আনিগোণ্ডির যুদ্ধ
=============
চৌদ্দ শতাব্দীর দাক্ষিণাত্যের পটভূমি
==========================
চৌদ্দ শতকের মধ্যযুগীয় ভারতবর্ষ তখন উত্তর-পশ্চিম প্রান্ত থেকে আগত বিজাতীয় স্মেচ্ছ তুর্কিদের পদানত। যবন দস্যু বাহিনীর পরাধীনতার শৃঙ্খল তখন আবদ্ধ করেছে সমগ্র মুলতান থেকে কান্যকুব্জ পর্যন্ত বিস্তীর্ণ উত্তরভারত আর গুজরাট থেকে ভূপাল পর্যন্ত সমগ্র মধ্যভারত। ১৩১০ সালের প্রথম ভাগ। দিল্লির তখতে তখন বর্বর আলাউদ্দিন খিলজির শাসনকাল। খিলজির পাশবিক শক্তির সম্মুখে পদানত গুজরাট আর মেবার সহ সমগ্র আর্যবর্ত্ম। একাদশীর পলতের ন্যায় জালোর নরেশ কানহাড়দেব চৌহান একাকী অসম যুদ্ধ করে চলেছেন স্মেচ্ছ তুর্কি বাহিনীর বিরুদ্ধে। তুর্কিদের নিকট উত্তর আর মধ্যভারতে লুণ্ঠন আর ধ্বংস যোগ্য আর কোন সমৃদ্ধশালী সনাতন ধর্মাবলম্বী রাজ্যের অস্তিত্ব না থাকায় এবারে আলাউদ্দিনের কুনজর পড়লো দাক্ষিণাত্যের দ্রাবিড় ভূমির উপর। স্মেচ্ছ দস্যু বাহিনীর আঁচ তখনও স্পর্শ করেনি দাক্ষিণাত্যকে। তাই ধনধান্যে সুহাংগীতা দাক্ষিণাত্য তখনও প্রাচীনকালের আর্যবর্ত্মের ন্যায় এক সমৃদ্ধশালী ভূমি। ১৩১০ সালে খিলজির বিশ্বস্ত সেনাপতি মালিক কাফুর প্রথমে দাক্ষিণাত্যের প্রবেশ ভূমি দেবগিরি রাজ্য আক্রমন করে তছনছ আর ছারখার করে একে একে কাকাতিয়া, হোয়শালা, পাণ্ড্য আর কাম্পিলি রাজ্য ধ্বংস করে, মীনাক্ষী আম্মান মন্দির, বেলুরের মন্দির, হোয়শালেশ্বর মন্দির সহ অগনিত মন্দির ধ্বংস আর লুণ্ঠন করে সর্বপ্রথম দাক্ষিণাত্যের দ্রাবিড় ভূমিতে তুর্কিদের প্রভুত্ব বিস্তার করলো। এরপর আলাউদ্দিনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে মহম্মদ বিন তুঘলকও দাক্ষিণাত্য আক্রমন করলো। ১৩৩০ সালের মধ্যভাগে দেখা গেল তুর্কি তাণ্ডবের সম্মুখে শুধুমাত্র হোয়শালা নরেশ তৃতীয় বীর বল্লাল ব্যাতিত দাক্ষিণাত্যের অবশিষ্ট হিন্দু রাজাদের পতন হয়েছে। আর্যবর্ত্মের ন্যায় দাক্ষিণাত্যেও কেরল, মহারাষ্ট্র, অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্ণাটক, মাদুরাই আর তামিলনাড়ু সহ বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বিজাতীয় তুর্কিদের ইসলামিক সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণ হয়েছে।
হাক্কা-বুক্কার উত্থান আর রাজা বীর বল্লালের প্রতিরোধ
=====================================
তখন ১৩৪২ সাল। পারস্য আর খোরাসানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছে দিল্লির সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলকের বাহিনী। যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে তীব্র অর্থ সঙ্কটে জর্জরিত হয়ে পড়েছে সুলতানের বিশাল তুর্কি বাহিনী। চতুর্দিকে তখন সুলতানের অত্যাচারী নীতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন তার নিজেরই আমির-ওমরাহরা। এই সুযোগের সম্পূর্ণ সদবহার করে তুর্কি সুলতানের বিরুদ্ধে সরাসরি বিদ্রোহ ঘোষণা করে সাবেক কাম্পিলি রাজ্যের রাজধানি হাম্পি নগরীতে স্বাধীন হিন্দু রাজ্য বিজয়নগর স্থাপন করলেন হরিহর আর বুক্কা রায় নামের দুই বীর হিন্দু ভ্রাতা। বিজয়নগর রাজ্য স্থাপনে তাঁদের যোগ্য সহায়তা প্রদান করলেন হোয়শালা রাজ্যের প্রবীণ শাসক মহারাজ তৃতীয় বীর বল্লাল। এদিকে মাদুরাইয়ে অবস্থিত সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলকের অন্যতম প্রধান সেনাধ্যক্ষ জালালউদ্দিন এহসান খানও দিল্লির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে মাদুরাইয়ে এক স্বাধীন তুর্কি সুলতানত স্থাপন করেছিলেন। জালালউদ্দিন এহসান খান মাদুরাইয়ের প্রথম তুর্কি সুলতান হিসাবে অভিষিক্ত হয়েই সিদ্ধান্ত নিলেন প্রসিদ্ধ মীনাক্ষী আম্মান মন্দির সম্পূর্ণ রূপে ধস্ত করে মন্দিরের মালমশলা দিয়ে মক্কা মসজিদ স্থাপন করবেন।
মহারাজ বীর বল্লাল মাদুরাইয়ের তুর্কি সুলতানের এই বাসনার সংবাদ পেয়েই মীনাক্ষী আম্মান মন্দির রক্ষা করবার জন্য মাদুরাইয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। এক যুদ্ধে যখন মহারাজ বীর বল্লালের বিজয় শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা তখন মাদুরাইয়ের ভীত ও সন্ত্রস্ত্র সুলতান তাঁকে শান্তি আলোচনার প্রস্তাব প্রেরন করলেন। যথাসময়ে দুই পক্ষের মধ্যে শুরু হলো শান্তি আলোচনা। কিন্তু তখনও মহারাজ বীর বল্লাল সম্পূর্ণ রূপে অজ্ঞাত ছিলেন সুলতান জালালউদ্দিনের আসল অভিপ্রায় সম্বন্ধে। আলোচনার নামে প্রহসন চলাকালীন ছদ্মবেশী তুর্কি ঘাতক বাহিনী আচমকা কাপুরুষোচিত হামলা চালালো নিরস্ত্র মহারাজ বীর বল্লাল আর তাঁর অঙ্গ রক্ষকদের উপর। সেই প্রাণঘাতী হামলায় বীরগতি প্রাপ্ত হলেন মহারাজ বীর বল্লাল।
আনিগণ্ডির যুদ্ধের প্রেক্ষাপট
====================
