিয়ে তাঁরা দৃঢ়ভাবে অগ্রসর হতে লাগলেন ভারুচ প্রান্তরের দিকে। অপরদিকে ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থান সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অজ্ঞ তুর্কি সেনাপতি সালার মাসুদ তাঁর গুপ্তচরের মুখে একেকবার একেক প্রান্ত থেকে সংযুক্ত বাহিনীর অগ্রসরের সংবাদ শ্রবণ করে দিশাহারা হয়ে পড়লেন।

এরপর মহারাজ ভোজের নির্দেশে মে মাসের মধ্যভাগে বা অন্তিমভাগে সংযুক্ত বাহিনীর একটি অংশ তুর্কিদের অজানা একটি হস্রতর পথে উত্তর ভারতের থানেশ্বর নগরের প্রান্তে উপস্থিত হয়ে, সরস্বতী-ঘাগর নদীর তটে অবস্থিত সালার মাসুদের একটি অরক্ষিত তুর্কি শিবিরে আচমকা হামলা চালালো। সংযুক্ত বাহিনীর সেই আচমকা একপেশে হামলায় কোনরকম প্রতিরোধই গড়ে তুলতে সক্ষম হলো না তুর্কি বাহিনী। সংযুক্ত বাহিনীর অস্ত্রাঘাতে তুর্কি শিবিরের অধিপতি মহম্মদ ইয়াকুব ইবান আলি সহ তুর্কি শিবিরের সমস্ত মুজাহিদিন নিহত হলো। এরপর সেই অভিযানের নেতা রায় নারায়ণ সিংহ দেবের নির্দেশে মহম্মদ ইয়াকুব আলির মস্তক তাঁর ধড় থেকে বিছিন্ন করে একটি রূপার থালায় সজ্জিত করে তা ভেট হিসাবে প্রেরণ করা হলো ভারুচে সালার মাসুদের নিকটে। নিজের চোখের সামনে নিজের অন্যতম প্রিয় সেনাধক্ষ্যের বিচ্ছিন্ন মুণ্ডু দেখে ক্রোধ বহ্নির রোষানলে ফেটে পড়লেন সালার মাসুদ। ঘৃণ্য কাফের বাহিনীকে উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করবার জন্য তিনি তৎক্ষণাৎ তাঁর সমস্ত সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দিলেন থানেশ্বরের দিকে অগ্রসর হবার। বেশ কিছুকাল যাত্রার পর সালার মাসুদ আর তাঁর বাহিনী সরস্বতী-ঘাগর নদী অতিক্রম করে থানেশ্বর নগরের প্রান্তে যখন তাঁদের বিধ্বস্ত সেনা শিবিরে উপস্থিত হলেন তখন সেখানে সংযুক্ত ভারতীয় বাহিনীর কোন সদস্যের সন্ধান পেলেন না। দীর্ঘ পথযাত্রার শ্রম লাঘব করার জন্য সেখানেই কিছুদিন বিশ্রামের সিদ্ধান্ত নিলো তুর্কি বাহিনী। এদিকে মৌসুমি বায়ুর প্রকোপে অচিরেই শুরু হলো প্রবল বর্ষা।
বৃষ্টির ফলে কিছুদিনের মধ্যেই ফুলেফেঁপে উঠলো শীর্ণকায়া ঘাগর নদী। বিপদ আসন্ন উপলব্ধি করতে পেরে থানেশ্বরের শিবির ত্যাগ করে পুনরায় ভারুচের দিকে যাত্রা করার সিদ্ধান্ত নিলেন সালার মাসুদ। কিন্তু নদী অতিক্রম করতে গিয়ে বর্ষণে ফুলেফেঁপে ওঠা ঘাগর নদীর বন্যার প্রকোপে পড়লো তাঁর স্মেচ্ছ বাহিনী। প্লাবনের জলে ভেসে গিয়ে মৃত্যু হলো বহু তুর্কি সেনার, ব্যপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হলো মাসুদ বাহিনী। এরপর নিজেদের কিছুটা সামলে নিয়ে পুনরায় যাত্রা শুরু করে দিল্লির নিকটে পৌঁছতেই সংযুক্ত ভারতীয় বাহিনীর আরেকটি ছোট টুকরী আচমকা হামলা চালালো বন্যা বিধ্বস্ত তুর্কি বাহিনীর উপর। সকাল থেকে শুরু হয়ে বিকেল পর্যন্ত প্রায় টানা ৭-৮ ঘণ্টা ধরে চললো ভয়ানক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। সংযুক্ত ভারতীয় বাহিনীর এই