কাবুল হিন্দু শাহী রাজাদের প্রতিরোধ
==========================
গৌরচন্দ্রিকাঃ
=========
১৯৯৯ সালের ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের কুখ্যাত বিমান অপহরণ কাণ্ড থেকে মার্কিন মুলুকে জমজ টাওয়ার ধ্বংসের পর ২০০১ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত মার্কিন বাহিনীর হামলা, ওসামা বিন লাদেন নামধারী কুখ্যাত ইসলামিক সন্ত্রাসবাদীর হত্যা, প্রভৃতি নানান কারণে আজ আফগানিস্থান নামটি বিশ্ব প্রসিদ্ধ। আজ থেকে ১২০০ বছর পূর্ব থেকেই এই রাষ্ট্রটি ভারতীয় ইতিহাসের পাতায় কুখ্যাত ছিল মামুদ গজনী, মহম্মদ ঘোরী, আহমেদ শাহ আবদালি প্রমুখ কুখ্যাত তুর্কি লুণ্ঠনকারীদের দৌরাত্মে। কিন্তু এই পেজের অনুসরণকারী আধুনিক ভারত আর বাংলাদেশের বহু পাঠকরাই হয়তো জানেন না যে ভারতে ইসলামিক আগ্রাসনের প্রারম্ভে আফগানিস্থানও প্রাচীন অখণ্ড ভারতবর্ষের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিল এবং প্রাচীন সনাতনী আর বৌদ্ধ ভাবধারায় বিশ্বাসী ছিল। বর্তমানে আফগানিস্থান ভারতের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত একটি ইসলামিক রাষ্ট্র যা পাকিস্তান নামক আরেকটি ইসলামিক রাষ্ট্র দ্বারা বিভক্ত।

প্রাচীন আফগানিস্থানের কাহিনীঃ
=======================
মহাভারতে আমরা প্রাচীন আফগানিস্থানের বর্ণনা পাই "উপগণস্থান" হিসাবে। সংস্কৃত ভাষায় উপগণস্থান শব্দের অর্থ হল মৈত্রীপূর্ণ অধিবাসী বৃন্দের বাসস্থল। পশ্চিম আফগানিস্থানে অবস্থিত বর্তমান হীরাট প্রদেশের প্রাচীন সংস্কৃত নাম ছিল "হরিরুদ্র"। ১৯৯৯ সালে তালিবান সন্ত্রাসবাদীরা আফগানিস্থানের যে প্রদেশে ভারতীয় বিমানটি অপহৃত করে নিয়ে গিয়েছিল সেই কান্দাহার শহর প্রাচীন মহাভারতীয় আমলে গান্ধার রাজ্য হিসাবে জনপ্রিয় ছিল। মহাভারতের গান্ধারী এই রাজ্যেরই রাজকুমারী ছিলেন এবং তাঁর ভ্রাতা শকুনি মামা গান্ধার রাজ্যের নৃপতি ছিলেন। পরবর্তীকালে গ্রীক সম্রাট অ্যালেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের সময় অম্ভীকুমারও এই গান্ধার রাজ্যের শাসক ছিলেন। খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে শক উপজাতির সম্রাট কনিস্ক আফগানিস্থান আর পাকিস্তানের ফাটা প্রদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে নিজের শক সাম্রাজ্য বিস্তার করেন। সম্রাট কনিস্ক প্রথমে যোরাথ্রসুতবাদী থাকলেও পরবর্তীকালে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। সম্রাট কনিস্কের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র হুবিস্ক বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি কিছুটা উদাসিন থাকলেন এবং শেষে তাঁর পৌত্র সনাতন ধর্ম গ্রহণ করে নিজের নামকরণ করেছিলেন সম্রাট বাসুদেব। এইভাবে সম্রাট বাসুদেবের হাত ধরে আফগানিস্থানের গান্ধার সাম্রাজ্য জুড়ে সনাতন ধর্ম প্রভাব বিস্তার করেছিল।