কাপুরুষ তুর্কি ঘাতক বাহিনীর হাতে নিজের পিতৃসম মহারাজ বীর বল্লালের অকাল প্রয়ানের সংবাদ শ্রবণ করে যারপরনাই ক্রুদ্ধ হলেন বিজয়নগরের রাজা হরিহর রায় (হাক্কা)। তিনি মাদুরাইয়ের সুলতানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে নিজের বাহিনী নিয়ে মাদুরাই নগরীর দিকে ধাবিত হলেন। এদিকে এরকম কিছু ঘটতে পারে সেটা পূর্বেই অনুমান করে মাদুরাইয়ের সুলতান জালালউদ্দিন এহসান খান তার পূর্ববর্তী প্রভু দিল্লির সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলকের নিকট সেনা সহায়তা চেয়ে পত্র প্রেরন করেছিলেন। শুধুমাত্র দাক্ষিণাত্যের বুকে ইসলামের বিজয়যাত্রা অক্ষুণ্ণ রাখবার জন্য নিজের বিদ্রোহী আমিরের সাহায্যের আর্তিতে সাড়া দিয়ে এক বিশাল তুর্কি সেনা প্রেরন করলেন মহম্মদ বিন তুঘলক। পারস্য ঐতিহাসিক ফরিস্তার লেখনী অনুযায়ী দিল্লি আর মাদুরাইয়ের সংযুক্ত বাহিনীর সংখ্যা ছিল আনুমানিক ৬০ থেকে ৮০ হাজার। অপরদিকে বিজয়নগরের সেনাবাহিনীর সংখ্যা ছিল মাত্র ১৫ থেকে ২০ হাজার। রণকুশলী রাজা হরিহর রায় আর তাঁর ভ্রাতা তথা প্রধান সেনাপতি বুক্কা রায় বুঝতে পারলেন যে সম্মুখ সমরে সুবিশাল বিজাতীয় তুর্কি বাহিনীকে পরাজিত করা অসম্ভব। এমনকি এই মুহূর্তে গেরিলা যুদ্ধেও জয়লাভের ব্যপারে কোন নিশ্চয়তা নেই। এদিকে মাদুরাইয়ের সুলতান জালালউদ্দিন পত্র মারফৎ দিল্লির সুলতানকে জানালেন গেরিলা যুদ্ধে বিজয়নগরের মহারাজ আর সেনাপতি হাক্কা-বুক্কার অসাধারন পারদর্শিতার কথা। জালালউদ্দিনের পত্র পাঠ করে সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলক, ঘন অরণ্য আর পশ্চিমঘাট পর্বতে আচ্ছাদিত দাক্ষিণাত্যের আদিম পরিবেশের কথা চিন্তা করে কিছুটা শঙ্কিত হয়ে পড়লেন। তিনি তার বাহিনীকে একসাথে দাক্ষিণাত্যের ভূমিতে প্রেরন করলেন না। সম্পূর্ণ বাহিনীকে বেশ কয়েকটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিভাগে বিভক্ত করে প্রেরন করতে লাগলেন। এদিকে পশ্চিমঘাটের অরন্য প্রান্তরে দিল্লির তুর্কি বাহিনীর বিরুদ্ধে দুএকটি গেরিলা যুদ্ধ সম্পন্ন করেই চতুর রাজা হরিহর রায় উপলব্ধি করতে পারলেন যে এরা দিল্লির মূল তুর্কি বাহিনী নয়। বিজয়নগরের বাহিনীকে ধিরে ধিরে পর্যুদস্ত ও পরিশ্রান্ত করবার অভিপ্রায়ে সুলতান এদের প্রেরন করেছেন। দিল্লির মূল বাহিনী আর কিছুকালের মধ্যেই দাক্ষিণাত্যের ভূমিতে পদার্পণ করবে। দিল্লির তুর্কি সুলতানের এই রণনীতি উপলব্ধি করতে পেরে রনে ভঙ্গ দিয়ে হাম্পি নগর পরিত্যাক্ত করে বিজয়নগরের বাহিনীকে বেশ কয়েকটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিভাগে বিভক্ত করে মেষপালকের ছদ্মবেশ ধারন করে ঘন অরন্যে আচ্ছাদিত দুর্গম আনিগণ্ডি পর্বতে গাঢাকা দিলেন রাজা হরিহর আর সেনাপতি বুক্কা রায়।
বৈদিক কিংবদন্তী অনুসারে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে রয়েছে এই আনিগণ্ডি পর্বত। রামায়নের কাহিনী অনুসারে এখানেই একদা অবস্থিত ছিল বানররাজ বালি আর তাঁর ভ্রাতা সুগ্রীবের রাজ্য কিষ্কিন্ধ্যা। দুর্গম আনিগণ্ডি পর্বতে ঘন অরন্যের মধ্যে ছিল সীতা সরোবর, রামপদ, বালি ভাণ্ডার আর সুগ্রীবের গুহা। লঙ্কা অভিযানের সময় এখানই কিছুকালের জন্য আশ্রয় গ্রহন করেছিলেন অযোধ্যা নরেশ শ্রী রামচন্দ্র। ১৩৪২ সালে এই আনিগণ্ডি পর্বত প্রান্তেই আশ্রয় গ্রহন করলেন বিজয়নগরের প্রতাপশালী মহারাজ হরিহর আর তাঁর সেনাপতি বুক্কা রায়। অপরদিকে বিনাযুদ্ধে বিজয়নগরের রাজার পলায়নের সংবাদ শুনে প্রথমে বিশ্বাস না করলেও পরে নিজের বিশ্বস্ত গুপ্তচর মারফৎ হাক্কা আর বুক্কার অন্তর্ধানের সংবাদ শুনে একদিকে যেমন আশ্বস্ত হলেন দিল্লির তুর্কি সেনাপতি হামজা খান, তেমনি অপরদিকে হাক্কা-বুক্কার কাপুরুষোচিত পলায়নের সংবাদ শুনে প্রবল ঔদ্ধত্যে বিজয়নগর আক্রমণের নির্দেশ দিলেন তিনি।
হামজা খানের নির্দেশে বিভিন্ন খণ্ডে বিভক্ত দিল্লি আর মাদুরাইয়ের তুর্কি বাহিনী পুনরায় একত্রিত হয়ে বিজয়নগরের রাজধানি হাম্পির দিকে অগ্রসর হলেন। পথে পূর্ববর্তী হোয়শালা রাজ্যের অন্তর্গত বহু সুপ্রাচীন হিন্দু মন্দির লুণ্ঠন আর ধ্বংস করলেন, বহু নিরীহ আর নিরস্ত্র অসহায় নাগরিকদের নির্মমভাবে হত্যা করলেন। একসময়ে হাম্পি নগরে অনুপ্রবেশ করে ভয়াবহ তাণ্ডব প্রদর্শন করলো দিল্লির তুর্কি বাহিনী। হামজা খান আর মাদুরাইয়ের সুলতান জালালউদ্দিন এহসান খান ভেবেছিলেন যে নিজের রাজ্য আর রাজধানিতে তুর্কি বাহিনীর তাণ্ডবের সংবাদ লাভ করে উত্তেজিত হয়ে নিজেদের গুপ্তস্থল থেকে আত্মপ্রকাশ করে দিল্লির বাহিনীর উপর আক্রমন শানাবেন হাক্কা আর বুক্কা। আর সেই সুযোগে নব্য গঠিত হিন্দু রাজ্য বিজয়নগরের ক্ষুদ্র বাহিনীকে ধ্বংস করবে দিল্লির বাহিনী। কিন্তু তাদের সেই প্রচেষ্টায় জল ঢেলে নিজেদের গুপ্তস্থল থেকে আত্মপ্রকাশ করলেন না হাক্কা আর বুক্কা। আনিগণ্ডির দুর্গম কিষ্কিন্ধ্যা পাহাড়ে নিজেদের গুপ্ত শিবিরে বসে প্রতিনিয়ত গুপ্তচরের নিকটে বিজয়নগরের উপর তুর্কি বাহিনীর পাশবিক আর বর্বর আক্রমণের সংবাদ শুনতেন হাক্কা আর বুক্কা আর নিজেদের বিক্ষিপ্ত মন শান্ত রেখে ধীরস্থির ভাবে অপেক্ষা করতেন স্মেচ্ছ বিজাতীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে উপযুক্ত প্রতিশোধ গ্রহণের সঠিক সময়ের জন্য।