হামলা তুর্কি বাহিনীকে পরাজিত করবার অভিপ্রায়ে ছিল না, বরং পথশ্রমে ক্লান্ত আর বন্যায় বিধ্বস্ত তুর্কি শিবিরে গেরিলা পদ্ধতিতে আচমকা হামলা চালিয়ে শত্রু শিবিরে ব্যপক ক্ষয়ক্ষতি সাধন করে পুনরায় পশ্চাৎপশরন করাই ছিল এই আক্রমণের মূল লক্ষ্য। সেই লক্ষ্যে সফল হয়ে সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে রাতের আঁধারে আত্মগোপন করে শৈশবকাল থেকে নিজেদের চিরপরিচিত পথে পলায়ন করলো ভারতীয় বাহিনী। অপরদিকে ভারতবর্ষের ভৌগলিক চরিত্র সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অজ্ঞ তুর্কি বাহিনী সেই রাতে আর ভারতীয় বাহিনীর পিছু ধাওয়া করবার দুঃসাহস প্রদর্শন না করে নিজেদের ধ্বস্ত শিবির সুরক্ষিত করতেই ব্যস্ত হয়ে পড়লো। এইভাবে মাত্র মাস কয়েকের ব্যবধানেই তুর্কি বাহিনীর সেনা সংখ্যা ১ লাখ ২০ হাজার থেকে হ্রাস পেয়ে নেমে এলো আনুমানিক ৮০-৮৫ হাজারের মধ্যে। তুর্কি বাহিনীর অনান্য সেনানায়করা সালার মাসুদকে উপদেশ দিলেন ভারত অভিযান মুলতুবি রেখে আপাতত গজনী প্রত্যাবর্তন করার। কিন্তু ভারতবর্ষের বুকে ইসলামের সাম্রাজ্য স্থাপন করবার লক্ষ্যে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ মাসুদ তাঁর সেনানায়কদের উপদেশে বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করলেন না।

অপরদিকে তুর্কি বাহিনীর নাজেহাল অবস্থার সংবাদ লাভ করে রাজা সুহালদেব ব্যাসের নেতৃত্বাধিন সংযুক্ত ভারতীয় বাহিনী ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যাত্রা করে একত্রিত হলো ভারুচের সেই স্থানে যেখানে মাত্র মাস কয়েক পূর্বেই ছিল সালার মাসুদের বিশাল তুর্কি সেনাশিবির। বহু যুদ্ধে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন চতুর মালওয়া নরেশ ভোজ ভালমতোই জানতেন সংযুক্ত বাহিনীর মতো এহেন বিশাল বাহিনীর ভরণপোষণের জন্য প্রচুর রসদের প্রয়োজন, আর এই মুহূর্তে নিজেদের রাজকোষের ভাণ্ডার থেকে কোনরকম ব্যয় না করে সেনাবাহিনীর ভরণপোষণের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত উপায় হলো ভারুচে অবস্থিত সালার মাসুদের সুবিশাল পরিত্যাক্ত সেনা শিবির। অতএব ভোজের পরামর্শে, রাজা সুহালদেবের নেতৃত্বে সংযুক্ত ভারতীয় বাহিনী সেখানে এসে আশ্রয় গ্রহণ করে তুর্কি বাহিনীর আগমনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করলো। এদিকে ভোজের রণনীতি অনুসারে সুচতুর ভাবে পরিত্যাক্ত তুর্কি শিবিরে সংযুক্ত ভারতীয় বাহিনীর অবস্থানের সংবাদ ছড়িয়ে দেওয়া হলো। এই সংবাদ পেয়ে নিদারুণ ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে সালার মাসুদ তাঁর অবশিষ্ট বাহিনী সমেত ভারুচের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলেন।
মহারাজ সুহালদেবের মহাযুদ্ধের উপাখ্যান
==============================