এরপরে প্রায় দুই শতাব্দীকাল পরে সপ্তম শতাব্দীর প্রারম্ভকাল থেকে পশ্চিমের আরব, তুর্কমেনিস্থান আর তাজিকিস্থান ভূখণ্ড থেকে আফগানিস্থানের মাটিতে শুরু হয় আরব এবং তুরস্ক ইসলামিক আগ্রাসনকারীদের প্রবল আক্রমণ। ৬৪৫ খ্রিষ্টাব্দে চিনের বিখ্যাত বৌদ্ধ পর্যটক হুয়েন সাং যখন ভারত ভ্রমণ পর্ব সাঙ্গ করে উত্তরাপথে গান্ধার, উধাভাণ্ডাপুর (খাইবার, পাখতুন প্রদেশ, পাকিস্তান), কপিশা (আফগানিস্থানের উত্তরপূর্ব অঞ্চলের প্রদেশ) সহ আফগানিস্থানের একাধিক রাজ্যগুলিতে ভ্রমণ করছিলেন তখন তিনি তাঁর ভ্রমণ কাহিনীতে লিখেছিলেন, পশ্চিম প্রান্তের তুর্কি, আরবদের নগ্ন আগ্রাসনের ফলে গান্ধারের বর্তমান নৃপতি বীরগতি প্রাপ্ত হন এবং তাঁর মৃত্যুর সাথে সাথে রাজধানি পুরুষপুরায় (পেশোয়ার) অবস্থিত গান্ধার রাজবংশের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়। বর্তমানে গান্ধার, কপিশা রাজ্যের উপর নির্ভরশীল। গান্ধারের অধিকাংশ নগর, জনপদ এবং রাজপথ জনশূন্য। নগরের অর্ধ দগ্ধ এবং সম্পূর্ণ ভস্মীভূত গৃহগুলি যেন পশ্চিমের আরব এবং তুর্কি সন্ত্রাসবাদী লুণ্ঠকদের ভয়াবহ অত্যাচারের সাক্ষী বহন করছে। কপিশার হিন্দু নৃপতিও তাঁর রাজ্যের আক্রান্ত পশ্চিমপ্রান্ত রক্ষার দায়িত্ব নিজের সামন্তরাজাদের উপর ন্যস্ত করে নিজের রাজধানি কপিশা থেকে উধাভাণ্ডাপুরে স্থানান্তরিত করে বর্তমানে সেখানেই রাজপরিবার সমেত বসবাস করছেন।" এর কিছুকাল পরে হুয়েন সাং পুনরায় তিব্বতে ফিরে যান এবং তিনি ফিরে যাবার মাত্র ১৯ বছর পরেই ৬৬৪ খ্রিষ্টাব্দে কপিশার হিন্দু নৃপতি তুরস্ক আগ্রাসনকারীদের হাত থেকে নিজের রাজ্যের সম্পদ এবং নিরীহ প্রজাদের রক্ষা করবার জন্য মূল ভারতীয় ভূখণ্ডের নৃপতিদের প্রতি যৌথ সেনা সহায়তার সাহায্য প্রার্থনা করেন। তৎকালীন ভারতীয় নৃপতিদের প্রেরিত যৌথ সেনার সহায়তায় এক বিশাল বাহিনী নির্মাণ করে তুরস্কের ইসলামিক আগ্রাসনকারীদের নিজ ভূখণ্ড থেকে সফলভাবে বিতাড়িত করেন তিনি। কিন্তু এই যুদ্ধের মাত্র ৭ বছর পরেই ৬৭১ খ্রিষ্টাব্দে পুনরায় এক বিশাল তুরস্ক বাহিনীর দ্বারা আচমকা আক্রান্ত হয় তাঁর রাজ্য কপিশা। কুভা (কাবুল) নগরী লুণ্ঠিত আর ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এরপর ভগ্ন হৃদয় কপিশা সম্রাট কুভা (কাবুল) ত্যাগ করে উধাভাণ্ডাপুরেই নিজের রাজ্যের স্থায়ী রাজধানি স্থাপন করেন।

আফগানিস্থানের হিন্দু শাহী সাম্রাজ্যের উত্থান কাহিনী
=======================================
এরপর নবম শতকে সাবেক গান্ধার রাজ্যে সনাতন ধর্মাবলম্বী এক হিন্দু রাজবংশের উত্থান হয়। মামুদ গজনীর সভাকবি আল-বেরুনি এই হিন্দু সাম্রাজ্যকে হিন্দু শাহী হিসাবে চিহ্নিত করে এবং হিন্দু শাহী রাজবংশকে ব্রাহ্মণ বর্ণের বলে অভিহিত করেন। কিন্তু পরে দ্বাদশ শতকের বিখ্যাত কাশ্মীরি ঐতিহাসিক কালহান তাঁর রাজতরঙ্গিণী গ্রন্থে একাধিক প্রমাণ সহকারে গান্ধারের এই প্রাচীন হিন্দু শাহী রাজবংশ সম্বন্ধে বিস্তারিতভাবে লেখেন। কালহানের মতে হিন্দু শাহী রাজবংশের নৃপতিরা প্রাচীন সূর্য বংশীয় ক্ষত্রিয় জাত ছিলেন। পরবর্তীকালে ব্রিটিশ এবং আধুনিক ঐতিহাসিকরাও কালহানের এই মন্তব্যে সায় দিয়েছেন। দশম শতকের মধ্যভাগে আনুমানিক ৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে রাজা জয়পাল এই হিন্দু শাহী রাজবংশের পত্তন করেন। ৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে কুখ্যাত ইসলামিক দস্যু সাবুক্তিগীন যখন গজনীর সুলতান হন তখন হিন্দু শাহী রাজবংশের পশ্চিমপ্রান্ত "হিন্দুকুশ" পর্বতের অপরপ্রান্তে কপিশা পর্যন্ত এবং পূর্বপ্রান্তে পাঞ্জাবের চেনাব নদি পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। সেইকালে আজকের পাখতুন জাতি সনাতন ধর্মাবলম্বী "পাখতা জাতি" হিসাবে পরিচিত ছিল।

হিন্দু শাহী রাজবংশের প্রতিরোধের কাহিনী
===============================
রাজা জয়পালের পরাক্রমি প্রতিরোধ পর্ব
==============================
প্রায় দুশো বছর ধরে ইসলাম ধর্মাবলম্বী পশ্চিমা আরব আর তুরস্ক বাহিনীর ক্রমাগত আক্রমণের ফলে ৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে তুর্কমেনিস্থানের সামানিদ বংশের এক তুর্কি সেনাপতি আলাপ্তগীনের হাতে কুভা নগর অধিকৃত হল। স্থানীয় হিন্দু নৃপতিদের পক্ষে আর উদ্ধার করা সম্ভব হল না কুভা নগরী। এরপর আলপ্তগীন নিজেকে কুভার সুলতান ঘোষণা করেই শুরু করলেন প্রাচীন কুভা নগরীর বুক থেকে সমস্ত বৈদিক আর বৌদ্ধ চিহ্ন লোপাট করে নগরের ইসলামিককরণ। সবার প্রথমে কুভার নাম পরিবর্তন করে নয়া কাবুল নাম রাখলেন তিনি। এরপর কাবুল নগরীর মধ্যপ্রান্তে অবস্থিত বিশাল সুপ্রাচীন শিব মন্দিরটি সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত করে সেখানে একটি মসজিদ নির্মাণ করলেন। এছাড়াও ধ্বস্ত হল কুভা নগরীর আরও বহু শতাব্দী প্রাচীন মন্দির এবং মঠ সমূহ। এরপর ৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দে সাবুক্তিগীন গজনীর অধিপতি হয়েই সম্পূর্ণ আফগানিস্থান থেকে কাফেরদের নির্মূলের জন্য প্রতিবেশী হিন্দু শাহী রাজ্যের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে রাজা জয়পালের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করলেন।