এদিকে তুর্কি বাহিনী বিজয়নগরের অধিকাংশ এলাকা সহ রাজধানি হাম্পি নগর লুণ্ঠন আর অধিকার করে বিজয়নগরের পলাতক রাজা আর সেনাপতির গুপ্তস্থানের সুলুক লাভের জন্য বিজয়নগরের কাফের অধিবাসীদের উপর নির্মম অত্যাচার শুরু করলো। অত্যাচারের সাথে সাথে চললো নানা রকমের প্রলোভন প্রদর্শনও। কিন্তু তাতে বিশেষ লাভ হলো না কিছুই। দাক্ষিণাত্যের মুক্তিদূত হাক্কা আর বুক্কার গুপ্তস্থানের সন্ধান তুর্কিদের কাছে পৌঁছে দিলো না কেউই। অপরদিকে কিষ্কিন্ধ্যা পর্বতে আত্মগোপনকারী হাক্কা আর বুক্কা তাঁদের গুপ্তচরদের মারফতে বিজয়নগরের চতুর্দিকে রটিয়ে দিলো এক মিথ্যে সংবাদ। সেই সংবাদ ছিল অনেকটা এরকম। জনমানব বিচ্ছিন্ন নিজেদের দুর্গম গুপ্তস্থানে বসবাসের সময় অভুক্ত আর অপুষ্টিতে ভোগা হাক্কা আর বুক্কা এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মারা পড়েছেন। তাঁদের স্বপ্নের হিন্দু স্বরাজ্য বিজয়নগর এখন সম্পূর্ণ অবিভাবকহীন। ক্রমে সেই সংবাদ এসে পৌঁছল তুর্কিদের কানেও। ইতিমধ্যেই অতিবাহিত হয়েছে প্রায় ৭-৮ মাস। যুদ্ধ তো দূরবর্তী স্থান এমনকি সামান্যতম প্রতিরোধও দেখা যায়নি বিজয়নগরের বাহিনীর তরফে। অতএব হাক্কা-বুক্কার মৃত্যু সংবাদ ধীরে ধীরে সত্য বলে মনে হতে লাগলো তুর্কি সেনাধ্যক্ষ হামজা খানের নিকটে। হাক্কা-বুক্কার প্রয়ানের ফলে তুর্কি বাহিনীকে সম্পূর্ণ রূপে বিপদ মুক্ত ভ্রম করে, স্থানাভাবের কারনে নিজের বিশাল বাহিনী সমেত হাম্পি নগরের বাইরে আনিগণ্ডির নিকটে পর্বত আর অরন্যে ঘেরা কামাতিদুর্গা নামে এক নির্জন স্থানে তার নতুন শিবির স্থাপন করলেন হামজা খান।
আনিগণ্ডির যুদ্ধ আর হাক্কা-বুক্কার গৌরবগাথা
================================
এদিকে গুপ্তচরের মুখে নিজেদের গুপ্ত পরিকল্পনার সফল রুপায়নের সংবাদ লাভ করলেন মহারাজ হাক্কা। আনিগণ্ডির পাহাড়ে নিজের সেনা শিবিরে নিজ অসি কোষমুক্ত করে শূন্যে উত্থলিত করে মহারাজ হরিহর রায় তাঁর বাহিনীর উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন, “বন্ধুগণ দীর্ঘ অপেক্ষা, অত্যাচার আর অনাচার সইবার পর অবশেষে আজ সেই সঠিক সময় আর সুযোগ আমাদের সম্মুখে এসে উপস্থিত হয়েছে। বিজাতীয় স্মেচ্ছ তুর্কি বাহিনী আমার আর ভ্রাতা বুক্কা রায়ের মৃত্যু সংবাদ বিশ্বাস করে আমাদের ফাঁদে পা দিয়ে নিজেদের প্রহরায় শিথিল করেছে। মহাভারতের শিশুপালের ন্যায় পাপের ঘড়া পূর্ণ হয়েছে স্মেচ্ছ দস্যুদের। এখন সময় এসেছে তুর্কি বাহিনীর বিরুদ্ধে মোক্ষম আঘাত হেনে নিজেদের দুষ্কর্ম আর পাপের জন্য তাঁদের উপযুক্ত শাস্তি প্রদানের। আপনারা সবাই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হন। আগামিকাল রাতেই আমরা স্মেচ্ছ বাহিনীকে আক্রমন করবো। জয় সুন্দরেশ্বর”
সাথে সাথে বুক্কা রায় আর বিজয়নগরের সেনাবাহিনী তাঁদের অস্ত্র শূন্যে উত্থলিত করে সমশ্বরে গর্জন করে উঠলেন, “হর হর সুন্দরেশ্বর”।
নিজের বাহিনীকে তিন ভাগে বিভক্ত করলেন হরিহর রায়। একটি বাহিনীর নেতৃত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিলেন, দ্বিতীয় বাহিনীর নেতৃত্ব বুক্কা রায়ের অধীনে রইলো এবং তৃতীয় বাহিনীর নেতৃত্ব দেওয়া হলো দ্বিতীয় সেনাপতি কুমার কম্পন রায়কে। এই কম্পন রায় হাক্কা-বুক্কার তৃতীয় ভ্রাতা ছিলেন। গুপ্তচরের মারফৎ রাজা হাক্কা রায় পূর্বেই সংবাদ পেয়েছিলেন যে এই মুহূর্তে তুর্কি বাহিনীর প্রধান সেনাপতি হামজা খান তাঁর বিশিষ্ট দেহরক্ষী আর বাহিনী সমেত শিবির স্থাপন করেছেন নিকটবর্তী কামাতিদুর্গা নামে অরণ্য আচ্ছাদিত এক পর্বতের পাদদেশে। দিল্লির অবশিষ্ট বাহিনীও কামাতিদুর্গার নিকটবর্তী স্থানেই রয়েছে। হাক্কা রায়ের রণ পরিকল্পনা অনুসারে তিনি নিজে তাঁর ৮০০০ বাহিনী নিয়ে মধ্যরাতে সেনাপতি হামজা খানের নিদ্রিত শিবিরে আচমকা হামলা চালিয়ে হামজা খানকে নিধন করবেন। আর সেই সময়ে বুক্কা রায় আর কম্পন রায় তাঁদের নিজ নিজ বাহিনী নিয়ে অন্যপ্রান্ত থেকে ঘুমন্ত তুর্কি শিবিরে হামলা চালিয়ে তুর্কি নিধন যোগ্য শুরু করবেন।
তখন ঘন আধারাছন্ন মধ্যরাত। সারাদিন ধরে কাফেরদের গনিমতের মাল লুণ্ঠন করে আর খানাপিনা ও নাচাগানা করে ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী তুর্কি শিবির তখন গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। সন্ধ্যা নামবার পূর্বেই নিজ বাহিনী সমেত কামাতিদুর্গার পর্বতের অপরপ্রান্ত দিয়ে পর্বতশীর্ষে আরোহণ করলেন মহারাজ হরিহর রায়। এরপর অপেক্ষা করতে লাগলেন রাতের আধারের জন্য। রাত নামতেই মশালের আলোয় মার্জারের ন্যায় নিঃশব্দ আর দ্রুত গতিতে মহারাজ হাক্কা তাঁর ঘাতক সেনাবাহিনী সমেত কামাতিদুর্গা পর্বত থেকে নিচে তুর্কি শিবিরের দিকে নামতে শুরু করলেন। সেনাপতি হামজা খানের শিবিরের সম্মুখে উপস্থিত হয়ে দক্ষ গুপ্তঘাতকের ন্যায় বিজয়নগরের বাহিনী নিঃশব্দে হত্যা করতে লাগলো প্রহরারত তুর্কি রক্ষীদের। কিন্তু দুর্ভাগ্য মহারাজ হাক্কার। একসময় এক তুর্কি প্রহরী দেখতে পেয়ে গেল বিজয়নগরের ঘাতক বাহিনীকে। আতঙ্কগ্রস্ত সেই প্রহরী এক দৌড়ে দ্রুত হামজা খানের ছাউনিতে পৌঁছে তীক্ষ্ণ স্বরে চীৎকার করে ঘুমন্ত তুর্কি বাহিনীকে বিজয়নগরের বাহিনীর গুপ্ত আক্রমণের সংবাদ দিয়ে তাদের জাগ্রত করবার প্রয়াস শুরু করলেন।