কিছুদিন পরে এক ঊষাকালে তুর্কি বাহিনী সমেত সালার মাসুদ ভারুচের রণাঙ্গনে পৌঁছে সংযুক্ত বাহিনীর সংখ্যা দেখে বিস্ময়ে আর আনন্দে হতবাক হয়ে পড়লেন। তিনি দেখতে পেলেন ভারুচের রণাঙ্গনে তাঁদের স্মেচ্ছ বাহিনীকে স্বাগত জানানোর জন্য মাত্র ২৫ হাজার সেনা নিয়ে অপেক্ষা করছেন শ্রাবস্তীর মহারাজ সুহালদেব ব্যাস। সালার মাসুদ গাজী যেন নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। নিদারুণ আনন্দে তিনি তাঁর সেনাদের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন, “ইনশাল্লা, সুভানল্লা এই ক্ষুদ্র কাফের বাহিনীকে মাত্র ঘণ্টাখানেকের ব্যবধানে ইঁদুরের ন্যায় পিষে বধ করে হিন্দুস্থানের বুকে ইসলামের সাম্রাজ্যকে আরও শক্তিশালী করে মালওয়া আক্রমণ করে নিজের হাতে শয়তান কাফের ভোজের শিরচ্ছেদ করে আব্বাজানের হত্যা ইন্তেকাম নেব আমি।”
এরপর নিজের তুর্কি বাহিনীকে তিন ভাগে বিভক্ত করে তিরন্দাজ বাহিনীকে অগ্রিম ভাগে, পদাতিক বাহিনীকে দ্বিতীয় সারিতে আর আফগানিস্থানের মরুপ্রান্তরের দ্রুতগতির অশ্বপৃষ্ঠে সওয়ার অশ্বারোহী বাহিনীকে সবার শেষে রেখে নিজের বাহিনীকে মাত্র একটি রেখায় সজ্জিত করলেন সালার মাসুদ। তারপর তিনি আক্রমণের নির্দেশ দিতেই সবার প্রথমে তুর্কি তিরন্দাজরা সংযুক্ত বাহিনীর দিকে শয়ে শয়ে শর নিক্ষেপ শুরু করলো।

অপরদিকে তুর্কি তিরন্দাজদের শরাঘাত থেকে নিজেদের রক্ষার জন্য তৎক্ষণাৎ নিজের বাহিনীকে লৌহ ঢালের প্রাচীর নির্মাণের আদেশ দিলেন রাজা সুহালদেব। মুহূর্তের মধ্যেই নিজেদের মাথার উপর সুকঠিন ইস্পাতের ঢালের সারি তুলে একটি দুর্ভেদ্য প্রাচীর নির্মাণ করলো সংযুক্ত বাহিনী। তুর্কিদের তিরগুলি সেই ঢালের উপর আঘাত প্রাপ্ত হয়ে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে মাটিতে গড়িয়ে পড়লো। ফের তির নিক্ষেপ করলো তুর্কি বাহিনী, পুনরায় ঢালের প্রাচীর রচিত করে নিজেদের সুরক্ষিত করলো ভারতীয় বাহিনী। এইভাবে চললো বেশ কিছুক্ষণ। এরপর ভারতীয় বাহিনীর এই চালে নিদারুণ বিরক্ত হয়ে সালার মাসুদ তাঁর পদাতিক আর অশ্বারোহী বাহিনীকে উত্তেজিত কণ্ঠে নির্দেশ দিয়ে বলে উঠলেন, “আল্লাহর পবিত্র সৈন্যগণ, তোমরা কিসের জন্য অপেক্ষা করছো ? যাও ঝাঁপিয়ে পড়ো কাফেরদের উপর। দ্রুত ওদের নিকেশ করে হিন্দের মাটিতে আল্লাহর সাম্রাজ্য স্থাপন করো। মনে রেখো এই জেহাদে সফল হলে মৃত্যুর পরে পবিত্র জন্নতে স্থান হবে তোমাদের, আর ব্যর্থ হলে আল্লাহর রোষে জাহান্নমের আগুনে দগ্ধ হয়ে মরবে তোমরা”
সালার মাসুদের এই নির্দেশ পেয়েই গগনভেদি আল্লাহ-আকবর ধ্বনিতে চতুর্দিক বিস্ফারিত করে জিহাদের প্রবল আক্রোশে সংযুক্ত বাহিনীর দিকে ধেয়ে গেল তুর্কিদের পদাতিক বাহিনীর একাংশ, তাঁদের পেছনে পেছনে অশ্বখুঁড়ে ধূলিকণা উড়িয়ে ধেয়ে এলো এক বিশাল তুর্কি অশ্বারোহী বাহিনীও।