প্রাথমিক ভাবে রাজা জয়পালের বাহিনী সাবুক্তিগীনের ইসলামিক আগ্রাসন সফলভাবে প্রতিহত করতে সমর্থ হলেও অচিরেই তুর্কিদের ছল, চাতুরী আর কাপুরুষতা পূর্ণ মধ্যযুগীয় তুর্কি যুদ্ধকলার সাথে এঁটে উঠতে না পেরে একের পর এক যুদ্ধে পরাজিত হয়ে বাধ্য হলেন হিন্দুকুশ পর্বতমালার পশ্চিমপ্রান্ত চিরতরে ত্যাগ করে উধাভাণ্ডাপুরে পিছিয়ে আসতে। এর ফলে কাবুলের পর হিন্দুকুশের পশ্চিমপ্রান্তেও বিলুপ্ত হল সনাতন ধর্ম। স্থাপিত হল ইসলামিক সাম্রাজ্যে।

এরপর ৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দে অনমনীয় রাজা জয়পাল সুলতান সাবুক্তিগীনকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করে নিজের মাতৃভূমির হারানো সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টায় এক বিশাল বাহিনী সমবেত করে গজনী আক্রমণ করেন। ইসলামিক ঐতিহাসিক উৎবী লিখেছেন, কাবুলের অদূরে লাঘমান প্রদেশে টানা দুদিন ভয়াবহ যুদ্ধের পর জয় তখন প্রায় করতলগত কাফেরদের। রাজা জয়পালের বাহিনীর অসামান্য বীরত্বের সম্মুখে পরাজিত হয়ে সাবুক্তিগীনের অবশিষ্ট বাহিনী সন্ত্রস্ত হয়ে পলায়ন করে আফগানিস্থানের রুক্ষ মরুপ্রান্তরের এক গিরীগহ্বরে আশ্রয় গ্রহণ করলো। জয়োল্লাসে সুলতানের বাহিনীর পিছু ধাওয়া করলো জয়পালের বাহিনী। কিন্তু ভাগ্য বিরূপ। কিছুদূর অগ্রসর হবার পরই আচমকা শুরু হল এক ভয়ানক ধূলিঝড় (আঁধি)। সেই ভয়াবহ ধূলিঝড়ে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ল রাজা জয়পালের বাহিনী। এরপর ধূলি ঝড়ের প্রকোপ শেষ হলে আচমকা গিরীগহ্বরেনিজেদের লুকনো স্থান থেকে আত্মপ্রকাশ করে ভয়ানক আক্রমণ শানিয়ে জয়পালের হিন্দু বাহিনীকে তছনছ করে দিলো সুলতান সাবুক্তিগীনের বাহিনী। হতোদ্যম রাজা জয়পাল বিফল মনোরথে পশ্চাৎপশরন করে ফিরে এলেন নিজের রাজধানি উধাভাণ্ডাপুরে। পরাজিত রাজা জয়পাল বাধ্য হলেন সাময়িকভাবে সুলতান সাবুক্তিগীনের বশ্যতা স্বীকার করে তাকে মোটা অঙ্কের করদান করতে।


নীলমের মহাযুদ্ধ
=============
এই পরাজয়ের প্রায় ১০ বছর পর ৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দে রাজা জয়পাল তাঁর পূর্বসূরিদের ন্যায় এক সংযুক্ত সেনা সহায়তার প্রার্থনা করে সাহায্য চেয়ে পাঠালেন ভারতের হিন্দু সম্রাটদের প্রতি। কাশ্মীরের হিন্দু রাজবংশ, দিল্লি-আজমিরের চৌহান রাজবংশ, কালিঞ্জরের চান্দেল রাজবংশ, কনৌজের রাজবংশ এবং গুজরাটের প্রতিহার চালুক্য রাজবংশের সেনা সহায়তায় রাজা জয়পাল পুনরায় এক বিশাল সংযুক্ত সেনা নির্মাণ করে নবোদ্যমে যুদ্ধ-যাত্রা শুরু করলেন গজনীর উদ্দেশ্যে। মহারাজের মনে তখন কেবলমাত্র একটাই সঙ্কল্প আর একটাই প্রতিজ্ঞা, যেভাবেই হোক বিধর্মী যবন লুণ্ঠকদের হাত থেকে নিজের হারানো মাতৃভূমির পুনরুদ্ধার। ঐতিহাসিক উৎবীর মতে, নীলম নদীর প্রান্তরে মুখোমুখি হল দুই বাহিনী। রাজা জয়পালের সাগরের জলরাশির ন্যায় সুবিশাল বাহিনী দর্শন করে হতোদ্যম হয়ে পড়লেন সুলতান সাবুক্তিগীন। এরপর যথাসময়ে যুদ্ধ শুরু হল।

সারাদিন ভয়াবহ সংঘর্ষ চলল। তুর্কি এবং জয়পালের বাহিনীর সেনাদের রক্তে পিচ্ছিল হয়ে উঠল যুদ্ধভূমি। দিনের অন্তিমভাগে জয় যখন পুনরায় রাজা জয়পালের করতলগত, ঠিক শে সময়ই সূর্যাস্ত হল। প্রাচীন বৈদিক মহাভারতের যুদ্ধনীতি অনুসরণ করে বেজে উঠল রাজা জয়পালের বাহিনীর বিউগল। সেদিনের মতো সাঙ্গ হল যুদ্ধ। নির্বোধের মতো বিজয়শ্রী নিলমের যুদ্ধপ্রান্তেই ফেলে এলেন রাজা জয়পাল।