হাতে সময় কম। ঘুমন্ত তুর্কি শিবির জাগ্রত হয়ে উঠলেই তাঁর যাবতীয় রণ পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে পারে আন্দাজ করে অরন্যের ভেতর থেকে “জয় সুন্দরেশ্বর” ধ্বনিতে চতুর্দিক আন্দোলিত করে হামজা খানের শিবিরের দিকে ধেয়ে এলেন মহারাজ হাক্কা রায় আর তাঁর বাহিনী। অগ্নিবাণ নিক্ষিপ্ত করে আর মশাল ছুড়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই তুর্কি সেনা ছাউনিতে অগ্নি সংযোগ করলো বিজয়নগরের বাহিনী। আগুনের লেলিহান শিখা থেকে নিজেদের প্রান রক্ষা করতে বিনা অস্ত্রে আর বিনা যুদ্ধের সাজে সজ্জিত হয়ে কাশতে কাশতে নিজ নিজ ছাউনি থেকে বাইরে বেরিয়ে এলো সেনাপতি হামজা খান সহ অবশিষ্ট তুর্কি বাহিনী। ছাউনি থেকে বাইরে বেরোতেই অরক্ষিত তুর্কি বাহিনীর উপর ভয়ানক আক্রমন শানালেন হাক্কা রায়। অপরদিকে অরন্যের বাকি দুই প্রান্ত থেকে “জয় সুন্দরেশ্বর” রবে গর্জন করে নিজ নিজ বাহিনী নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে তিনদিক থেকে তুর্কি শিবিরে ব্যপক হামলা চালালেন বুক্কা রায় আর কম্পন রায়। ঘুম জড়ানো চোখে মদ্যপ তুর্কি সেনাধ্যক্ষ হামজা খান এবং অনান্য তুর্কি সেনারা ব্যপারটা ঠিক কি ঘটছে সেটা বুঝে ওঠার পূর্বেই বিজয়নগরের ধনুর্ধরদের শরাঘাতে গুরুতর আহত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লো বেশকিছু তুর্কি সেনা। ইতিমধ্যেই কম্পন রায় আর বুক্কা রায় তাঁদের পদাতিক বাহিনী নিয়ে দ্রুতবেগে আক্রমন করলেন মূল তুর্কি বাহিনীকে। অপরদিকে মহারাজ হাক্কা রায় নিজের বাহিনী সমেত এগিয়ে এলেন বিস্মিত ও অপ্রস্তুত হামজা খানের দিকে। এদিকে রাতের আধারে বিজয়নগরের বিশাল হিন্দু বাহিনী তাদের চতুর্দিক থেকে বেষ্টিত করেছে ভেবে তীব্র আতঙ্কে দিশাহারা হয়ে পড়লো তুর্কি বাহিনী। আতঙ্কে ঠিকমতো যুদ্ধই করতে পারলো না কাপুরুষ তুর্কি সেনা। ভোরের ঊষাকিরণ প্রস্ফুটিত হবার সাথে সাথেই দেখা গেল বিজয়নগরের ঘাতক বাহিনীর হাতে নিধন হয়েছে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ হাজার তুর্কি সেনার। হাক্কা রায়ের বিরুদ্ধে তরবারির দ্বন্দ্বযুদ্ধে পরাজিত হয়ে বিজয়নগরের বাহিনীর হাতে বধ হলেন তুর্কি সেনাধ্যক্ষ হামজা খান। অপরদিকে যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করে পলায়নের সময় কম্পন রায়ের হাতেবন্দি হলেন মাদুরাইয়ের সুলতান জালালউদ্দিন এহসান খান। এছাড়াও বিজয়নগরের বাহিনীর নিকটে বন্দি হলো আরও ১৫ হাজার তুর্কি সেনা।
যুদ্ধের পরিণতি পর্ব
==============
আনিগণ্ডির যুদ্ধে এই নির্ণায়ক বিজয়লাভের ফলে এক শক্তিশালী হিন্দু রাজ্যে পরিনত হলো বিজয়নগর, পরবর্তীকালে সম্রাট কৃষ্ণদেব রায়ের সফল নেতৃত্বে যা এক সুবিশাল মহান হিন্দু সাম্রাজে পরিনত হয়। যুদ্ধের পরে এক মোটা অঙ্কের ক্ষতিপূরণের বদলে মাদুরাইয়ের সুলতান জালালউদ্দিন এহসান খানকে মীনাক্ষী আম্মান মন্দির পুনঃরসংস্কার আর রক্ষা করবার শর্তে মুক্তিদান করেন মহারাজ হরিহর রায়। বিজয়নগরের ইতিহাস অনুসারে হরিহর রায়ের প্রয়ানের পর বিজয়নগরের রাজসিংহাসনে আসীন হন তাঁর ভ্রাতা বুক্কা রায়। ১৩৭৮ সালে মহারাজ বুক্কা রায়ের নির্দেশে তাঁর দ্বিতীয় পুত্র রাজকুমার কম্পন রায় (হাক্কা-বুক্কার তৃতীয় ভ্রাতা কম্পন রায় নয়) এক বিশাল বাহিনী সমেত আক্রমন করেন মাদুরাই নগর। সেই যুদ্ধে বিজয়নগরের বাহিনীর বিরুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হন মাদুরাইয়ের অন্তিম তুর্কি সুলতান দ্বিতীয় আলাউদ্দিন শাহ এবং সেই সাথে মাদুরাইয়ের বুকে যবনিকাপাত হয় অত্যাচারী ভিনদেশি স্মেচ্ছ যবন শাসনের এবং পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হয় সনাতনী শাসন। রাজকুমার কম্পন রায়ের স্ত্রী গঙ্গাদেবীর দ্বারা রচিত বিখ্যাত সংস্কৃত কাব্যগ্রন্থ “মাদুরা বিজয়ম” অনুসারে মাদুরাই নগর স্মেচ্ছ মুক্ত করে মাদুরাইকে পুনরায় তাঁর পুরাতন রূপে ফিরিয়ে এনেছিলেন মহারাজ বুক্কা রায় আর তাঁর পুত্র রাজকুমার কম্পন রায়। রাজকুমার কম্পন রায় মাদুরাইয়ে দুই সুবিখ্যাত প্রাচীন শ্রীরঙ্গম আর মীনাক্ষী আম্মান মন্দিরের পুনঃরসংস্কার করে নগরের প্রাচীন বৈভব আর সমৃদ্ধ ফিরিয়ে এনেছিলেন। পরবর্তীকালে দাক্ষিণাত্যের মারাঠা অধিপতি ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ হাক্কা-বুক্কার রণনীতি দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।
সনাতনী ভারতবর্ষের ইতিহাসে বহু সার্জিকাল স্ট্রাইকের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই আনিগণ্ডির যুদ্ধ পরবর্তীকালে নিপুনভাবে ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে ফেলে ভারত সরকার। আনিগোণ্ডির যুদ্ধে বিজয়নগরের ইরতিদাদ রাজা হরিহর রায়ের বাহিনীর হাতে পর্যুদস্ত হবার পর ক্রুদ্ধ সুলতান এবারে তলব করলেন তাঁর প্রধান সিপাহী সালার ফিরোজ শাহ তুঘলককে। তাঁর হাতে ৪০,০০০ বিশাল তুর্কি সেনার নেতৃত্ব দিয়ে তাঁকে আদেশ দান করলেন ছলে, বলে, কৌশলে যেভাবেই হোক শয়তান ইরতিদাদ কুতুবউদ্দিন আর কামরুদ্দিনের বিচ্ছিন্ন মস্তক এনে তাঁর পদতলে সমর্পিত করবার। সুলতানের আদেশ শিরোধার্য করে বিদ্রোহী কাফের রাজ্য বিজয়নগরকে ধুলোয় মিশিয়ে দেবার জন্য দৌলতাবাদ (দেবগিরি) থেকে বিজয়নগরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলেন ফিরোজ শাহ।
তথ্যসূত্রঃ ১) A Forgotten Empire (Vijayanagar) by Robert Sewell
২) Dr. Suryanath U. Kamat, Concise history of Karnataka, MCC, Bangalore, 2001 (Reprinted 2002)
৩) Chopra, P.N. T.K. Ravindran and N. Subrahmanyam. History of South India. S. Chand, 2003
৪) Prof A V Narasimha Murthy: Rare Royal Brothers: Hakka and Bukka