সাগরের জলরাশির ন্যায় সুবিশাল তুর্কি বাহিনীকে নিজেদের দিকে সুনামির বেগে ধেয়ে আসতে দেখলেও বিন্দুমাত্র শঙ্কিত হলেন না মহারাজ সুহালদেব। তিনি নিজ অশ্বপৃষ্ঠে সওয়ার হয়ে সংযুক্ত বাহিনীর সর্বাগ্রে পৌঁছে অকুতোভয় দৃপ্ত কণ্ঠে বলে উঠলেন, “হে আমার প্রিয় মিত্রগণ, দেশপ্রেমিক সৈন্যগণ আজ সেই পবিত্র সন্ধিক্ষণ আমাদের সম্মুখে উপস্থিত, যা ভবিষ্যতের ইতিহাসের পাতায় আমাদের নাম স্বর্ণাক্ষরে অমর করে রাখবে, প্রিয় মিত্রগণ আজ আমরা নিজেদের ধমনির অন্তিম রক্তবিন্দু পর্যন্ত যুদ্ধ করে ভিনদেশি বর্বর স্মেচ্ছ বিধর্মী দস্যুদের পশ্চাৎদেশে পদাঘাত করে আমাদের মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত করে নিজেদের ধর্ম, সভ্যতা আর সংস্কৃতিকে রক্ষা করবো, স্মেচ্ছ যবন দস্যুদের দেখিয়ে দেবো যোদ্ধা ভারতবাসীর অস্ত্রের শক্তি, অখণ্ড সনাতনী ভারতবর্ষের বীর ক্ষত্রিয় সেনানিদের দৃঢ় সঙ্কল্প আর একতার জোর,
মিত্রগণ তোমারা ছাড়ো-উদ্বেগ, সুতীক্ষ করো চিত্ত,
অখণ্ড ভারতবর্ষের মাটি দুর্জয় ঘাঁটি বুঝে নিক স্মেচ্ছ তুর্কি দুর্বৃত্ত।
মূঢ় যবন শত্রুকে হানো স্রোত রুখে, সুপ্ত তন্দ্রাকে করো ছিন্ন,
ঐক্যবদ্ধ সনাতনী দেশে যবন শত্রুরা এসে হয়ে হয়ে যাক নিশ্চিহ্ন।
আজি ধর্ম যোদ্ধাদের সুর ক্রমশই করে দৃপ্ত,
আসে সংহতি; অত্যাচারী তুর্কি শত্রুর প্রতি ঘৃণা হয় নিক্ষিপ্ত।
ভীরু অন্যায় প্রাণ-বন্যায় জেনো আজ উচ্ছেদ্য,
বিপন্ন এই দেশে তাই নিঃশেষে ঢালো প্রাণ দুর্ভেদ্য!
সব প্রস্তুত জিহাদি যুদ্ধের দূত হানা দেয় পশ্চিমের দরজায়,
অখণ্ড ভারতবর্ষ জুড়ে ক্ষিপ্ত জনতা গর্জায়, হর হর মহাদেব।
অখণ্ড ভারতবর্ষের মাটি দুর্জয় ঘাঁটি বুঝে নিক স্মেচ্ছ তুর্কি দুর্বৃত্ত, হর হর মহাদেব।”
প্রত্যুত্তরে সংযুক্ত ভারতীয় বাহিনীর সেনারাও একত্রিত ভাবে উদ্দীপ্ত কণ্ঠে ভৈরব কণ্ঠে গর্জন করে উঠলো, “হর হর মহাদেব”
কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রাচীন গ্রীসের স্পারটা রাজ্যের কিংবদন্তি যোদ্ধা লিওনিদাসের কায়দায় শুরু হলো এক প্রবল অসম যুদ্ধ। রাজা লিওনিদাস আর তাঁর ৩০০ বীর সেনানির মতোই সিংহ হৃদয়ে প্রবল বিক্রমে যুদ্ধ করতে লাগলো রাজা সুহালদেবের নেতৃত্বাধিন ভারতীয় বাহিনী। তাঁদের লক্ষ্য ছিল মূলত দুটো, প্রথম, যেভাবেই হোক সালার মাসুদের তুর্কি বাহিনীকে দ্বিপ্রহর পর্যন্ত রুখে দেওয়া আর দ্বিতীয়, যতটা সম্ভব সালার মাসুদের বাহিনীর প্রবল ক্ষতিসাধন। ভারতীয় লিওনিদাস, রাজা সুহালদেব আর তাঁর বাহিনীর তরবারি, ভল্ল আর তিরের আঘাতে রক্তাক্ত কলেবরে মৃত্যুর মুখে ঢলে পরে জাহান্নমের পথে পাড়ি জমালো বহু তুর্কি সেনা। স্মেচ্ছ সেনাদের রক্ত রুধিরে রক্তিম হয়ে উঠলো রাজা সুহালদেবের তরবারি। তুর্কি হামলাকারীদের মরদেহের স্থুপে পূর্ণ হয়ে উঠলো ভারুচের রণাঙ্গন। কিছুক্ষণের মধ্যেই সালার মাসুদের প্রেরিত হামলাকারী তুর্কি বাহিনীর প্রথম টুকরীটি রাজা সুহালদেব আর তাঁর নেতৃত্বাধিন ভারতীয় বাহিনীর সিংহ বিক্রমের সম্মুখে পরাজিত হয়ে প্রাণ ভয়ে পলায়ন করলো। এই দৃশ্য দেখে যারপরনাই ক্ষিপ্ত সালার মাসুদ পুনরায় আরেকটি সেনা টুকরী প্রেরণ করলেন। আগুয়মান তুর্কি বাহিনীর নতুন টুকরীকে ধেয়ে আসতে দেখে রাজা সুহালদেব তাঁর