সাবুক্তিগীনের ষড়যন্ত্র
================
ক্রমে সন্ধ্যা ঘন হল। দুই বাহিনীর শিবিরই আলোকিত হয়ে উঠল অগণিত মশালের আলোয়। ঠিক এহেন সময়েই রাজা জয়পালের তাঁবুতে এসে বিশ্রামরত জয়পালকে তাঁর এক রক্ষী জানালেন যে শত্রুপক্ষের দুই যবন সেনাপতি এসেছেন মহারাজের সাক্ষাৎপ্রার্থী হয়ে। প্রাচীন মহাভারতীয় যুদ্ধ নীতি অনুযায়ী শত্রুরা ততক্ষণই শত্রু থাকে যতক্ষণ যুদ্ধ চলে। দিনের শেষে শত্রুরা সাময়িক মিত্রতে পরিণত হয়। আর সেই সময় সাক্ষাৎ করতে আসা শত্রুরাও অতিথি হিসাবে বিবেচিত হয়। অতএব মহারাজ জয়পাল নিজের তাঁবুতে দেখা করলেন দুই তুর্কি সেনাপতির সাথে। কিছুক্ষণ ভোজনপর্ব, সুরাপান আর খোশগল্প চলবার পর দুই তুর্কি সেনাপতি মহারাজের নিকট তাঁর বিশাল গজ বাহিনী সম্বন্ধে জানতে চাইলেন। তাঁরা তীব্র বিস্ময় প্রকাশ করে রাজার নিকটে প্রার্থনা করলেন, এতো বিশাল দেহি রণহস্তীদের কোন জাদুমন্ত্রবলে বশ মানিয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে যুদ্ধে শত্রুদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয় স্বয়ং রাজার সেনাবাহিনীর হস্তীশালায় গিয়ে নিজেরা চাক্ষুষ তা দর্শন করতে চায়। বৈদিক ধর্মে অতিথি দেবায় ভব। অতিথির অনুরোধ রক্ষা না করা ধর্মদ্রোহিতারই অনুরূপ। তাই রাজা জয়পালের নির্দেশে তাঁর রক্ষীরা দুই তুর্কি সেনাপতিকে নিজেদের হস্তীশালায় নিয়ে গেলো। তখন রাত্রিকাল। মাহুতরা কুনকি হাতিদের নৈশভোজের ব্যবস্থায় রত। সেখানে পৌঁছে রণহস্তীদের দেখার অছিলায় আচমকা দুই কুচক্রী তুর্কি সেনাপতি স্বয়ং রাজা জয়পালের রণহস্তীর খাদ্যে বিষ মিশিয়ে দিয়ে পুনরায় রাজার শিবিরে এসে তাঁকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে প্রসন্ন চিত্তে নিজেদের শিবিরে ফিরে গেলো।

পরেরদিন ঊষাকালে রণবাদ্য বেজে ওঠার সাথে সাথেই পুনরায় শুরু হল ভয়ানক যুদ্ধ। মধ্যাহ্নে পুনরায় বিজয় লক্ষ্মী যখন রাজা জয়পালের করতলগত এবং ভীত সন্ত্রস্ত সুলতান সাবুক্তিগীন যখন মনে মনে আসন্ন পরাজয়ের প্রমাদ গুনছেন ঠিক এহেন সময়েই গতরাতের তীব্র বিষক্রিয়ায় প্রভাব দেখা দিল মহারাজ জয়পালের হাতির শরীরে। তীব্র বিষের প্রভাবে মহারাজের রণহস্তী উন্মাদ হয়ে নিজের বাহিনীর সেনাদেরই পদদলিত করে, মহারাজ জয়পাল এবং তাঁর মাহুতকে পিঠে নিয়েই গগনভেদী বৃংহণধ্বনি করে পশ্চাৎপ্রান্তে দৌড় শুরু করলো। মহারাজকে নিয়ে তাঁর হাতিকে যুদ্ধভূমি ত্যাগ করে পলায়ন করতে দেখে রাজার অবশিষ্ট সেনারাও নিজেদের পরাজয় হয়েছে ভ্রম করে বিজয় লক্ষ্মীকে মাঠেই ফেলে রেখে ছত্রভঙ্গ হয়ে যুদ্ধভূমি ত্যাগ করে পলায়ন করলো। এদিকে সুযোগের সদবহার করে সুলতান সাবুক্তিগীনের বাহিনী আল্লাহু আকবর ধ্বনিতে চতুর্দিক বিদীর্ণ করে ধেয়ে এসে মহারাজ জয়পালের পলায়নরত বাহিনীকে ছিন্নভিন্ন করলো।

এহেন সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত শোচনীয় পরাজয়ের পর মহারাজ জয়পাল শারীরিক ও মানসিকভাবে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। এদিকে তুর্কি শিবিরেও রাজনৈতিক পালা পরিবর্তন দেখা দেয়। ৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে সুলতান সাবুক্তিগীনের মৃত্যুর পর ৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর সৎভাই ইসমাইলকে ষড়যন্ত্র করে হত্যা করে গজনীর সিংহাসনে আসীন হন আবুল কাশিম মামুদ ইবান সাবুক্তিগীন। যিনি ভারতীয় ইতিহাসের পাতায় কুখ্যাত হয়ে আছেন গজনীর সুলতান মামুদ হিসাবে।