=============
চৌদ্দ শতাব্দীর দাক্ষিণাত্যের পটভূমি
==========================
চৌদ্দ শতকের মধ্যযুগীয় ভারতবর্ষ তখন উত্তর-পশ্চিম প্রান্ত থেকে আগত বিজাতীয় স্মেচ্ছ তুর্কিদের পদানত। যবন দস্যু বাহিনীর পরাধীনতার শৃঙ্খল তখন আবদ্ধ করেছে সমগ্র মুলতান থেকে কান্যকুব্জ পর্যন্ত বিস্তীর্ণ উত্তরভারত আর গুজরাট থেকে ভূপাল পর্যন্ত সমগ্র মধ্যভারত। ১৩১০ সালের প্রথম ভাগ। দিল্লির তখতে তখন বর্বর আলাউদ্দিন খিলজির শাসনকাল। খিলজির পাশবিক শক্তির সম্মুখে পদানত গুজরাট আর মেবার সহ সমগ্র আর্যবর্ত্ম। একাদশীর পলতের ন্যায় জালোর নরেশ কানহাড়দেব চৌহান একাকী অসম যুদ্ধ করে চলেছেন স্মেচ্ছ তুর্কি বাহিনীর বিরুদ্ধে। তুর্কিদের নিকট উত্তর আর মধ্যভারতে লুণ্ঠন আর ধ্বংস যোগ্য আর কোন সমৃদ্ধশালী সনাতন ধর্মাবলম্বী রাজ্যের অস্তিত্ব না থাকায় এবারে আলাউদ্দিনের কুনজর পড়লো দাক্ষিণাত্যের দ্রাবিড় ভূমির উপর। স্মেচ্ছ দস্যু বাহিনীর আঁচ তখনও স্পর্শ করেনি দাক্ষিণাত্যকে। তাই ধনধান্যে সুহাংগীতা দাক্ষিণাত্য তখনও প্রাচীনকালের আর্যবর্ত্মের ন্যায় এক সমৃদ্ধশালী ভূমি। ১৩১০ সালে খিলজির বিশ্বস্ত সেনাপতি মালিক কাফুর প্রথমে দাক্ষিণাত্যের প্রবেশ ভূমি দেবগিরি রাজ্য আক্রমন করে তছনছ আর ছারখার করে একে একে কাকাতিয়া, হোয়শালা, পাণ্ড্য আর কাম্পিলি রাজ্য ধ্বংস করে, মীনাক্ষী আম্মান মন্দির, বেলুরের মন্দির, হোয়শালেশ্বর মন্দির সহ অগনিত মন্দির ধ্বংস আর লুণ্ঠন করে সর্বপ্রথম দাক্ষিণাত্যের দ্রাবিড় ভূমিতে তুর্কিদের প্রভুত্ব বিস্তার করলো। এরপর আলাউদ্দিনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে মহম্মদ বিন তুঘলকও দাক্ষিণাত্য আক্রমন করলো। ১৩৩০ সালের মধ্যভাগে দেখা গেল তুর্কি তাণ্ডবের সম্মুখে শুধুমাত্র হোয়শালা নরেশ তৃতীয় বীর বল্লাল ব্যাতিত দাক্ষিণাত্যের অবশিষ্ট হিন্দু রাজাদের পতন হয়েছে। আর্যবর্ত্মের ন্যায় দাক্ষিণাত্যেও কেরল, মহারাষ্ট্র, অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্ণাটক, মাদুরাই আর তামিলনাড়ু সহ বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বিজাতীয় তুর্কিদের ইসলামিক সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণ হয়েছে।
হাক্কা-বুক্কার উত্থান আর রাজা বীর বল্লালের প্রতিরোধ
=====================================
তখন ১৩৪২ সাল। পারস্য আর খোরাসানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছে দিল্লির সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলকের বাহিনী। যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে তীব্র অর্থ সঙ্কটে জর্জরিত হয়ে পড়েছে সুলতানের বিশাল তুর্কি বাহিনী। চতুর্দিকে তখন সুলতানের অত্যাচারী নীতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন তার নিজেরই আমির-ওমরাহরা। এই সুযোগের সম্পূর্ণ সদবহার করে তুর্কি সুলতানের বিরুদ্ধে সরাসরি বিদ্রোহ ঘোষণা করে সাবেক কাম্পিলি রাজ্যের রাজধানি হাম্পি নগরীতে স্বাধীন হিন্দু রাজ্য বিজয়নগর স্থাপন করলেন হরিহর আর বুক্কা রায় নামের দুই বীর হিন্দু ভ্রাতা। বিজয়নগর রাজ্য স্থাপনে তাঁদের যোগ্য সহায়তা প্রদান করলেন হোয়শালা রাজ্যের প্রবীণ শাসক মহারাজ তৃতীয় বীর বল্লাল। এদিকে মাদুরাইয়ে অবস্থিত সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলকের অন্যতম প্রধান সেনাধ্যক্ষ জালালউদ্দিন এহসান খানও দিল্লির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে মাদুরাইয়ে এক স্বাধীন তুর্কি সুলতানত স্থাপন করেছিলেন। জালালউদ্দিন এহসান খান মাদুরাইয়ের প্রথম তুর্কি সুলতান হিসাবে অভিষিক্ত হয়েই সিদ্ধান্ত নিলেন প্রসিদ্ধ মীনাক্ষী আম্মান মন্দির সম্পূর্ণ রূপে ধস্ত করে মন্দিরের মালমশলা দিয়ে মক্কা মসজিদ স্থাপন করবেন।
মহারাজ বীর বল্লাল মাদুরাইয়ের তুর্কি সুলতানের এই বাসনার সংবাদ পেয়েই মীনাক্ষী আম্মান মন্দির রক্ষা করবার জন্য মাদুরাইয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। এক যুদ্ধে যখন মহারাজ বীর বল্লালের বিজয় শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা তখন মাদুরাইয়ের ভীত ও সন্ত্রস্ত্র সুলতান তাঁকে শান্তি আলোচনার প্রস্তাব প্রেরন করলেন। যথাসময়ে দুই পক্ষের মধ্যে শুরু হলো শান্তি আলোচনা। কিন্তু তখনও মহারাজ বীর বল্লাল সম্পূর্ণ রূপে অজ্ঞাত ছিলেন সুলতান জালালউদ্দিনের আসল অভিপ্রায় সম্বন্ধে। আলোচনার নামে প্রহসন চলাকালীন ছদ্মবেশী তুর্কি ঘাতক বাহিনী আচমকা কাপুরুষোচিত হামলা চালালো নিরস্ত্র মহারাজ বীর বল্লাল আর তাঁর অঙ্গ রক্ষকদের উপর। সেই প্রাণঘাতী হামলায় বীরগতি প্রাপ্ত হলেন মহারাজ বীর বল্লাল।
আনিগণ্ডির যুদ্ধের প্রেক্ষাপট
====================