সেনাদের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তেজদৃপ্ত কণ্ঠে বলে উঠলেন, “বন্ধুগণ একবার পরাজিত হয়েও ফের ওরা আবার আসছে। আমি জানি এতক্ষণ যুদ্ধের পর আপনারাও রণক্লান্ত আর আহত। কিন্তু শপথ করুণ আজ কাপুরুষ বিধর্মী যবন আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে এই ধর্মযুদ্ধে আমরা কেউ পলায়ন করবো না। নিজেদের জীবনের অন্তিম নিশ্বাস পর্যন্ত যুদ্ধ করবো। এই যুদ্ধে আমাদের একটাই সঙ্কল্প হবে, হয় বিজয় নতুবা বীরগতি। জয় একলিঙ্গনাথ।” সুহালদেবের আহ্বানের প্রত্যুত্তরে সকল ভারতীয় সেনা সমশ্বরে সিংহনাদ করে উঠলো, “জয় একলিঙ্গনাথ”।
ফের শুরু হলো এক রক্তক্ষয়ী মহাযুদ্ধ। পুনরায় ভারতীয় বাহিনীর বীর সেনানিদের তরবারি আর ভল্লের আঘাতে ভারুচের রণাঙ্গনের ভূমিতে রক্তাক্ত কলেবরে ধরাশায়ী হতে লাগলো একের পর এক তুর্কি সেনা। কিন্তু এই অসম যুদ্ধে ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হলো রাজা সুহালদেবের ভারতীয় বাহিনীও। তুর্কিদের একের পর এক আক্রমণের তরঙ্গে রাজা সুহালদেবের বাহিনীর সংখ্যা ২৫ হাজার থেকে হ্রাস পেয়ে নেমে দাঁড়িয়েছে আনুমানিক ৯-১০ হাজারে। যুদ্ধে তুর্কি বাহিনীর নিক্ষিপ্ত ভল্লের আঘাতে একসময় গুরুতর আহত হয়ে ভূপাতিত হলো স্বয়ং রাজা সুহালদেবের অশ্বটিও। এবারে তিনি তাঁর দুহাতে দুটি তরবারি নিয়ে পদাতিক সেনার ন্যায় যুদ্ধ শুরু করলেন তুর্কি বাহিনীর বিরুদ্ধে। দ্বিপ্রহরের সময় দেখা গেল ভারুচের রণাঙ্গনে সালার মাসুদের তুর্কি বাহিনীর পথ রোধ করে অটল হিমালয় পর্বতের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছেন শ্রাবস্তীর বীর মহারাজ সুহালদেব ব্যাস। তাঁর ঊর্ধ্বোত্থিত দুই হস্তের দুই কৃপাণ তুর্কি বাহিনীর রক্তে শিক্ত, তাঁর শরীরও শত্রু সেনাদের রক্তে রক্তিম, মধ্যাহ্ন সূর্যের প্রখর কিরণ ছটায় তাঁর দুহাতের দুই শানিত তরবারি বারংবার জ্বলে উঠছে বিদ্যুৎ শিখার ন্যায়। সেই তরবারি যুগলের প্রতাপে সেদিন ভারুচের ধর্মযুদ্ধে অস্তাচলে গেছিল যে কতো কতো তুর্কি শত্রুর জীবনদীপ সে হিসাব রাখেনি স্বাধীনতাত্তোর ভারতের সরকারি ঐতিহাসিকরা। রাজা সুহালদেব তাঁর তরবারি যুগল দিয়ে কসাইয়ের ন্যায় নির্মমভাবে জবাই করছিলেন বর্বর ভিনদেশি স্মেচ্ছ বাহিনীকে আর বারংবার তাঁর বাহিনীর দিকে তাকিয়ে দৃপ্ত কণ্ঠে বলছিলেন, “বাধা দাও বিধর্মী স্মেচ্ছ অসুরদের, ভারতীয় ধর্ম, সভ্যতা আর সংস্কৃতি রক্ষা করবার জন্য বধ করো ওদের, আর মাত্র কিছুক্ষণ, সাহায্যকারী অবশিষ্ট ভারতীয় বাহিনীর আগমনকাল আসন্ন।” কিন্তু বিশাল তুর্কি বাহিনীর যুগপৎ আক্রমণে ধিরে ধিরে নিঃশেষিত হয়ে আসতে লাগলো রাজা সুহালদেবের বাহিনীর প্রাণশক্তি।
অবশিষ্ট ভারতীয় বাহিনীর যুগপৎ আক্রমণ এবং তুর্কি বাহিনীর পরাজয়
==================================================