রাজা জয়পালের জহরব্রত পালন
========================
গজনীর সুলতান হয়েই আবুল কাশিম মামুদ হিন্দু শাহী রাজবংশকে সমূলে উৎপাটিত করবার অভিপ্রায়ে মধ্যবয়স্ক ও ভগ্ন হৃদয় রাজা জয়পালকে পুনরায় আক্রমণ করে। সেই অপ্রত্যাশিত যুদ্ধে কোন রকম প্রতিরোধের পূর্বেই পরাজিত হন রাজা জয়পাল। এরপর পরাজিত জয়পালকে লৌহ শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে বন্দি অবস্থায় গজনীর দরবারে সুলতান মামুদের সম্মুখে পেশ করা হয়। বন্দি রাজা জয়পালের নিকট থেকে মুক্তিপণ হিসাবে মোটা অঙ্কের ধনরত্ন আদায় করে ভরা দরবারে নিজের আমীর-ওমরাহদের সম্মুখে তীব্র অপমানিত করে শেষে তাঁকে মুক্তি প্রদান করে সুলতান মামুদ। নীরবে নিজের রাজধানিতে প্রত্যাবর্তন করেন ভগ্ন হৃদয় সম্রাট জয়পাল। এদিকে একের পর এক পরাজয়ের সাথে সাথে যবনদের শিবিরে নিজের চরম অপমানও তখন যেন শূলের ন্যায় বিদ্ধ হচ্ছে জয়পালের হৃদয়ে। সুলতান মামুদের সেই অপমানের জ্বালা সইতে না পেরে শেষে এক অগ্নিকুণ্ড প্রজ্বলিত করে চিতোরের বীরাঙ্গনা ললনাদের ন্যায় সেই অগ্নিকুণ্ডে আত্মাহুতি দিয়ে জহরব্রত পালন করেন অসহায় মহারাজ জয়পাল। রাজা জয়পালের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র আনন্দপাল হিন্দু শাহী রাজবংশের পরবর্তী শাসক হন। প্রাচীন আর মধ্যযুগীয় ভারতে পুরুষদের জহরব্রত পালনের ইতিহাসে, রাজা জয়পাল ছাড়া দিল্লির রাজপুত সম্রাট পৃথ্বীরাজ চৌহানের ভ্রাতা তথা আজমির অধিপতি হরিরাজ চৌহান তুর্কিদের অধিকার থেকে নিজের প্রয়াত জ্যৈষ্ঠ ভ্রাতার সাবেক রাজধানি দিল্লি পুনঃরদখল না করতে পেরে এইভাবেই ভগ্ন হৃদয়ে জহরব্রত পালন করেছিলেন।

রাজা আনন্দপালের যুদ্ধযাত্রা আর মামুদের ষড়যন্ত্র
=====================================
এরপর এই ঘটনার প্রতিশোধ নিতে ১০০৮ খ্রিষ্টাব্দে মামুদ পুনরায় পাঞ্জাব আক্রমণ করে। রাজা আনন্দপাল নিজের প্রয়াত পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে ইউরোপের ফ্রান্সের খ্রিষ্টান রাজার ন্যায় মূল ভারতীয় ভূখণ্ডের বিভিন্ন রাজাদের আসন্ন ধর্ম যুদ্ধের জন্য সহায়তা চেয়ে দূত প্রেরণ করলেন। এবারেও গোয়ালিয়র, উজ্জ্বয়িনী, কালিঞ্জর, কনৌজ এবং দিল্লি একত্রিত হয়ে ক্রুসেড যুদ্ধের ন্যায় একটি সংযুক্ত বাহিনী গঠন করে রাজা আনন্দপালের রাজ্য পাঞ্জাবের দিকে অগ্রসর হল। এই মিলিত বাহিনী ওয়াহিন্দ নামক একটি স্থানে শিবির স্থাপন করলো এবং কোন অজ্ঞাত কারণে সেখানেই ৪০ দিন অবস্থান করলো। বিভিন্ন সমসাময়িক ঐতিহাসিকদের মতে সেই ধর্ম যুদ্ধের ব্যয় নির্বাহের জন্য বিভিন্ন রাজ্যের হিন্দু নারীরা হাসিমুখে তাঁদের যাবতীয় স্বর্ণলঙ্কার সমূহ দান করে দিয়েছিলেন। দূত মুখে হিন্দুস্থানের কাফের রাজাদের বিশাল মিলিত বাহিনীর সংবাদ শ্রবণ করে মামুদ মনে মনে প্রমাদ গুনলেন।

দিন কয়েক পরে যুদ্ধ শুরু হল। একদিকে রাজা আনন্দপালের নেতৃত্বাধিন হিন্দু বাহিনী তিরন্দাজ, অশ্বারোহী, গজ বাহিনী আর পদাতিক সেনা এই চতুরঙ্গে বিভক্ত ছিল, অপরদিকে মামুদের তুর্কি বাহিনী তিরন্দাজ, অশ্বারোহী আর পদাতিক এই তিন ভাগে বিভক্ত ছিল। যুদ্ধের শুরুতে মামুদ তার তিরন্দাজদের উস্কানিমূলক তির নিক্ষেপ করবার নির্দেশ দিল। প্রত্যুত্তরে আনন্দপালের তিরন্দাজরাও তির নিক্ষেপ শুরু করলো। অগণিত তিরের শরশয্যায় অম্বর আচ্ছাদিত হয়ে পড়ল। মুসলিম ঐতিহাসিক ফিরিস্তার মতে প্রথম দুদিন ঘোরতর যুদ্ধ চলবার পর প্রায় ১৫,০০০ মুসলিম তুর্কি সেনা নিহত হল এবং কাফেররা পুনরায় প্রায় জয়ের মুখে চলে গেল। যুদ্ধক্ষেত্রে এক দৈত্যাকার রণহস্তীর পৃষ্ঠে আসীন হয়ে ভল্ল হস্তে যুদ্ধ পরিচালনা করা মহারাজ আনন্দপালকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন স্বয়ং নটরাজ মর্ত্যে অবতীর্ণ হয়েছেন পাপিদের শাস্তি প্রদান করবার জন্য। নিজের বাহিনীর এই দুর্দশা দেখে হতোদ্যাম মামুদ তার শত্রুকে ছলনার সাহায্যে পরাজিত ও নিহত করবার জন্য একটি পরিকল্পনা রচিত করলেন। নিজের দূত মারফৎ রাজা আনন্দপালকে সন্ধি চুক্তির জন্য অনুরোধ করে পত্র প্রেরণ করলেন মামুদ। পুনরায় নিজের পিতা জয়পালের মতো তুর্কিদের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে বিজয় লক্ষ্মী যুদ্ধভূমিতেই ফেলে দিয়ে সেই অনুরোধ রক্ষা করতে রাজি হয়ে সম্মতি দান করে চরম মূর্খতার পরিচয় দিলেন আনন্দপাল। নিজের সেনাপতি এবং সহকারি বাহিনীর সর্দারদের উপদেশ অগ্রাহ্য করে স্বল্প কিছু দেহরক্ষী নিয়ে মামুদ আর নিজের শিবিরের মধ্যবর্তী জায়গায় একটি অপেক্ষাকৃত নির্জন স্থানে সন্ধি আলোচনার জন্য উপস্থিত হলেন রাজা আনন্দপাল।