কাপুরুষ তুর্কি ঘাতক বাহিনীর হাতে নিজের পিতৃসম মহারাজ বীর বল্লালের অকাল প্রয়ানের সংবাদ শ্রবণ করে যারপরনাই ক্রুদ্ধ হলেন বিজয়নগরের রাজা হরিহর রায় (হাক্কা)। তিনি মাদুরাইয়ের সুলতানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে নিজের বাহিনী নিয়ে মাদুরাই নগরীর দিকে ধাবিত হলেন। এদিকে এরকম কিছু ঘটতে পারে সেটা পূর্বেই অনুমান করে মাদুরাইয়ের সুলতান জালালউদ্দিন এহসান খান তার পূর্ববর্তী প্রভু দিল্লির সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলকের নিকট সেনা সহায়তা চেয়ে পত্র প্রেরন করেছিলেন। শুধুমাত্র দাক্ষিণাত্যের বুকে ইসলামের বিজয়যাত্রা অক্ষুণ্ণ রাখবার জন্য নিজের বিদ্রোহী আমিরের সাহায্যের আর্তিতে সাড়া দিয়ে এক বিশাল তুর্কি সেনা প্রেরন করলেন মহম্মদ বিন তুঘলক। পারস্য ঐতিহাসিক ফরিস্তার লেখনী অনুযায়ী দিল্লি আর মাদুরাইয়ের সংযুক্ত বাহিনীর সংখ্যা ছিল আনুমানিক ৬০ থেকে ৮০ হাজার। অপরদিকে বিজয়নগরের সেনাবাহিনীর সংখ্যা ছিল মাত্র ১৫ থেকে ২০ হাজার। রণকুশলী রাজা হরিহর রায় আর তাঁর ভ্রাতা তথা প্রধান সেনাপতি বুক্কা রায় বুঝতে পারলেন যে সম্মুখ সমরে সুবিশাল বিজাতীয় তুর্কি বাহিনীকে পরাজিত করা অসম্ভব। এমনকি এই মুহূর্তে গেরিলা যুদ্ধেও জয়লাভের ব্যপারে কোন নিশ্চয়তা নেই। এদিকে মাদুরাইয়ের সুলতান জালালউদ্দিন পত্র মারফৎ দিল্লির সুলতানকে জানালেন গেরিলা যুদ্ধে বিজয়নগরের মহারাজ আর সেনাপতি হাক্কা-বুক্কার অসাধারন পারদর্শিতার কথা। জালালউদ্দিনের পত্র পাঠ করে সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলক, ঘন অরণ্য আর পশ্চিমঘাট পর্বতে আচ্ছাদিত দাক্ষিণাত্যের আদিম পরিবেশের কথা চিন্তা করে কিছুটা শঙ্কিত হয়ে পড়লেন। তিনি তার বাহিনীকে একসাথে দাক্ষিণাত্যের ভূমিতে প্রেরন করলেন না। সম্পূর্ণ বাহিনীকে বেশ কয়েকটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিভাগে বিভক্ত করে প্রেরন করতে লাগলেন। এদিকে পশ্চিমঘাটের অরন্য প্রান্তরে দিল্লির তুর্কি বাহিনীর বিরুদ্ধে দুএকটি গেরিলা যুদ্ধ সম্পন্ন করেই চতুর রাজা হরিহর রায় উপলব্ধি করতে পারলেন যে এরা দিল্লির মূল তুর্কি বাহিনী নয়। বিজয়নগরের বাহিনীকে ধিরে ধিরে পর্যুদস্ত ও পরিশ্রান্ত করবার অভিপ্রায়ে সুলতান এদের প্রেরন করেছেন। দিল্লির মূল বাহিনী আর কিছুকালের মধ্যেই দাক্ষিণাত্যের ভূমিতে পদার্পণ করবে। দিল্লির তুর্কি সুলতানের এই রণনীতি উপলব্ধি করতে পেরে রনে ভঙ্গ দিয়ে হাম্পি নগর পরিত্যাক্ত করে বিজয়নগরের বাহিনীকে বেশ কয়েকটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিভাগে বিভক্ত করে মেষপালকের ছদ্মবেশ ধারন করে ঘন অরন্যে আচ্ছাদিত দুর্গম আনিগণ্ডি পর্বতে গাঢাকা দিলেন রাজা হরিহর আর সেনাপতি বুক্কা রায়।
বৈদিক কিংবদন্তী অনুসারে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে রয়েছে এই আনিগণ্ডি পর্বত। রামায়নের কাহিনী অনুসারে এখানেই একদা অবস্থিত ছিল বানররাজ বালি আর তাঁর ভ্রাতা সুগ্রীবের রাজ্য কিষ্কিন্ধ্যা। দুর্গম আনিগণ্ডি পর্বতে ঘন অরন্যের মধ্যে ছিল সীতা সরোবর, রামপদ, বালি ভাণ্ডার আর সুগ্রীবের গুহা। লঙ্কা অভিযানের সময় এখানই কিছুকালের জন্য আশ্রয় গ্রহন করেছিলেন অযোধ্যা নরেশ শ্রী রামচন্দ্র। ১৩৪২ সালে এই আনিগণ্ডি পর্বত প্রান্তেই আশ্রয় গ্রহন করলেন বিজয়নগরের প্রতাপশালী মহারাজ হরিহর আর তাঁর সেনাপতি বুক্কা রায়। অপরদিকে বিনাযুদ্ধে বিজয়নগরের রাজার পলায়নের সংবাদ শুনে প্রথমে বিশ্বাস না করলেও পরে নিজের বিশ্বস্ত গুপ্তচর মারফৎ হাক্কা আর বুক্কার অন্তর্ধানের সংবাদ শুনে একদিকে যেমন আশ্বস্ত হলেন দিল্লির তুর্কি সেনাপতি হামজা খান, তেমনি অপরদিকে হাক্কা-বুক্কার কাপুরুষোচিত পলায়নের সংবাদ শুনে প্রবল ঔদ্ধত্যে বিজয়নগর আক্রমণের নির্দেশ দিলেন তিনি।
হামজা খানের নির্দেশে বিভিন্ন খণ্ডে বিভক্ত দিল্লি আর মাদুরাইয়ের তুর্কি বাহিনী পুনরায় একত্রিত হয়ে বিজয়নগরের রাজধানি হাম্পির দিকে অগ্রসর হলেন। পথে পূর্ববর্তী হোয়শালা রাজ্যের অন্তর্গত বহু সুপ্রাচীন হিন্দু মন্দির লুণ্ঠন আর ধ্বংস করলেন, বহু নিরীহ আর নিরস্ত্র অসহায় নাগরিকদের নির্মমভাবে হত্যা করলেন। একসময়ে হাম্পি নগরে অনুপ্রবেশ করে ভয়াবহ তাণ্ডব প্রদর্শন করলো দিল্লির তুর্কি বাহিনী। হামজা খান আর মাদুরাইয়ের সুলতান জালালউদ্দিন এহসান খান ভেবেছিলেন যে নিজের রাজ্য আর রাজধানিতে তুর্কি বাহিনীর তাণ্ডবের সংবাদ লাভ করে উত্তেজিত হয়ে নিজেদের গুপ্তস্থল থেকে আত্মপ্রকাশ করে দিল্লির বাহিনীর উপর আক্রমন শানাবেন হাক্কা আর বুক্কা। আর সেই সুযোগে নব্য গঠিত হিন্দু রাজ্য বিজয়নগরের ক্ষুদ্র বাহিনীকে ধ্বংস করবে দিল্লির বাহিনী। কিন্তু তাদের সেই প্রচেষ্টায় জল ঢেলে নিজেদের গুপ্তস্থল থেকে আত্মপ্রকাশ করলেন না হাক্কা আর বুক্কা। আনিগণ্ডির দুর্গম কিষ্কিন্ধ্যা পাহাড়ে নিজেদের গুপ্ত শিবিরে বসে প্রতিনিয়ত গুপ্তচরের নিকটে বিজয়নগরের উপর তুর্কি বাহিনীর পাশবিক আর বর্বর আক্রমণের সংবাদ শুনতেন হাক্কা আর বুক্কা আর নিজেদের বিক্ষিপ্ত মন শান্ত রেখে ধীরস্থির ভাবে অপেক্ষা করতেন স্মেচ্ছ বিজাতীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে উপযুক্ত প্রতিশোধ গ্রহণের সঠিক সময়ের জন্য।