ঠিক এমন সময় ভারুচের রণাঙ্গনের তিন দিকের প্রান্ত থেকে সজোরে বেজে উঠলো অগণিত তুড়ি, ভেড়ি আর দুন্দুভির আওয়াজ। ভেসে এলো অগণিত সেনানীদের ভৈরব কণ্ঠের চিরপরিচিত “হর হর মহাদেব” রণ হুঙ্কার আর রণহস্তীদের বৃংহণধ্বনি। রাজা সুহালদেব দেখতে পেলেন নিজেদের পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে ভারুচের রণাঙ্গনে তুর্কি বাহিনীকে তিন দিক থেকে বেষ্টিত করে দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসছে মহারাজ ভোজের নেতৃত্বাধিন কাতারে কাতারে ভারতীয় বাহিনী। কিছুক্ষণের মধ্যেই সুবিশাল অবশিষ্ট ভারতীয় বাহিনী তাঁদের দৈত্যাকার রণহস্তী, অশ্বারোহী বাহিনী, তিরন্দাজ আর পদাতিক বাহিনী দিয়ে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেললো উদ্ধত জিহাদি সালার মাসুদ আর তাঁর গজনী বাহিনীকে। অবশেষে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন রাজা সুহালদেব। অপরদিকে বিশাল সংযুক্ত ভারতীয় বাহিনী দ্বারা বেষ্টিত হয়ে থরহরি কম্প হয়ে দিশাহারা হয়ে পড়লো গজনী বাহিনী। ধর্মযুদ্ধের গতিবেগ গেল উল্টে। এতক্ষণ যে সালার মাসুদ ছিলেন শিকারির ভূমিকায় সেই তিনিই এবারে পরিণত হলেন শিকারে আর এতক্ষণ প্রবল তুর্কি বাহিনীর বিরুদ্ধে কোণঠাসা রাজা সুহালদেব পরিণত হলেন শিকারিতে।

যুদ্ধের নামে প্রহসন চললো আরও কিছুক্ষণ। সংযুক্ত ভারতীয় বাহিনীর রণহস্তী বাহিনীর পদতলে পিষ্ট হয়ে আর তাঁদের তরবারি ও ভল্লের রুদ্ররোষের সম্মুখে খড়কুটোর মতো উড়ে গেল তুর্কিদের যাবতীয় প্রতিরোধ। কলে ধরা পড়া ইঁদুরের মতো অবস্থা হলো তুর্কি বাহিনীর। ভারতীয় সেনারা দক্ষ কসাইয়ের ন্যায় নিপুণভাবে জবাই করতে লাগলো যবন জিহাদি সেনাদের। যুদ্ধে রাজা সুহালদেব আর রাজা ভোজের ভল্লের আঘাতে নিহত হলো তুর্কি বাহিনীর তিন প্রধান সেনাধক্ষ্য আরসালান শাহ, সইফ আলদিন সুরি আর গাজি ইসমাইল বেগ। সন্ধ্যে নামার কিছুক্ষণ পূর্বে সালার মাসুদের বিশাল বাহিনীর সংখ্যা কমে গিয়ে দাঁড়ালো মাত্র ২০-২২ হাজারে। কাফের বাহিনীর বিরুদ্ধে নিজেদের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী উপলব্ধি করতে পেরে সন্ধ্যের সময় সন্ত্রস্ত সালার মাসুদ তাঁর বাহিনীকে পশ্চাৎপশরণ করবার নির্দেশ দিলেন।
সালার মাসুদ গাজির বধ পর্ব
=====================
এরপর সংযুক্ত ভারতীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজিত ও বিধ্বস্ত হয়ে নিজের ভারত বিজয় আর ভারতবর্ষের ভূমিতে ইসলামের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য মুলতুবি রেখে রাতের আঁধারকে ঢাল বানিয়ে কাপুরুষের ন্যায় ভারুচের যুদ্ধভূমি ত্যাগ করে পলায়ন করলো সালার মাসুদ। সালার মাসুদের পলায়নের সংবাদ শ্রবণ করেই অশ্বপৃষ্ঠে সওয়ার হয়ে ক্ষুধার্ত বাঘ্রের ন্যায় নিজেদের অশ্বারোহী বাহিনী সমেত তুর্কিদের পিছু ধাওয়া করলেন ভারতবর্ষের দুই অকুতোভয় নরেশ ভোজদেব পারমার আর সুহালদেব ব্যাস। এদিকে রণনীতিতে দক্ষ আর পোড় খাওয়া শাসক ভোজ আগে থেকেই অনুমান করেছিলেন যে যুদ্ধে পরাজিত হলে সালার মাসুদ প্রাণভয়ে সম্ভবত তাঁর আব্বাজানের