কিন্তু সেখানে গজনীর সুলতান মামুদকে দেখতে পেলেন না রাজা আনন্দপাল। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবার পর আচমকা তাঁর এক দেহরক্ষী এসে জানালো যে সন্ধি আলোচনার প্রস্তাব আসলে সংযুক্ত বাহিনীর মূল নেতা আনন্দপালকে হত্যা করবার জন্য শয়তান যবন আমীর মামুদের এক ধূর্ত পরিকল্পনা। দেহরক্ষীর মুখে মামুদের পরিকল্পনা সম্বন্ধে অবগত হয়ে রাজা আনন্দপাল নিজের শিবিরে পলায়নের উদ্যোগ করতেই তাঁদের চতুর্দিক থেকে বেষ্টিত করলো বিশাল তুর্কি ঘাতক বাহিনী। যুদ্ধের নামে কিছুক্ষণ অসম প্রহসন চলবার পর এক তুর্কি সেনাপতি রাজা আনন্দপালকে নিহত করে, নিজের তরবারি দিয়ে নিহত রাজার শিরচ্ছেদ করে হতভাগ্য রাজার রুধির মিশ্রিত কর্তিত মুণ্ডুটি নিজের ভল্লের সুতীক্ষ্ণ ফলায় বিদ্ধ করে সেটি পেশ করলো সুলতান মামুদের পদতলে। এরপর মামুদ পৈশাচিক উল্লাসে রাজা আনন্দপালের কর্তিত মুণ্ডুটি যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ে গিয়ে শত্রুপক্ষের বাহিনীর সামনে দম্ভের সাথে উত্তোলন করলেন। নিহত রাজার রক্তমাখা কর্তিত মুণ্ডু দর্শন করে মুহূর্তের মধ্যে ভীত সন্ত্রস্ত হিন্দু বাহিনী বিপর্যস্ত ও ছত্রভঙ্গ হয়ে পলায়ন করলো। দুর্নিবার ও বাধাহীন হয়ে উঠল তুর্কি দস্যুদের তরবারি।


রাজা ত্রিলোচনপালের প্রতিরোধ
=======================
রাজা আনন্দপালের প্রয়ানের পর হিন্দু শাহী রাজবংশের নতুন শাসক হলেন ত্রিলোচনপাল। পিতার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেবার আশায় তিনি পুনরায় সংগঠিত করতে লাগলেন নিজের বাহিনী। কালহানের রাজতরঙ্গিণীর বর্ণনা অনুযায়ী হতভাগ্য রাজা ত্রিলোচনপালকে সাহায্য করবার জন্য এগিয়ে এলেন কাশ্মীরের প্রয়াত মহারানি দিদ্দার ভ্রাতুস্পুত্র তুঙ্গা। রানি দিদ্দার মৃত্যুর পর তুঙ্গা তখন কাশ্মীর নরেশ আর প্রধান সেনাপতিও। রাজতরঙ্গিণীর বর্ণনা অনুযায়ী রাজা ত্রিলোচনপালের বার্তা পেয়েই ১০১৩ খ্রিষ্টাব্দে যবন তুর্কিদের বিরুদ্ধে যারপরনাই রুষ্ট তুঙ্গা এক বিশাল সেনা বাহিনী সমেত উধাভাণ্ডাপুরের দিকে ধাবিত হলেন। কাশ্মীরি বাহিনী তোশি নদী অতিক্রম করে সেই নদীর অপরপ্রান্তে অবস্থিত মামুদের একটি তুর্কি শিবিরে হামলা চালালেন। কিছুক্ষণ ভয়ানক যুদ্ধের পর তুঙ্গার রোষানলে খড়কুটোর মতো উড়ে গেলো তুর্কি বাহিনী। তুর্কিদের পরাজিত করে তাদের শিবির উচ্ছেদ করে মহারাজ ত্রিলোচনপালের বাহিনীর শিবিরের উদ্দেশ্যে পুনরায় যাত্রা শুরু করলেন তুঙ্গা। এদিকে কাশ্মীর নরেশ তুঙ্গার আগমনী বার্তা শ্রবণ করে শাহী মহারাজ ত্রিলোচনপালও তাঁর মিত্রর সাথে মিলিত হবার জন্য নিজের সেনা সমেত তুঙ্গার বাহিনীর দিকে যাত্রা শুরু করলেন।

এদিকে রুক্ষ পার্বত্য অঞ্চলে ধূর্ত তুর্কি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকা কাশ্মীর রাজ তুঙ্গাকে মামুদের বাহিনীর বিরুদ্ধে সাবধান করবার জন্য রাজা ত্রিলোচনপাল আগেভাগেই নিজের এক দূতকে প্রেরণ করলেন। সেই দূতের পত্রে রাজা তুঙ্গার উদ্দেশ্যে লেখা ছিল, তুর্কি বাহিনী অত্যন্ত ধূর্ত। সরাসরি যুদ্ধের পরিবর্তে ছল-কপটতার আশ্রয় গ্রহণ করে শত্রু বাহিনীকে মূর্খ বানিয়ে পরাজিত করা তাদের একটি অত্যন্ত পরিচিত চাল। রাতের আধার নামলে তুঙ্গা এবং তাঁর বাহিনী যেন কোনমতেই কোন উন্মুক্ত প্রান্তরে শিবির স্থাপন না করেন। কোন বিশাল পাহাড়ি গুহার অভ্যন্তরে বা বিশাল পাহাড়ি প্রস্তরখণ্ডের আড়ালে যেন তাঁদের শিবির স্থাপন করেন। এদিকে তুর্কি দস্যুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের উন্মাদনায় তুঙ্গা এবং তাঁর বাহিনী দ্রুতগতিতে অনেকদূর পর্যন্ত অগ্রসর হয়ে এমন একটি স্থানে পৌঁছেছিলেন যে সেখানে বেশ কিছুটা জায়গা জুড়ে উন্মুক্ত প্রান্তর। আরও কিছুটা দূরে পাহাড়ি ঢাল ছিল বটে কিন্তু অতদূরে ভ্রমণ করবার জন্য তেমন কোন আগ্রহ প্রকাশ করলেন না মহারাজ তুঙ্গা। তিনি রাজা ত্রিলোচনপালের যাবতীয় নিষেধাজ্ঞা উড়িয়ে দিয়ে সেখানেই শিবির স্থাপন করলেন। ফল যা হবার তাই হল। গভীর রাতে আচমকা দূরের পাহাড়ি ঢাল বেয়ে নিঃশব্দে গুপ্ত ঘাতকের ন্যায় তুঙ্গার শিবিরের সম্মুখে এসে উপস্থিত হল কাতারে কাতারে তুর্কি সেনা।