এদিকে তুর্কি বাহিনী বিজয়নগরের অধিকাংশ এলাকা সহ রাজধানি হাম্পি নগর লুণ্ঠন আর অধিকার করে বিজয়নগরের পলাতক রাজা আর সেনাপতির গুপ্তস্থানের সুলুক লাভের জন্য বিজয়নগরের কাফের অধিবাসীদের উপর নির্মম অত্যাচার শুরু করলো। অত্যাচারের সাথে সাথে চললো নানা রকমের প্রলোভন প্রদর্শনও। কিন্তু তাতে বিশেষ লাভ হলো না কিছুই। দাক্ষিণাত্যের মুক্তিদূত হাক্কা আর বুক্কার গুপ্তস্থানের সন্ধান তুর্কিদের কাছে পৌঁছে দিলো না কেউই। অপরদিকে কিষ্কিন্ধ্যা পর্বতে আত্মগোপনকারী হাক্কা আর বুক্কা তাঁদের গুপ্তচরদের মারফতে বিজয়নগরের চতুর্দিকে রটিয়ে দিলো এক মিথ্যে সংবাদ। সেই সংবাদ ছিল অনেকটা এরকম। জনমানব বিচ্ছিন্ন নিজেদের দুর্গম গুপ্তস্থানে বসবাসের সময় অভুক্ত আর অপুষ্টিতে ভোগা হাক্কা আর বুক্কা এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মারা পড়েছেন। তাঁদের স্বপ্নের হিন্দু স্বরাজ্য বিজয়নগর এখন সম্পূর্ণ অবিভাবকহীন। ক্রমে সেই সংবাদ এসে পৌঁছল তুর্কিদের কানেও। ইতিমধ্যেই অতিবাহিত হয়েছে প্রায় ৭-৮ মাস। যুদ্ধ তো দূরবর্তী স্থান এমনকি সামান্যতম প্রতিরোধও দেখা যায়নি বিজয়নগরের বাহিনীর তরফে। অতএব হাক্কা-বুক্কার মৃত্যু সংবাদ ধীরে ধীরে সত্য বলে মনে হতে লাগলো তুর্কি সেনাধ্যক্ষ হামজা খানের নিকটে। হাক্কা-বুক্কার প্রয়ানের ফলে তুর্কি বাহিনীকে সম্পূর্ণ রূপে বিপদ মুক্ত ভ্রম করে, স্থানাভাবের কারনে নিজের বিশাল বাহিনী সমেত হাম্পি নগরের বাইরে আনিগণ্ডির নিকটে পর্বত আর অরন্যে ঘেরা কামাতিদুর্গা নামে এক নির্জন স্থানে তার নতুন শিবির স্থাপন করলেন হামজা খান।
আনিগণ্ডির যুদ্ধ আর হাক্কা-বুক্কার গৌরবগাথা
================================
এদিকে গুপ্তচরের মুখে নিজেদের গুপ্ত পরিকল্পনার সফল রুপায়নের সংবাদ লাভ করলেন মহারাজ হাক্কা। আনিগণ্ডির পাহাড়ে নিজের সেনা শিবিরে নিজ অসি কোষমুক্ত করে শূন্যে উত্থলিত করে মহারাজ হরিহর রায় তাঁর বাহিনীর উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন, “বন্ধুগণ দীর্ঘ অপেক্ষা, অত্যাচার আর অনাচার সইবার পর অবশেষে আজ সেই সঠিক সময় আর সুযোগ আমাদের সম্মুখে এসে উপস্থিত হয়েছে। বিজাতীয় স্মেচ্ছ তুর্কি বাহিনী আমার আর ভ্রাতা বুক্কা রায়ের মৃত্যু সংবাদ বিশ্বাস করে আমাদের ফাঁদে পা দিয়ে নিজেদের প্রহরায় শিথিল করেছে। মহাভারতের শিশুপালের ন্যায় পাপের ঘড়া পূর্ণ হয়েছে স্মেচ্ছ দস্যুদের। এখন সময় এসেছে তুর্কি বাহিনীর বিরুদ্ধে মোক্ষম আঘাত হেনে নিজেদের দুষ্কর্ম আর পাপের জন্য তাঁদের উপযুক্ত শাস্তি প্রদানের। আপনারা সবাই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হন। আগামিকাল রাতেই আমরা স্মেচ্ছ বাহিনীকে আক্রমন করবো। জয় সুন্দরেশ্বর”
সাথে সাথে বুক্কা রায় আর বিজয়নগরের সেনাবাহিনী তাঁদের অস্ত্র শূন্যে উত্থলিত করে সমশ্বরে গর্জন করে উঠলেন, “হর হর সুন্দরেশ্বর”।
নিজের বাহিনীকে তিন ভাগে বিভক্ত করলেন হরিহর রায়। একটি বাহিনীর নেতৃত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিলেন, দ্বিতীয় বাহিনীর নেতৃত্ব বুক্কা রায়ের অধীনে রইলো এবং তৃতীয় বাহিনীর নেতৃত্ব দেওয়া হলো দ্বিতীয় সেনাপতি কুমার কম্পন রায়কে। এই কম্পন রায় হাক্কা-বুক্কার তৃতীয় ভ্রাতা ছিলেন। গুপ্তচরের মারফৎ রাজা হাক্কা রায় পূর্বেই সংবাদ পেয়েছিলেন যে এই মুহূর্তে তুর্কি বাহিনীর প্রধান সেনাপতি হামজা খান তাঁর বিশিষ্ট দেহরক্ষী আর বাহিনী সমেত শিবির স্থাপন করেছেন নিকটবর্তী কামাতিদুর্গা নামে অরণ্য আচ্ছাদিত এক পর্বতের পাদদেশে। দিল্লির অবশিষ্ট বাহিনীও কামাতিদুর্গার নিকটবর্তী স্থানেই রয়েছে। হাক্কা রায়ের রণ পরিকল্পনা অনুসারে তিনি নিজে তাঁর ৮০০০ বাহিনী নিয়ে মধ্যরাতে সেনাপতি হামজা খানের নিদ্রিত শিবিরে আচমকা হামলা চালিয়ে হামজা খানকে নিধন করবেন। আর সেই সময়ে বুক্কা রায় আর কম্পন রায় তাঁদের নিজ নিজ বাহিনী নিয়ে অন্যপ্রান্ত থেকে ঘুমন্ত তুর্কি শিবিরে হামলা চালিয়ে তুর্কি নিধন যোগ্য শুরু করবেন।
তখন ঘন আধারাছন্ন মধ্যরাত। সারাদিন ধরে কাফেরদের গনিমতের মাল লুণ্ঠন করে আর খানাপিনা ও নাচাগানা করে ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী তুর্কি শিবির তখন গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। সন্ধ্যা নামবার পূর্বেই নিজ বাহিনী সমেত কামাতিদুর্গার পর্বতের অপরপ্রান্ত দিয়ে পর্বতশীর্ষে আরোহণ করলেন মহারাজ হরিহর রায়। এরপর অপেক্ষা করতে লাগলেন রাতের আধারের জন্য। রাত নামতেই মশালের আলোয় মার্জারের ন্যায় নিঃশব্দ আর দ্রুত গতিতে মহারাজ হাক্কা তাঁর ঘাতক সেনাবাহিনী সমেত কামাতিদুর্গা পর্বত থেকে নিচে তুর্কি শিবিরের দিকে নামতে শুরু করলেন। সেনাপতি হামজা খানের শিবিরের সম্মুখে উপস্থিত হয়ে দক্ষ গুপ্তঘাতকের ন্যায় বিজয়নগরের বাহিনী নিঃশব্দে হত্যা করতে লাগলো প্রহরারত তুর্কি রক্ষীদের। কিন্তু দুর্ভাগ্য মহারাজ হাক্কার। একসময় এক তুর্কি প্রহরী দেখতে পেয়ে গেল বিজয়নগরের ঘাতক বাহিনীকে। আতঙ্কগ্রস্ত সেই প্রহরী এক দৌড়ে দ্রুত হামজা খানের ছাউনিতে পৌঁছে তীক্ষ্ণ স্বরে চীৎকার করে ঘুমন্ত তুর্কি বাহিনীকে বিজয়নগরের বাহিনীর গুপ্ত আক্রমণের সংবাদ দিয়ে তাদের জাগ্রত করবার প্রয়াস শুরু করলেন।