ন্যায় মুলতানের পথেই গজনীর দিকে অগ্রসর হবেন, সেই জন্য মুলতান যাবার পথে আগে থেকেই মালওয়ার একটি অশ্বারোহী বাহিনীকে মোতায়েন রেখেছিলেন উনি। এবারে সেই বাহিনী অস্ত্রশস্ত্র সমেত এগিয়ে এসে পথরোধ করলো পলাতক সালার মাসুদ আর তাঁর অবশিষ্ট তুর্কি বাহিনীর। রাতের আধারেই পুনরায় যুদ্ধ শুরু হলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই ভোজ আর সুহালদেবের অশ্বারোহী বাহিনী তুর্কি সেনাদের পশ্চাৎদেশ থেকে আক্রমণ করলো। অসম এই যুদ্ধ কিছুক্ষণের মধ্যেই নির্ণায়কভাবে পরাজিত হয়ে সংযুক্ত ভারতীয় বাহিনীর হাতে বন্দি হলেন জিহাদি সালার মাসুদ গাজি। তিনি এবারে মরিয়া হয়ে তরবারির দ্বন্দ্বযুদ্ধের আহ্বান জানালেন রাজা ভোজকে। কিন্তু তুর্কি আক্রমণকারীকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে পরাজিত করে বধ করবার জন্য ভারুচের মহাযুদ্ধে নির্ণায়ক মহানায়কের ভূমিকা পালনকারী রাজা সুহালদেবকে সুযোগদান করলেন ভোজ। রাতের আঁধারে মশালের আলোকমালায় শুরু হলো তরবারির দ্বন্দ্বযুদ্ধ। কিছুক্ষণের মধ্যেই সুহালদেবের অসির আঘাতে পরাজিত ও ধরাশায়ী হলেন সালার মাসুদ। এরপর বিখ্যাত চাণক্যনীতি, “শত্রুর শেষ রাখতে নেই” অনুসরণ করে জোরালো কণ্ঠে “হর হর মহাদেব” ধ্বনিতে গর্জে উঠে নিজের অসির এক কোপে উদ্ধত সালার মাসুদের শিরচ্ছেদ করলেন রাজা সুহালদেব। ভারুচের ধর্ম যুদ্ধের নির্ণায়ক বিজয়লাভের ফলে প্রায় দেড় শতাব্দীর জন্য নিষ্কণ্টক হয়েছিল ভারতবর্ষ। ১১৭৮ খ্রিষ্টাব্দের মাউন্ট আবুর পাদদেশে ঘুরের সুলতান মহম্মদ ঘোরীর জিহাদি তুর্কি বাহিনীর বিরুদ্ধে গুজরাটের চালুক্য বীরাঙ্গনা রানি নাইকিদেবির নেতৃত্বাধিন ভারতীয় বাহিনীর কায়দারার মহাযুদ্ধের পূর্বে কয়েকটা ছোটখাটো হামলা ছাড়া সেরকম বৃহৎ মাপের তুর্কি হামলার সম্মুখীন হতে হয়নি ভারতবর্ষকে।
ধর্ম রক্ষাকারী ভারতীয় বাহিনী আর লুণ্ঠনকারী জিহাদি তুর্কি বাহিনীর মধ্যে মানসিকতার বিস্তর পার্থক্য ছিল। ভারুচের যুদ্ধে নির্ণায়ক জয়লাভের পর মৃত শত্রুর প্রতি শ্রদ্ধা অর্পণ করে রাজা সুহালদেব আর মহারাজ ভোজ প্রয়াত সালার মাসুদ গাজির বাহিনীর ইমামকে অনুমতি দান করেছিলেন তুর্কি সর্দারের মরদেহ ভারুচের রণাঙ্গনের নিকটেই শ্রদ্ধাপূর্বক কবরস্থ করবার। মহানুভব ভারতীয় রাজাদের অনুমতি লাভ করে ইসলামিক রীতি অনুসরণ করে ভারুচের যুদ্ধক্ষেত্রের নিকটে গোর দেওয়া হয় সালার মাসুদের নশ্বর দেহ। এর বহু শতাব্দী পর আলাউদ্দিন খিলজির শাসনকালে দিল্লির তুর্কি সুলতানের নির্দেশে সেখানে একটি বিশাল দরগা নির্মাণ করে ইতিহাস বিকৃত করে রীতিমত এক মহান পীর সন্ন্যাসীতে রূপান্তরিত করা হয় সালার মাসুদ গাজিকে। অপরদিকে রাজা সুহালদেব পরিণত হন অশুভ শক্তির বাহক এক ঘৃণ্য শয়তানে। দুঃখের বিষয় এই যে সনাতন ধর্মাবলম্বী বহু ভারতীয় নাগরিক আজও সেই দরগায় গিয়ে রীতিমত শ্রদ্ধাপূর্বক প্রার্থনা জানান গাজি সালার মাসুদের প্রতি, ঠিক যেমন আজমির শরীফে গিয়ে তরাইনের দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে মহম্মদ ঘোরীর তুর্কি বাহিনীর বিশেষ গুপ্তচর তথা জিহাদি খাজা মইনউদ্দিন চিস্তির দরগায় আজও ভক্তিভরে প্রার্থনা নিবেদন করেন অগণিত সনাতন ধর্মাবলম্বী ভারতীয় নাগরিক।