নিদ্রা ভগ্ন হবার পূর্বেই আচমকা তুঙ্গার শিবিরে ভয়ানক হামলা চালাল তুর্কি বাহিনী। পরেরদিন অনেকবেলা পর্যন্ত যুদ্ধ চলল। দিনের শেষে দেখা গেল কাশ্মীর রাজ তুঙ্গার বিশাল বাহিনীর অধিকাংশ সেনাই নিহত আর তুঙ্গা নিজের গুরুতর আহত। তুর্কিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পরাজিত আর আহত হয়ে হতাশ তুঙ্গা যখন পলায়ন করবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন ঠিক সেই সময়ই রাজা ত্রিলোচনপাল তাঁর বাহিনী নিয়ে অকুস্থলে উপস্থিত হলেন। কিন্তু বিশাল তুর্কি সেনা সমুদ্রের সম্মুখে নিজের ক্ষুদ্র বাহিনী নিয়ে এঁটে উঠতে পারলেন না রাজা ত্রিলোচনপাল। পরাজয় আসন্ন উপলব্ধি করেও কাপুরুষ তুঙ্গার মতো যুদ্ধভূমি ছেড়ে পলায়ন করলেন না রাজা ত্রিলোচনপাল। তিনি তাঁর তিন বিশ্বস্ত সেনাপতি জয়সিংহ, শ্রীবর্ধন আর বিভ্রমার্ককে নিয়ে সিংহ বিক্রমে যুদ্ধ করতে লাগলেন।

রাজতরঙ্গিণীর বর্ণনা অনুযায়ী, "কিছুক্ষণের মধ্যেই হতভাগ্য শাহী রাজা এবং তাঁর সেনাপতিদের চতুর্দিক থেকে বেষ্টিত করলো বিশাল তুর্কি সেনা। জয়ের গন্ধ পেয়ে এক পৈশাচিক উল্লাসে মত্ত হল বিধর্মী যবন সেনারা। তারা একযোগে আক্রমণ করলো রাজা ত্রিলোচনপালকে। বিজাতীয় ম্লেচ্ছ তুর্কি বাহিনীর নাগপাশে বন্দি মহারাজ ত্রিলোচনপাল নিজের মৃত্যুকাল আসন্ন জেনেও বিন্দুমাত্র টললেন না, চিড় ধরলো না তাঁর অটল সঙ্কল্পে। স্বধর্ম আর মাতৃভূমির রক্ষার্থে মুষ্টিমেয় কিছু অঙ্গরক্ষক সমেত এক সিংহ হৃদয় মহাবীরের ন্যায় সুবিশাল তুর্কি ঘাতক বাহিনীর বিরুদ্ধে অসি হাতে অসম যুদ্ধ করতে লাগলেন মহারাজ ত্রিলোচনপাল। দেখতে দেখতে তুর্কি জল্লাদদের তির, তরবারি আর ভল্লের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত ও রক্তাক্ত হয়ে উঠল রাজার নশ্বর শরীর। দিনান্তে গোধূলি লগ্নের যুদ্ধভূমিতে সূর্যের রক্তিম আভার সাথে মিশ্রিত রক্তে রাঙা মহারাজ ত্রিলোচনপালকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন স্বয়ং মহাদেব নিজের বাসস্থান কৈলাস পর্বত ত্যাগ করে নেমে এসেছেন পবিত্র ভারতবর্ষের ধরাধামে, বিধর্মী ম্লেচ্ছদের পাপের শাস্তি দিতে।"
এরপর এক ক্ষত্রিয় বীরের ন্যায় মাতৃভূমির সম্মান রক্ষায় যুদ্ধ করতে করতেই নিজের প্রান বিসর্জন দিলেন মহারাজ ত্রিলোচনপাল। রাজার মৃত্যুর পর শাহী রাজ্যের অবশিষ্ট জীবিত সেনারা পলায়ন করে আশ্রয় গ্রহণ করলেন নিকটবর্তী হস্তীকা রাজ্যে।