হাতে সময় কম। ঘুমন্ত তুর্কি শিবির জাগ্রত হয়ে উঠলেই তাঁর যাবতীয় রণ পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে পারে আন্দাজ করে অরন্যের ভেতর থেকে “জয় সুন্দরেশ্বর” ধ্বনিতে চতুর্দিক আন্দোলিত করে হামজা খানের শিবিরের দিকে ধেয়ে এলেন মহারাজ হাক্কা রায় আর তাঁর বাহিনী। অগ্নিবাণ নিক্ষিপ্ত করে আর মশাল ছুড়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই তুর্কি সেনা ছাউনিতে অগ্নি সংযোগ করলো বিজয়নগরের বাহিনী। আগুনের লেলিহান শিখা থেকে নিজেদের প্রান রক্ষা করতে বিনা অস্ত্রে আর বিনা যুদ্ধের সাজে সজ্জিত হয়ে কাশতে কাশতে নিজ নিজ ছাউনি থেকে বাইরে বেরিয়ে এলো সেনাপতি হামজা খান সহ অবশিষ্ট তুর্কি বাহিনী। ছাউনি থেকে বাইরে বেরোতেই অরক্ষিত তুর্কি বাহিনীর উপর ভয়ানক আক্রমন শানালেন হাক্কা রায়। অপরদিকে অরন্যের বাকি দুই প্রান্ত থেকে “জয় সুন্দরেশ্বর” রবে গর্জন করে নিজ নিজ বাহিনী নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে তিনদিক থেকে তুর্কি শিবিরে ব্যপক হামলা চালালেন বুক্কা রায় আর কম্পন রায়। ঘুম জড়ানো চোখে মদ্যপ তুর্কি সেনাধ্যক্ষ হামজা খান এবং অনান্য তুর্কি সেনারা ব্যপারটা ঠিক কি ঘটছে সেটা বুঝে ওঠার পূর্বেই বিজয়নগরের ধনুর্ধরদের শরাঘাতে গুরুতর আহত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লো বেশকিছু তুর্কি সেনা। ইতিমধ্যেই কম্পন রায় আর বুক্কা রায় তাঁদের পদাতিক বাহিনী নিয়ে দ্রুতবেগে আক্রমন করলেন মূল তুর্কি বাহিনীকে। অপরদিকে মহারাজ হাক্কা রায় নিজের বাহিনী সমেত এগিয়ে এলেন বিস্মিত ও অপ্রস্তুত হামজা খানের দিকে। এদিকে রাতের আধারে বিজয়নগরের বিশাল হিন্দু বাহিনী তাদের চতুর্দিক থেকে বেষ্টিত করেছে ভেবে তীব্র আতঙ্কে দিশাহারা হয়ে পড়লো তুর্কি বাহিনী। আতঙ্কে ঠিকমতো যুদ্ধই করতে পারলো না কাপুরুষ তুর্কি সেনা। ভোরের ঊষাকিরণ প্রস্ফুটিত হবার সাথে সাথেই দেখা গেল বিজয়নগরের ঘাতক বাহিনীর হাতে নিধন হয়েছে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ হাজার তুর্কি সেনার। হাক্কা রায়ের বিরুদ্ধে তরবারির দ্বন্দ্বযুদ্ধে পরাজিত হয়ে বিজয়নগরের বাহিনীর হাতে বধ হলেন তুর্কি সেনাধ্যক্ষ হামজা খান। অপরদিকে যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করে পলায়নের সময় কম্পন রায়ের হাতেবন্দি হলেন মাদুরাইয়ের সুলতান জালালউদ্দিন এহসান খান। এছাড়াও বিজয়নগরের বাহিনীর নিকটে বন্দি হলো আরও ১৫ হাজার তুর্কি সেনা।
যুদ্ধের পরিণতি পর্ব
==============
আনিগণ্ডির যুদ্ধে এই নির্ণায়ক বিজয়লাভের ফলে এক শক্তিশালী হিন্দু রাজ্যে পরিনত হলো বিজয়নগর, পরবর্তীকালে সম্রাট কৃষ্ণদেব রায়ের সফল নেতৃত্বে যা এক সুবিশাল মহান হিন্দু সাম্রাজে পরিনত হয়। যুদ্ধের পরে এক মোটা অঙ্কের ক্ষতিপূরণের বদলে মাদুরাইয়ের সুলতান জালালউদ্দিন এহসান খানকে মীনাক্ষী আম্মান মন্দির পুনঃরসংস্কার আর রক্ষা করবার শর্তে মুক্তিদান করেন মহারাজ হরিহর রায়। বিজয়নগরের ইতিহাস অনুসারে হরিহর রায়ের প্রয়ানের পর বিজয়নগরের রাজসিংহাসনে আসীন হন তাঁর ভ্রাতা বুক্কা রায়। ১৩৭৮ সালে মহারাজ বুক্কা রায়ের নির্দেশে তাঁর দ্বিতীয় পুত্র রাজকুমার কম্পন রায় (হাক্কা-বুক্কার তৃতীয় ভ্রাতা কম্পন রায় নয়) এক বিশাল বাহিনী সমেত আক্রমন করেন মাদুরাই নগর। সেই যুদ্ধে বিজয়নগরের বাহিনীর বিরুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হন মাদুরাইয়ের অন্তিম তুর্কি সুলতান দ্বিতীয় আলাউদ্দিন শাহ এবং সেই সাথে মাদুরাইয়ের বুকে যবনিকাপাত হয় অত্যাচারী ভিনদেশি স্মেচ্ছ যবন শাসনের এবং পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হয় সনাতনী শাসন। রাজকুমার কম্পন রায়ের স্ত্রী গঙ্গাদেবীর দ্বারা রচিত বিখ্যাত সংস্কৃত কাব্যগ্রন্থ “মাদুরা বিজয়ম” অনুসারে মাদুরাই নগর স্মেচ্ছ মুক্ত করে মাদুরাইকে পুনরায় তাঁর পুরাতন রূপে ফিরিয়ে এনেছিলেন মহারাজ বুক্কা রায় আর তাঁর পুত্র রাজকুমার কম্পন রায়। রাজকুমার কম্পন রায় মাদুরাইয়ে দুই সুবিখ্যাত প্রাচীন শ্রীরঙ্গম আর মীনাক্ষী আম্মান মন্দিরের পুনঃরসংস্কার করে নগরের প্রাচীন বৈভব আর সমৃদ্ধ ফিরিয়ে এনেছিলেন। পরবর্তীকালে দাক্ষিণাত্যের মারাঠা অধিপতি ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ হাক্কা-বুক্কার রণনীতি দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।
সনাতনী ভারতবর্ষের ইতিহাসে বহু সার্জিকাল স্ট্রাইকের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই আনিগণ্ডির যুদ্ধ পরবর্তীকালে নিপুনভাবে ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে ফেলে ভারত সরকার। আনিগোণ্ডির যুদ্ধে বিজয়নগরের ইরতিদাদ রাজা হরিহর রায়ের বাহিনীর হাতে পর্যুদস্ত হবার পর ক্রুদ্ধ সুলতান এবারে তলব করলেন তাঁর প্রধান সিপাহী সালার ফিরোজ শাহ তুঘলককে। তাঁর হাতে ৪০,০০০ বিশাল তুর্কি সেনার নেতৃত্ব দিয়ে তাঁকে আদেশ দান করলেন ছলে, বলে, কৌশলে যেভাবেই হোক শয়তান ইরতিদাদ কুতুবউদ্দিন আর কামরুদ্দিনের বিচ্ছিন্ন মস্তক এনে তাঁর পদতলে সমর্পিত করবার। সুলতানের আদেশ শিরোধার্য করে বিদ্রোহী কাফের রাজ্য বিজয়নগরকে ধুলোয় মিশিয়ে দেবার জন্য দৌলতাবাদ (দেবগিরি) থেকে বিজয়নগরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলেন ফিরোজ শাহ।
তথ্যসূত্রঃ ১) A Forgotten Empire (Vijayanagar) by Robert Sewell
২) Dr. Suryanath U. Kamat, Concise history of Karnataka, MCC, Bangalore, 2001 (Reprinted 2002)
৩) Chopra, P.N. T.K. Ravindran and N. Subrahmanyam. History of South India. S. Chand, 2003
৪) Prof A V Narasimha Murthy: Rare Royal Brothers: Hakka and Bukka
Comments
Post a Comment