সংযুক্ত বাহিনীর নায়কদের করুণ পরিণতি
==============================
অপরদিকে ইতিহাসের পাতায় অবহেলিত হয়ে ক্রমে বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যান বীরবড় ক্ষত্রিয় ধর্মযোদ্ধা রাজা সুহালদেব। এদিকে ভারুচের ধর্মযুদ্ধে জয়লাভ করে বিজয়ীর বেশে নিজ রাজধানি ধারে প্রত্যাবর্তন করেন মহারাজ ভোজ। সালার মাসুদের স্মেচ্ছ বাহিনীর বিরুদ্ধে নিজের বিজয়কে স্মরণীয় করে রাখবার বাসনায় বাকদেবি সরস্বতীর একনিষ্ঠ ভক্ত ভোজ রাজধানি ধারের নিকটে নির্মাণ করেন ভোজশালার বিখ্যাত ঐতিহাসিক সরস্বতী মন্দির। এছাড়া নিজের পূর্ব প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী রাজগুরু শেখরাদিত্যের আশ্রমের নিকটে স্থাপন করেন নিজের নতুন রাজধানি ভোজপুর। এই ভোজপুরেই তিনি নির্মাণ শুরু করেন বিখ্যাত ভোজেশ্বর শিব মন্দির। মন্দিরটির গর্ভগৃহে অবস্থান করছে সাড়ে সাত ফুট উচ্চতার একটি শিব লিঙ্গ। ১০৫৫ খ্রিষ্টাব্দে গুজরাটের চালুক্য রাজা প্রথম ভীমদেব সোলাঙ্কি আর কালাচুরি রাজ্যের চেরি বংশের রাজা লক্ষ্মীকর্ণের সংযুক্ত বাহিনীর বিরুদ্ধে এক যুদ্ধে গুরুতর আহত হয়ে রণভূমিতেই বীরগতি প্রাপ্ত হন মালওয়া নরেশ ভোজদেব পারমার। রাজা ভোজের মৃত্যুর প্রায় আড়াইশো বছর পর ১৩০৫ খ্রিষ্টাব্দে মালওয়ার অন্তিম স্বাধীন রাজপুত শাসক মহাকালদেব কে পরাজিত করে বলপূর্বক মালওয়া অধিকার করে ভোজেশ্বর শিব মন্দির আর ভোজশালার সরস্বতী মন্দির সমেত মালওয়ার অনান্য ঐতিহ্য মণ্ডিত প্রাচীন মন্দিরগুলি ধ্বস্ত করে ধুলোয় মিশিয়ে দেন দিল্লির তুর্কিজাত স্মেচ্ছ সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি। এরপর খিলজির নির্দেশে মালওয়ার সমৃদ্ধির প্রতীক ভোজশালার দেবী সরস্বতীর মূর্তি দ্বিখণ্ডিত করে সেখানে বলপূর্বক স্থাপন করা হয়েছিল একটি মসজিদ। আলাউদ্দিনের তুর্কি গুপ্তচর ফকির কামাল মৌলনার নামানুসারে মসজিদের নামকরণ হয়েছিল কমল মসজিদ।এরপর একরাতে কিছু স্থানীয় হিন্দু প্রজা গোপনে সেই দ্বিখণ্ডিত সরস্বতী মূর্তিটি নিয়ে কিছুটা দূরবর্তী এক স্থানে মাটির তলদেশে লুকিয়ে ফেলেছিলেন। অযোধ্যার রাম মন্দির-বাবরি মসজিদ বিতর্কের মতো ভোজশালার প্রাচীন সরস্বতী মন্দির আর কামাল মসজিদ নিয়েও বর্তমানে বিতর্ক অব্যাহত মধ্যপ্রদেশ রাজ্যে। ১৯৯৭ সালে দিগ্বিজয় সিংহের নেতৃত্বাধিন কংগ্রেস সরকার ক্ষমতায় এসেই আইন করে ভোজশালায় হিন্দুদের সরস্বতী বন্দনা নিষিদ্ধ করেন এবং কমল মসজিদে স্থানীয় মুসলিমদের নামাজ পাঠের ঢালাও অনুমতি দেন। এরপর ২০০৬ সালে ক্ষমতায় এসে পূর্বের নির্দেশই বহাল রাখেন শিবরাজ সিংহ চৌহানের বিজেপি সরকারও।

Comments

Popular posts from this blog

বিষ কন্যা