এরপর শাহী রাজবংশের পরবর্তী রাজা হলেন ভীমপাল। তিনি তুর্কি আগ্রাসন থেকে নিজের প্রজাদের রক্ষা করবার জন্য নিজের রাজ্যের রাজধানি সরিয়ে আনলেন লখোট নগরীতে (লাহোর)। কিন্তু শাহী রাজবংশে একেবারে ধ্বংস করবার বাসনায় মামুদ পুনরায় ১০১৫ খ্রিষ্টাব্দে রাজা ভীমপালকে আক্রমণ করলেন। কিন্তু এবারে ভীমপাল নিজের পূর্বসূরিদের ন্যায় উন্মুক্ত প্রান্তরে যুদ্ধ না করে নিজের দুর্গের অভ্যন্তরে থেকেই তুর্কি আগ্রাসনের মোকাবিলা করলেন। টানা ১৫ দিন ধরে কেল্লা অবরোধ করেও কিছুই করতে পারলেন না সুলতান মামুদ। উল্টে ভীমপালের দক্ষ তীরন্দাজদের নিক্ষিপ্ত তিরের আঘাতে নিহত হল অগণিত তুর্কি সেনা। শেষপর্যন্ত পরাজয় স্বীকার করে বিফল মনোরথে গজনী প্রত্যাবর্তন করলেন মামুদ। তুর্কি সুলতানের এই পরাজয়ের কাহিনী তাঁর মুসলিম ঐতিহাসিকগণ অত্যন্ত চতুরতার সাহায্যে এড়িয়ে যান। এই যুদ্ধের কিছুকাল পরে সামান্য কিছু দেহরক্ষী সমেত থানেশ্বরের তীর্থক্ষেত্রে ভ্রমণকালে মহারাজ ভীমপাল এবং তাঁর কিশোর যুবরাজকে কাপুরুষের ন্যায় হত্যা করে হিন্দু সাধুর ছদ্মবেশ ধারণকারী মামুদের তুর্কি গুপ্তঘাতকরা। মহারাজ ভীমপাল এবং তাঁর পুত্রের মৃত্যুর সাথে সাথেই যবনিকাপাত হয় আফগানিস্থানের শতাব্দী প্রাচীন হিন্দু শাহী রাজবংশের। এইভাবেই শাহী রাজবংশ দীর্ঘকাল সুলতান সাবুক্তিগীন এবং সুলতান মামুদের তুর্কি আগ্রাসন থেকে রক্ষা করে এসেছে মূল ভারতীয় ভূখণ্ডকে।

পরবর্তীকালে সুলতান মামুদকে পুনরায় পরাজয়ের সম্মুখীন হতে হয় জেজাকভুক্তি রাজবংশের শাসক চান্দেল রাজ তথা খাজুরাহো মন্দিররাজির নির্মাতা সম্রাট বিদ্যাধর চান্দেল এবং মালবের পারমার রাজ ভোজদেব পারমারের নিকটে। পরপর দুবার আক্রমণ করেও সম্রাট বিদ্যাধর চান্দেলকে পরাজিত করা তো দুরস্থান উল্টে নিজেই পরাজিত হয়ে কাপুরুষের ন্যায় পশ্চাৎপশরন করতে বাধ্য হয়েছিলেন গজনীর সুলতান মামুদ। ১০২৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রভাসপট্টনের সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন আর ধ্বংস করে গজনী প্রত্যাবর্তনের সময় আচমকা মালব রাজ ভোজদেব পারমারের নেতৃত্বাধিন এক বিশাল বাহিনী আক্রমণ করে মামুদের কাফিলা। পরাজয় অবশ্যম্ভাবী উপলব্ধি করতে পেরে মামুদ নিজের বাহিনীকে দুই ভাগে বিভক্ত করে সোমনাথের জ্যোতিরলিঙ্গ সহ বিশাল রত্নরাজী নিয়ে নিজে একটি কাফিলা নিয়ে পিঠটান দেন গজনীর উদ্দেশ্যে আর আরেকটি তুর্কি বাহিনী থেকে যায় মালবরাজের আক্রমণের প্রতিরোধ করবার জন্য। পরে সেই যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয় গজনীর তুর্কি বাহিনী। যুদ্ধে নির্ণায়ক জয়লাভ করেও সোমনাথের হারানো রত্নরাজী আর জ্যোতিরলিঙ্গ উদ্ধার করতে অসফল হন মহারাজ ভোজদেব পারমার। এছাড়াও ১০০১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১০২৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত টানা ১৭ বার ভারতে হামলা চালিয়েও মহম্মদ ঘোরীর ন্যায় ভারতবর্ষে ইসলামিক শাসন স্থাপন করতে চূড়ান্ত ব্যর্থ হয়েছিলেম মামুদ মূলত ভোজদেব পারমার, গুজরাটের চালুক্য-প্রতিহার, কনৌজের গুজ্জর-প্রতিহার এবং দিল্লি-আজমিরের চৌহান রাজপুত রাজবংশের বীর রাজাদের শৌর্য আর পরাক্রমের ফলেই। এইসব ভারতীয় রাজাদের বীরত্বপূর্ণ প্রবল প্রতিরোধ মামুদকে দখলদার নয় কেবলমাত্র এক তুর্কি লুণ্ঠনকারীতে পরিণত করেছিলে। মামুদের আক্রমণগুলি আচমকা সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ভাবে হবার দরুন প্রাথমিকভাবে স্থানীয় রাজারা পরাজিত হলেও পরে তাঁদের প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়তে হয়েছিল মামুদকে। পরবর্তীকালের তুর্কি আগ্রাসনের সময় পূর্বে বর্ণিত দিল্লি-আজমিরের চৌহান রাজবংশের ভারতের মূল প্রতিরোধী শক্তি হিসাবে উত্থান হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় তাঁরাও তাঁদের পূর্বসূরি হিন্দু শাহী রাজবংশের রাজাদের ভুলত্রুটি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেননি।
(সমাপ্ত)
তথ্যসূত্রঃ
১)  The Grandeur of Gandhara: The Ancient Buddhist Civilization of the Swat, Peshawar, Kabul and Indus Valleys by  Rafi U. Samad (2011)
২) Last Two Dynasties of the Shahis by Abdur Rahman
৩) The History of India, as Told by Its Own Historians by H. M. Elliot and John Dowson
৪) Rajtarangini by Kalhana
৫) History of Mediaeval Hindu India by C. V. Vaidya
৬) The Hindu Shahis of Afghanistan and the Punjab AD 865-1026 by Yogendra Mishara
৭) Notes on Pre-Ghaznavid History of Eastern Afghanistan, Islamic Quarterly by C. E. Bosworth

Comments

Popular posts from this blog

বিষ কন্যা